শুনুন ধর্মাবতার

স্বরূপ গোস্বামী

কাল অনেক রাত পর্যন্ত টিভির নানা চ্যানেলের আলোচনার পুনঃপ্রচার শুনেছি। একুশে জুলাই কমিশ নিয়ে নানা আলোচনা হলেও কোথাও প্রসঙ্গটা উঠে আসেনি।  আজ সকাল থেকে বাংলা ও ইংরাজি মিলিয়ে সাতখানা কাগজ পড়েছি। প্রায় সব কাগজেই প্রথম পাতায় গুরুত্ব দিয়েই ছাপা হয়েছে একুশে জুলাই কমিশন নিয়ে আপনার রিপোর্ট ও তাকে নিয়ে চাপানোতর। কিন্তু কয়েকটা মৌলিক প্রশ্ন কোথাও খুঁজে পেলাম না। এমনকি সিপিএমের মুখপত্র গণশক্তিতেও না। তাই হে ধর্মাবতার, সাতসকালে নিজেই এই লেখা লিখছি।

যে সব বিষয়গুলো নিয়ে তর্ক উঠছে, প্রশ্ন উঠছে, সেগুলোতে বরং পরে আসা যাবে। যে বিষয় কোথাও আলোচনা হয়নি, সেখানেই বরং আগে ঢোকা যাক।

আচ্ছা, মাননীয় সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়, আপনার আসল পরিচয় কী ? সব জায়গায় লেখা হচ্ছে হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি। এই পরিচয়টা একেবারে মিথ্যে নয়। আবার পুরোটা সত্যিও নয়। বলা হচ্ছে, আপনার নেতৃত্বে গড়া কমিশন বিচার বিভাগীয় কমিশন। কী আশ্চর্য, কেউ তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে না। অথচ, এটাকে বিচার বিভাগীয় কমিশন বলি কী করে বলুন তো !

সহজ কথাটা সহজভাবে বলাই ভাল। আপনি একজন তৃণমূলি। না, এটা মোটেই রাজনৈতিক অভিযোগ নয়। ফিরে চলুন, চোদ্দ বছর আগের একটি দুপুরে। আপনি তখন সদ্য অবসর নিয়েছেন। অবসর নেওয়ার এক মাসের মধ্যেই হাজির হলেন প্রেস ক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে। সেখানে আপনি সরাসরি তৃণমূলে যোগ দিলেন। হ্যাঁ, তৃণমূলে যোগ দিলেন। মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও লড়াইয়ের পাশে থাকার অঙ্গিকার করলেন। দল প্রার্থী করলে প্রার্থী হতে চান, এমনটাও বললেন।

susanto

মানুষের স্মৃতি বড় দুর্বল। রোজ এত ঘটনা ঘটছে, চোদ্দ দিন আগের ঘটনাই মনে থাকে না, এ তো চোদ্দ বছর আগের কথা। তাছাড়া, তখন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সেই দাপটও ছিল না। দূরদর্শনের বাইরে খাসখবর, আর মাঝে মাঝে সিটিভিএন বা ই টিভির বুলেটিন। তাদের কাছে সেই ফুটেজ আছে কিনা, কে জানে!

আমার স্মৃতিতে এখনও এতটা মরচে পড়েনি। পরিষ্কার মনে পড়ছে সেই বিকেলের কথা। প্রেস ক্লাবে হাজির স্বয়ং মমতা ব্যানার্জি ও তৃণমূলের বেশ কিছু শীর্ষ নেতা। অন্য জগতের কিছু লোকজন। এবং আপনি। বিশ্বাস করুন, কোনও ভুল হচ্ছে না। মাননীয় সুশান্তবাবু, সৎসাহস থাকলে এই তথ্যটাকে অস্বীকার করুন। জোরের সঙ্গে বলুন, আপনি কখনও তৃণমূলে যোগ দেননি। এই সাংবাদিকের চ্যালেঞ্জটাকে গ্রহণ করুন। আশা করি, সেই প্রমাণ সংগ্রহ করতে দু’দিনের বেশি লাগবে না।

২০০১ বিধানসভায় আপনার প্রার্থী হওয়ারই কথা। হাওড়ার কোনও একটি কেন্দ্রে আপনি দাঁড়াচ্ছেন, এরকম গুঞ্জন মাঝে মাঝেই নানা কাগজে বেরোতো। ২০০৯ লোকসভা ও ২০১১ –এর বিধানসভার আগেও আপনার নাম ভেসে উঠেছিল। যে কোনও কারণেই হোক, টিকিট পাননি। তাই একুশে জুলাই কমিশন গড়ে আপনাকে পুনর্বাসন দেওয়া হল। ভোটের আগে অনেকের নামই ভেসে ওঠে। তাই আপনার নাম ভেসে উঠল বলেই আপনি তৃণমূল, এমন সরলীকরণ না করাই ভাল। কিন্তু চোদ্দ বছর আগের সেই বিকেলটা কি আপনি অস্বীকার করতে পারবেন ? সেদিন তৃণমূলে যোগ দেওয়ার ঘটনা অস্বীকার করতে পারবেন ? হতেই পারে,, তখন যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন, এমন কোনও বিবৃতি বা প্রমাণ কি দেখাতে পারবেন ? যোগ যখন দিয়েছিলেন, সম্পর্ক ছিন্ন যখন হয়নি, তখন আপনাকে তৃণমূলি বললে কি খুব অন্যায় হবে ?

অবসর নেওয়ার পর অনেকেই তৃণমূলে নাম লিখিয়েছেন। এর মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। আপনিও তৃণমূলে যোগ দিতেই পারেন। কিন্তু তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর আপনাকে ‘নিরপেক্ষ’ বলি কী করে ? আপনার নেতৃত্বে গড়া কমিশনকে ‘বিচার বিভাগীয় কমিশন’ই বা বলি কী করে ?

এমন কমিশনের যা রিপোর্ট দেওয়ার কথা, তাই দেওয়া হয়েছে। একুশে জুলাইয়ের ঘটনা দুখঃজনক, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাই বলে একেবারে জালিয়ানওয়ালাবাগের সঙ্গে তুলনা ? চাটুকারিতার একটা অন্তত সীমা রাখুন। নিজেকে এতখানি চাটুকার প্রমাণ করা কি খুব জরুরি ছিল! মমতা ব্যানার্জিকে ডাকার সাহস যে আপনার হবে না, সেটা জানাই ছিল। আপনি তো বিচারক ছিলেন, একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন তো। তিনশো জনের সাক্ষী নিলেন। একবারও মনে হল না, যাঁর ডাকে ও যাঁর নেতৃত্বে এই হিংসাত্মক আন্দোলন, তাঁকে অন্তত ডাকা জরুরি! অন্তত লোকদেখানো বিচারের জন্যও জরুরি! গুলি চালানো ‘অন্যায়, বেআইনি, অসাংবিধানিক’ সব না হয় মেনে নিলাম। সেই সঙ্গে সেই আন্দোলনকে ‘নায্য’ বলে দিলেন! এতখানি দায় নেওয়া কি খুব জরুরি ছিল ? মহাকরণ ঘেরাও হবে। প্রকাশ্যে গায়ের জোরে মহাকরণ দখল করার ডাক দেওয়া হচ্ছে, অনেকের হাতেই মারাত্মক অস্ত্র। অনবরত ঢিল, বোমা ধেয়ে আসছে পুলিশের দিকে। সেই সময়ের কাগজে চোখ বোলান। অন্তত ২১৫ জন পুলিশ কর্মী আহত হয়েছিলেন। এই আন্দোলনকে ‘যুক্তিপূর্ণ’ বলে দিলেন! কোথাও পুলিশি অনুমতি নেওয়া ছিল কিনা খতিয়েও দেখলেন না! অনেকেই পবিত্বার আবেগ নিয়ে এসেছিলেন। এত মানুষের মৃত্যু সবাইকেই ব্যথিত করে। কিন্তু গায়ের জোরে মহাকরণ দখল নেওয়াটা কি গণতান্ত্রিক আন্দোলন ?  কমিশনের চেয়ারে বসে এই আন্কদোলনকে সার্থাটিফিকেট দেওয়া কি খুব জরুরি ছিল ? সিপিএমের কথা ছেড়ে দিন, তৎকালীন পুলিশের রিপোর্টও না হয় ছেড়ে দিন। কিন্তু খোদ মমতার দলের লোকেরাই এই আন্দোলনকে দায়িত্বজ্ঞানহীন ও হঠকারি বলেছিলেন। অথচ, সেই আন্দোলনকে জাস্টিফাই করার কী মরিয়া চেষ্টা!

ekushe july

আপনার কমিশনে সাক্ষী দিতে এসেছিলেন মদন মিত্র। তিনি সিপিএমকে, তৎকালীন সরকারকে অভিযুক্ত করবেন, খুব স্বাভাবিক কথা। কিন্তু তিনি কী অবলীলায় বলে দিলেন, পুলিশমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নির্দেশেই গুলি চলেছিল। হায় রে! এমন ইতিহাস-জ্ঞান! ঘটনা হচ্ছে, বুদ্ধবাবু পুলিশমন্ত্রী হয়েছিলেন তার তিন বছর পর, অর্থাৎ ১৯৯৬ এ। এমন ডাঁহা মিথ্যে একটি অভিযোগ করে গেলেন, তদন্তকে ভুল দিকে পরিচালনা করলেন। এই ডাঁহা মিথ্যের বিরুদ্ধে আপনার রিপোর্টে কোনও ধিক্কার নেই কেন ?

সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কমিশন। তার দায়বদ্ধতা সরকারের কাছে। সেই কমিশনের প্রধান কাজ সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করা। অথচ, সরকারের কাছে জমা পড়ার আগে আপনি ঘটা করে সাংবাদিক সম্মেলন করে তা জানিয়ে দিলেন। যদি বিচার বিভাগীয় কমিশন বলে তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া যায়, তার রিপোর্ট জমা পড়ার আগে এভাবে প্রকাশ্যে জানানো যায় ? এই এক্তিয়ার আপনার আছে তো ? কী আশ্চর্য, এটা নিয়েও না কাগজে, না টিভি চ্যানেলে, না সিপিএমের তরফ থেকে, কোনও প্রশ্ন উঠল না!

এরকম একটি অশ্বডিম্ব প্রসব করবেন, তা তো জানাই ছিল। কিন্তু তার জন্য তিন বছর লেগে গেল ? সত্যিই, আপনার প্রতি করুণা হচ্ছে। মাননীয় প্রাক্তন বিচারপতি, আপনার একশোবার রাজনীতি করার অধিকার আছে। পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিতে পারেন, তৃণমূলের সভায় দাঁড়িয়ে ভাষণ দিতে পারেন, টিভি-র টক শো-তে বকবক করতে পারেন। কিন্তু জনতার ট্যাক্সের টাকায় তিন বছর ধরে এই কমিশন চলছে। তিনবছর ধরে সম্ভবত কোটি টাকারও বেশি খরচ হয়েছে। সেই কমিশন নিয়ে যেটা করলেন, সেটাকে নির্লজ্জ প্রহসন ছাড়া আর কী বলা যায়!

বিচারপতিদের প্রতি এখনও মানুষের শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু আপনিও সেই নির্লজ্জ চাটুকারিতার রাস্তাই বেছে নিলেন ! মেরুদন্ড যে নেই, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু এতদিন বিচারপতি ছিলেন। আইনের সাধারণ জ্ঞানটুকু থাকবে, এটুকু তো আশা করা যায়। আপনার তো দেখছি, সেটুকুও নেই। এখন প্রশ্ন জাগে, বিচারপতি হতেও কি কোনও যোগ্যতা লাগে না!

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.