বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্তর গল্প:‌ অন্তিম চিঠি

‌অন্তিম চিঠি

বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত

আমার প্রাণের থেকে প্রিয়
আমার সোনা,

এখন গভীর রাত। সবাই ঘুমাচ্ছে। আমার চোখে ঘুম নেই। নির্জন ফাঁসির আসামির সেলের ছোট্ট কুঠুরিতে বসে আমি শুধু ভয়ে প্রহর গুনে যাচ্ছি। আর কিছুক্ষণ পরে এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে আমাকে চিরদিনের জন্য চলে যেতে হবে। কাল খুব ভোরে আমার ফাঁসি হবে। চোখ বুজলে আমি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি যমরাজের দূতেরা হাজির হয়ে আমাকে যমরাজের কাছে নিয়ে যাবার জন্য আমার চারিদিকে ঘোরাঘুরি করছে।

প্রচলিত নিয়ম অনুসারে ভোরবেলা আমাকে স্নান করিয়ে নতুন বস্ত্র পরিয়ে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হবে। আমার হাত দুটো বেঁধে কালো টুপিটায় মুখটা ঢেকে গলা পর্যন্ত পরিয়ে দেওয়া হবে। এই জেলের জেলারের নির্দেশ পাওয়া মাত্রই ফাঁসুড়ে ফাঁসির দড়িতে টান দেবে আর আমি মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে একটা সময়ে প্রাণহীন হয়ে দূরের আকাশে লক্ষ্য তারার মাঝে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাব।

তুমিই বল, আর কয়েক ঘন্টা পরে যাকে এই সুন্দর পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিতে হবে, তার চোখে কি কখনও ঘুম আসে? কিন্তু আমি তো মরতে চাইনি। আমি তো সুখেই বাঁচতে চেয়েছিলাম আমার স্বামী আর আমার একমাত্র খুব আদরের ছেলেকে নিয়ে। সুখ চাইলেই কি সুখ পাওয়া যায়? ভগবান বোধহয় আমার কপালে কোনদিনও সুখ–‌শান্তি কিছুই দিলেন না।

দেশ ভাগের পর সব ছেড়ে এক চরম অনিশ্চয়তায় এই দেশে এলাম। শুরু হল আমাদের দারিদ্রের জীবন। আর এক কঠিন সংগ্রাম। একদিন হারালাম বাবাকে। তারপরে যাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচেছিলাম, সেই মা আমাকে একদিন এই পৃথিবীতে একলা রেখে চলে গেলেন। এরপরে এক দুঃসম্পর্কের মামার ব্যবস্থায় আমার বিয়ে হল। কত আশা ছিল সুখে, শান্তিতে ঘর সংসার করব। ভগবানের এমনই লিখন, যার সঙ্গে আমার বিয়ে হল সে একটা মদ্যপ, লম্পট আর চরিত্রহীন। সুখ তো পেলামই না বরং পেলাম শুধু অত্যাচার, মারধর আর চরম লাঞ্ছনা। আজ আমার এই বৃদ্ধ বয়সের অন্তিম সময়ে অনেক কথাই মনে পড়ছে। একদিন আমাদের মধ্যে ঘর আলো করে এল খুব সুন্দর এক ফুটফুটে বাচ্চা। ওকে দেখে আনন্দে আমার বুকের মধ্যে জড়িয়ে আদর করে ‘‌সোনা’‌ বলে ডেকেছিলাম। কিন্তু এই আনন্দের মাঝে তার লম্পট বাবা বলল, এ আমার সন্তান নয়। তুমিই বল, কতখানি নিষ্ঠুর হলে সে তার নিজের সন্তানকে পর্যন্ত স্বীকার করে না! একদিন সেই ছেলে নিজের মায়ের কাছে না থেকে অন্যের কাছে মানুষ হতে লাগল। তার মা চাইল যাতে ছেলেটা ভাল করে খেয়ে পরে থাকতে পারে। আর যাতে ভালভাবে পড়াশুনা করে সত্যিকারের মানুষ হতে পারে। আজকে সেই ছেলে মস্তবড় মানুষ। সমাজের সবাই তাকে কত সম্মান করে। সরকারি দপ্তরে আজ সে একজন বিরাট বড় অফিসার। তার নির্দেশে আজ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন হয়। আজ তার বিশাল সরকারি বাংলো। কত দাসদাসী, আর্দালি তাকে দেখভাল করে। আর এই ছেলের বড় হওয়ার আনন্দে মনটা আমার ভরে ওঠে। আমার চোখে আনন্দের অশ্রু।

তুমি নিশ্চয় ভাবছ, আমি এতক্ষণ কার কথা বলছি! এবার আমি তোমাকে সব কথাই বলব। কারণ, আমার তো আর বলার সময় হবে না, কাল খুব ভোরেই আমার ফাঁসি হয়ে যাবে।

আজ বিকেলবেলা, যখন তুমি একটা জরুরি মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলে, তোমার বাবা, মা তোমাকে না জানিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আমি ঠিক করেছিলাম সত্যি কথাটা আমি কাউকেই এমনকি তোমাকেও বলব না। তোমার বাবা, মাকেও এই বলে দিব্বি করেছিলাম তোমাকে না বলার জন্য। আজ তোমার বাবা, মা আমাকে অনেক সান্ত্বনা দেয় আর বার বার অনুরোধ করে আর বোঝায় এবার যেন আমি নিজে তোমার প্রকৃত পরিচয়টা জানাই। আমি এই নিয়ে অনেক চিন্তা করি। তারপরে সাব্যস্ত করি, এতদিন যেটা গোপন ছিল আজ সেটা তোমাকে আমি বলে যেতে চাই।

হ্যাঁ, তুমি হচ্ছ আমারই নিজের পেটের সন্তান, এই জেলের জেলার। তোমার বাবার আমার প্রতি দিনের পর দিন অমানুষিক অত্যাচার, প্রায় প্রতিদিন রাতে বাজারের খারাপ মেয়েদের ঘরে এনে আমারই চোখের সামনে রাত কাটানো এটা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলাম না। একদিন রাত্রে গলা অব্দি মদ খেয়ে সঙ্গে মেয়ে মানুষ নিয়ে আমাকে বলল, কাল থেকে আমি যেন রাত্রিবেলা অন্য পুরুষের ঘরে গিয়ে রাত কাটিয়ে টাকা রোজগার করি। আমি প্রতিবাদ করায় আমাকে পায়ের জুতো খুলে বেধড়ক মারতে শুরু করল। সহ্যের বাঁধ ভেঙে আমি দিশেহারা হয়ে রান্নাঘর থেকে ধারালো বটিটা এনে মারলাম এক কোপ। এতদিনের আমার প্রতি অমানুষিক, পাশবিক অত্যাচারের পর্ব শেষ হল। দীর্ঘ সময় ধরে বিচারপর্ব চলার পর সব আদালতই একই রায় বহাল রাখলেন, ‘‌মৃত্যুদণ্ড’‌। বিধাতার এমনই বিধান, কাল ভোরে জেলার হিসাবে তোমার নির্দেশ পেয়ে জল্লাদ আমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে।

আমি জানি তুমি হয়তো অবাক হবে। আর অবাক হওয়ারই কথা। তুমি বিশ্বাস কর, তোমার বাবার চরিত্রের কথা আর আমাদের চরম দারিদ্র‌্যের, দুরবস্থার কথা ভেবে আর তুমি যাতে ভালভাবে মানুষ হতে পার, এসব বিবেচনা করেই আমি বাধ্য হয়েই তোমাকে আমার ছোটবেলার বন্ধু নিঃসন্তান শেফালির কাছে রেখে মানুষ করেছিলাম। নিজের শিশুপুত্র অন্যের কাছে থেকে বড় হওয়া, এ যে কত যন্ত্রণার একজন মায়ের কাছে, তা আমি প্রতিটি মুহূর্তে অনুভব করেছি। তবে আমি নির্মল আর শেফালির কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তারা তোমাকে নিজের ছেলের মতো মানুষ করে আজ এতবড় করেছে। তুমি আজ তাদের জন্যই সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত।

খুব ইচ্ছে ছিল তোমার সঙ্গে একটি বার কথা বলার, এই পৃথিবী থেকে চিরতরে চলে যাবার আগে তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করার। কিন্তু সে ইচ্ছে আমার এজন্মে আর পূরণ হল না। সবশেষে একটা অনুরোধ তোমাকে করে যাই। নির্মল আর শেফালিকে শ্রদ্ধা করো, ভালবেসো। তাদেরকে সবসময় সুখে শান্তিতে রেখো।
তুমি আর বৌমা আমার অনেক অনেক আদর, ভালবাসা আর প্রাণভরা আশীর্বাদ নিও। ভাল থেকো।

ইতি
অভাগিনী ‘‌মা’‌

পুনশ্চঃ মৃত্যুর আগে ফাঁসির আসামি হিসেবে আমার শেষ ইচ্ছে অনুসারে খাম বন্ধ করা এই চিঠিটা আমি তোমার লোকেদের হাতে দিয়ে বলে দিয়ে ছিলাম আমার মৃত্যুর পরেই যেন এটি তোমার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। আর একটা কথা, ছোটবেলায় বাবার থেকে শুনতাম, ‘‌গীতায়’‌ লেখা আছে, মানুষের দেহের মৃত্যু হয়, কিন্তু তার আত্মার মৃত্যু হয় না। তাই বলছি, আমি সবসময় তোমাদের সঙ্গেই থাকব। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে, তবে আমি যেন তোমাকেই ছেলে হিসেবেই পাই। আর আমার নিজের কাছে রেখে মনের মতো করে মানুষ করতে পারি। এই গভীর রাতে মন অস্থির থাকায় হয়তো গুছিয়ে চিঠিটা লিখতে পারলাম না। নিজের মতো করে গুছিয়ে নিও ….।
‌‌‌‌
‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.