‌রাবার স্টাম্প কি শুধুই খাড়্গে?‌

সিদ্ধার্থ গুপ্ত

জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি কে হতে চলেছেন?‌ এটা নিয়ে কোনও মহলেই তেমন কোনও সংশয় ছিল না। নির্বাচনের আবহ তৈরির পরই দেওয়াল লিখনটা স্পষ্টই ছিল। যত দিন গেছে, তা স্পষ্ট থেকে আরও স্পষ্টতর হয়েছে। কারণটাও সহজবোধ্য। কদিন যেতে না যেতেই বোঝা গেল, দশ জনপথের অলিখিত সমর্থন মল্লিকার্জুন খাড়্গের দিকেই। শশী থারুর দাঁড়িয়েছেন ঠিকই। কিন্তু তিনি থাকবেন নিষ্ফলের, হতাশের দলে। অবশ্য শশী নিজেও কি আশা করেছিলেন তিনি জিতবেন?‌ স্মার্ট শশী এতখানি আনস্মার্ট নিশ্চয় নন।

খাড়্গে যে প্রথম পছন্দ ছিলেন, এমনটা বলা যাবে না। শুরুর দিকে অশোক গেহলটকেই সভাপতি হিসেবে ভাবা হয়েছি। তিনি দীর্ঘদিনের প্রবীণ রাজনীতিক। দশকের পর দশক ধরে গান্ধী পরিবারের একান্ত অনুগত। কিন্তু মুশকিলটা হল, তিনি ধরেই নিলেন কংগ্রেস সভাপতি হলে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হবে। অনুগত কাউকে বসাতে পারলে হয়ত মেনেও নিতেন। কিন্তু তিনি ছাড়লেই সেই কুর্সিতে বসবেন শচীন পাইলট। তাহলে রাজস্থানের রাজনীতিতে তাঁর আর কোনও কর্তৃত্ব থাকবে না। এটা বুঝে নিজের অনুগতদের লেলিয়ে দিলেন শচীনের বিরুদ্ধে। ফল যা হওয়ার, তাই হল। সোনিয়া গান্ধী ঠিক করেই ফেললেন, এমন লোককে জাতীয় সভাপতি করা যায় না। তখন দৌড়ে দ্বিতীয় নাম খাড়্গে।

তিনিও অনুগত। মোটামুটি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি। তাঁর জন্য কখনই অস্বস্তিতে পড়তে হবে না। লোকসভায় তিনিই ছিলেন দলনেতা। লোকসভায় হেরে যাওয়ার পর তাঁকে আনা হল রাজ্যসভায়। সেখানেও এই দক্ষিণী পিছড়ে বর্গের নেতাকেই দলনেতা করা হয়েছে।

গান্ধী পরিবারের সুবিধাটা কোথায়?‌ এতদিন বারবার এটাই অভিযোগ উঠত, তাঁরা ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন। ফলে, ব্যর্থতার সব দায় তাঁদেরই নিতে হত। তাছাড়া, প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপির আক্রমণের নিশানাই থাকতেন রাহুল গান্ধী। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই পরিবারতন্ত্রের কথা টেনে আনা হত। নিজের ব্যর্থতাকে ঢাকতে গিয়ে এমনকী বারবার নেহরুকেও টেনে আনতেন প্রধানমন্ত্রী। রাহুলের দোষ চাপাতেন নেহরুর ঘাড়ে। আর নেহরুকে আক্রমণ করে সেই দায় চাপাতেন রাহুলের ঘাড়ে। এবার সেই অস্ত্রটা কিছুটা ভোঁতা হয়ে গেল। কথায় কথায় আর গান্ধী পরিবারকে আক্রমণ শানাতে পারবেন না। রাহুলও বলতে পারবেন, তিনি আর নিয়ন্ত্রণ করছেন না। নির্বাচিত সভাপতিই দল চালাচ্ছেন। তিনি যা নির্দেশ দেবেন, আমি সেটাই পালন করব। আবার যেদিন রাহুলের সভাপতি হতে ইচ্ছে হবে, একবার ইচ্ছেপ্রকাশ করলেই হবে। ভরত যেভাবে রামের পাদুকা সিংহাসনের রেখে রাজ্য চালাতেন, খাড়্গেও অনেকটা সেভাবেই কংগ্রেস চালাবেন।

নির্বাচনের আগে থেকেই জোরাল প্রচার, তিনি গান্ধী পরিবারের রাবার স্ট্যাম্প হতে চলেছেন। কথাটা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। সোনিয়া বা রাহুল কংগ্রেস সভাপতি হতে চাইলেন না। তাই বলে কংগ্রেসের রাশ তাঁদের হাতে থাকবে না, এমনটা যাঁরা আশা করেন, তাঁরা কংগ্রেস রাজনীতি সম্পর্কে কতটুকু ওয়াকিবহাল!‌ কংগ্রেসের যেটা সবথেকে বড় বোঝা, সেটাই আবার সবথেকে বড় সম্পদ। গান্ধী পরিবারের নিয়ন্ত্রণ আছে বলেই কংগ্রেস এখনও অনেকটাই ঐক্যবদ্ধ আছে। নইলে, আরও অরাজকতা তৈরি হবে। কেউ কাউকে মানবেন না। কেউ কারও কথাই শুনবেন না। নরসীমা রাও বা সীতারাম কেশরির সময়ে কংগ্রেসের ডামাডোলের কথা মনে নেই?‌ নরসীমা একদিকে প্রধানমন্ত্রী, অন্যদিকে কংগ্রেস সভাপতি। তারপরেও কখনও শরদ পাওয়ার, কখনও অর্জুন সিং, কখনও রাজেশ পাইলট রোজ কোথাও না কোথাও বিদ্রোহ করেই চলেছেন। এখন তো ক্ষমতায় নেই। ফলে, নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব মানার প্রশ্নই নেই। তবু দশ জনপথ পাশে থাকলে রাজ্যস্তরের নেতারা একটু সমীহ করবেন। নইলে সেটুকুও থাকবে না।

তাই যদি রাবার স্ট্যাম্প হয়ে থাকতেই হয়, সেটা খাড়্গের পক্ষেই সুবিধা। কারণ, তাঁর না আছে বিরাট জনভিত্তি, না আছে বিরাট বাগ্মীতা। না আছে প্রবল উচ্চাকাঙ্খা। ফলে, তাঁকে ছায়া হয়েই থাকতে হবে। শাসক দল থেকে কটাক্ষ আসবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাবার স্ট্যাম্প প্রথা কি বিজেপিতে নেই?‌ বরং একটু বেশিই আছে। ধরা যাক, এখন জাতীয় সভাপতির নাম জেপি নাড্ডা। প্রশাসনিক বিষয় তো ছেড়েই দিন, সাংগঠনিক কোনও ছোটখাটো বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাঁর কোনও এক্তিয়ার আছে?‌ তাঁকে পদে পদে নরেন্দ্র মোদির মর্জি বুঝেই চলতে হয়। এমনকী সিকিম বা মণিপুরের মতো ছোট রাজ্যেও কারা সভাপতি হবেন বা কারা লোকসভার টিকিট পাবেন, সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার তিনি কেউ নন।

শুধু সাংগঠনিক সভাপতি কেন, একেবারে দেশের রাষ্ট্রপতির কথায় আসুন। কে মনোনয়ন পেতে পারেন, আগেরবার কেউ ঘুণাক্ষরে টের পেয়েছিলেন?‌ বিজেপি নেতারাও টিভিতেই প্রথম রামনাথ কোবিন্দের নাম শুনেছিলেন। ক্যাবিনেট বলুন বা কার্যকরী সমিতি, সবাই ছিলেন অন্ধকারে। এবার দ্রৌপদী মুর্মুর নামটা একটু আগে ভেসে উঠলেও এই সিদ্ধান্তের পেছনে দলের সাংসদদের বা মন্ত্রীদের কোনও ভূমিকা ছিল?‌ কোন স্তরে আলোচনা বা মতামত নেওয়া হয়েছে?‌ কোথাও ভিন্নমতের ন্যূনতম পরিসর ছিল?‌ মোদ্দা কথা, একজন যা চেয়েছেন, তাই হয়েছে। আর রাষ্ট্রপতি যে কতটা জোহুজুর হতে পারেন, তা রামনাথ কোবিন্দ নিজেও বেশ কয়েকবার বুঝিয়ে দিয়েছেন। মহারাষ্ট্রে সরকার গড়ার সময়টার কথা মনে করুন। হঠাৎ, রাত দুটোর সময় রাষ্ট্রপতি শাসন উঠে গেল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভোর ছটায় মুখ্যমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ হয়ে গেল। ভারতের রাজনীতিতে এমন ঘটনা কখনও ঘটেছে?‌ রাষ্ট্রপতিকে অনেক সময়ই সরকারের মর্জিমাফিক চলতে হয়। সেটা অনেকটা সাংবিধানিক দায়বদ্ধতাও। কিন্তু তাই বলে রাত আড়াইটেয় বিজ্ঞপ্তি জারি আর সকাল ছটায় শপথ!‌ রাষ্ট্রপতি পদের গরিমাকে এতখানি হাস্যকর আর কেউ করেছিলেন!‌ কারও নির্দেশ ছাড়াই এমন আজগুবি সিদ্ধান্ত হয়েছে?‌

মোদ্দা কথাটা হল, খাড়্গেকে রাবার স্ট্যাম্প হয়েই থাকতে হবে। যেমনভাবে রাষ্ট্রপতিকে বা বিজেপি সভাপতিকেও রাবার স্ট্যাম্প হয়ে থাকতে হয়। ‌‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.