নিশা দত্ত
‘চল্ পাহাড় যাই’ আমার মনে হয় প্রত্যেকটা বন্ধুদের গ্রুপেই এই আলোচনাটা হয়৷ আমাদেরও হয়েছে বহুবার৷ কিন্তু কর্মসূত্রে চারজন চার জায়গায় ছড়িয়ে থাকায় বাস্তবায়িত হয়নি৷ চার কন্যের মধ্যে একজনের সামনেই বিয়ে৷ এইবার তো একটা Bachelorette trip হতেই হবে। সেই মতো দিনক্ষণ ঠিক করে অফিস, বাড়ি সামলে চেপে বসলাম পাহাড়গামী ট্রেনে৷ গন্তব্য চটকপুর আর মহালদিরাম। শতাব্দী এক্সপ্রেসে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে রাতটুকু শিলিগুড়ির বিনায়ক হোটেলে কাটালাম৷
পরদিন ভোর হতে না হতে সক্কলে রেডি৷ সমতলে একটুও সময় নষ্ট করা যাবে না। হোমস্টের পাঠানো গাড়িতে রওনা দিলাম চটকপুরের উদ্দেশ্যে৷ শিলিগুড়ি থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পেয়ে বুঝতে পেরেছিলাম চটকপুরে অসম্ভব সুন্দর কিছুর সাক্ষী হতে চলেছি৷ পাহাড়ের কোল বেয়ে আমাদের গাড়ি এগোতে থাকল৷ যাত্রাপথের আনন্দ নিতে নিতে পৌঁছলাম গুডরিক টিপটসের মার্গারেটস ডেক–এ৷ আমরা একসাথে আর খাওয়া দাওয়া হবেনা? টেস্টি ইংলিশ ব্রেকফাস্টের সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে পেলাম অসম্ভব সুন্দর ভিউ৷
সোনাদা থেকে চটকপুরের রাস্তাটা খুব খারাপ। কিন্তু আমাদের বেশ অ্যাডভেঞ্চারাস লাগছিল। একটা ঝকঝকে দিনে আমরা চটকপুর এসে পৌছলাম। আমাদের ড্রাইভার দাদাও বলছিলেন ‘আপলোগ ধূপ লে করকে আয়ে হো’৷ মাত্র আগের দিনই মেঘলা আকাশ ছিল। যেমনটা ভেবেছিলাম চটকপুর থেকে যে রূপে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখলাম সেটা ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্যি নেই। এমনকী কোনও ছবিতেও বোঝানো যাবে না। ক্যামেরার লেন্সেরও সেই সাধ্য নেই। চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করলাম বিশাল শায়িত বুদ্ধ৷
লাঞ্চ সেরে পায়ে হেঁটে ঘুরলাম চটকপুর গ্রাম৷ ছবির মতো সাজানো৷ রাতে তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে ঘুম৷ পরদিন ভোরবেলা চটকপুর ভিউ পয়েন্ট থেকে সূর্যোদয়ের অভূতপূর্ব এক মূহুর্তের সাক্ষী থাকলাম৷ পুরো উপত্যকায় কে যেন কমলা আবির ছড়িয়ে দিল তার সাথে সোনালী কাঞ্চনজঙ্ঘা। আহ্ স্বর্গীয় এক অনুভূতি৷ কালীপোখরি দেখে এসে ব্রেকফাস্ট সারলাম৷ চটকপুর তার সব সৌন্দৰ্য্য উজাড় করে দিয়েছে আমাদের সামনে৷ একটুও হতাশ করেনি। বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম মহলদিরামের পথে৷
আমাদের দ্বিতীয় দিনের আস্তানা মহালদিরাম৷ কার্শিয়াংয়ের এই ছোট্ট গ্রামে আমাদের ডেরা ছিল Salamander jungle camp-এ৷ চা বাগানের মাঝখানে মিষ্টি একটা জায়গা৷ জানলার বাইরে তাকালে একদিকে চা–বাগান। একদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা। কাঁসার থালায় গরম গরম লাঞ্চ সেরে বেরিয়ে পড়লাম নির্জন গ্রাম্য পথে মেঘকে সঙ্গী করে পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াব বলে। পাহাড়ের ধারে গার্ড ওয়ালে বসে পা দোলাতে দোলাতে দেখলাম ঢেউ খেলে যাওয়া পাহাড়ি উপত্যকা৷ ঝুপ করে সন্ধ্যে নামল৷ রাত্রের মহালদিরামও কিন্তু বেশ মায়াবী৷ একদিকে জোনাকির মতো জ্বলতে থাকা দার্জিলিং, কালিম্পং শহর অন্যদিকে ঝলমলে শিলিগুড়ি৷ মেঘ, কুয়াশা আর চা–বাগানের কোলে দুটো দিন বিশ্রাম নিতে চাইলে মহলদিরাম আদর্শ জায়গা৷
পরের দিন সকালেই সেজেগুজে রেডি৷ পাহাড়ের গায়ে চা বাগানের সুন্দর ট্ৰেল ধরে এগিয়ে চললাম হিলটপে৷ সেখানে এক প্রস্থ ফোটো তোলা, নাচানাচি করে ফিরে এলাম হোটেলে৷ ব্ৰেকফাস্ট করে বেড়িয়ে পড়লাম৷ আজই আমাদের ফেরার ট্রেন দার্জিলিং মেল৷ পথে অহলদারা ভিউ পয়েন্ট, নামথিং পোখরি, সিটং অরেঞ্জ গার্ডেন, যোগীঘাট আর মংপু রবীন্দ্রভবন দেখে নিলাম৷ এবার ফেরার পালা৷ পাইন, ওক, সিডার, ম্যাপল এর জঙ্গল আর প্রিয় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ছেড়ে নিচে নামতে ইচ্ছা করে না৷ এই সময়টা বড্ড মনখারাপের৷ বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলতে পারিনি৷ যাই হোক, মৌনতা ভেঙে শুরু করলাম আগামী দিনে কী ট্রিপ করা যায় সেই প্ল্যানিং। পাহাড়কে কথা দিয়ে এলাম, ‘খুব শিগগিরই আবার ফিরব’।
❏ চটকপুর
পেমা হোমস্টে
9609717651
❏ মহলদিরাম
সালামান্ডার জঙ্গল ক্যাম্প
9339935704