সুগত রায়মজুমদার
৬০–এর দশকের শেষদিক থেকে আজ একবিংশ শতাব্দীতেও রিগিং ও ছাপ্পা ভোটে জেতা একই জিনিস চলছে পরম্পরাভাবে। সারা দেশে একমাত্র বাংলায় এই ঘটনা ঘটেই চলেছে। এর উৎপত্তি য়াটের দশকের শেষদিকে যুক্তফ্রন্ট আমল থেকে। যদিও সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঢোঁড়াইচরিত মানস’–এ আমরা দেখেছি, কংগ্রেস ভলান্টিয়াররা ঢোঁড়াইকে দিয়ে ছাপ্পা ভোট দিয়েছিলেন। যাইহোক, এখন কিন্তু বাংলার শাসকদলও রিগিং ছাড়া জেতার সাহসই পায় না। এরাও বুঝছে না, মানুষ অতীত ও বর্তমানের দলগুলিকে একই পর্যায়ে রাখছে। ৬০–এর দশকের প্রথম দিকে বাংলায় কংগ্রেস আমলে মানুষ কোনও দিন রিগিং বলতে কিছুই জানত না। তার পর যুক্তফ্রন্ট আসার সময় থেকেই এই ছাপ্পা ভোটের শুরু। সেটাই এখন পরম্পরা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭২ সালে কংগ্রেস বন্দুক ও বোমার সাহায্যে ভোট লুট করেছিল। মানুষ সেটা ঠিকমতো নিতে পারেনি। এজন্য ১৯৭৭ সালে সিপিএম এই রাজ্যে এককভাবেই আসে শাসনে। এর পর মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নেতৃত্বেই পরবর্তীকালে এই রিগিং চরম আকার নেয়। ভোটার লিস্টে কারচুপি থেকে শুরু করে আরও কিছু সায়েন্টিফিক রিগিং করে সিপিএম দেশে নজির সৃষ্টি করেছিল। জানতেন, সেই সময় রাজ্যে অন্য কোনও দলের ক্ষমতা ছিল না তাঁর দলের বিরুদ্ধে লড়ার। তা সত্ত্বেও তাঁর দলের নিজেদের ওপর ভরসা ছিল না। এই রিগিংকেই ভরসা করে দীর্ঘদিন সিপিএম অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। জ্যোতিবাবু জানতেন, কোনও শক্তিই তাঁর দলকে ছিটকে দিতে পারবে না। আজও একই অবস্থা। এই মুহূর্তে বাংলায় মমতা ব্যানার্জির দল তৃণমূলও অপ্রতিরোধ্য। তিনিও জানেন, সিপিএম, কংগ্রেস ও বিজেপি তাঁর শক্তির বিন্দুমাত্র। তা সত্ত্বেও তিনি কিছু নেতাকে দায়িত্ব দিয়ে বাংলাকে বিরোধীশূন্য রাখতে চান। মমতা ব্যানার্জি বর্তমানে ক্ষমতার চূড়ায় আছেন। কিন্তু এই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন চলতে পারে না। কোনও রাজ্যেই এটা দীর্ঘদিন চলতে পারে না। সাধারণ মানুষ মেনে নেবে না। বিরোধীদের যদি কোনও অস্তিত্ব না–ই থাকে, তা হলে সেই রাজ্যে গণতন্ত্র থাকবে কোথা থেকে? এই ভুলটা জ্যোতিবাবুও অনুমান করতে পারেননি। সম্প্রতি রাজ্যে পুরসভা নির্বাচনে বিরোধীরা সব মিলিয়ে ২৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এটা গণতন্ত্রের প্রতি খুবই খারাপ নিদর্শন। এই জিনিস সিপিএমের শাসনেও হত। তখন মমতা ব্যানার্জি অনেক আন্দোলন করেছেন। এখন মমতা ব্যানার্জিও সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিরোধীশূন্য করতে চাইছেন। ক্ষমতার চূড়ায় থাকাকালীন পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও পরিবেশ তিনিও অগ্রাহ্য করতে শুরু করেন। রাজ্যের বেশ কিছু জায়গায় তাঁর দলের কর্মীদের স্বৈরাচারিতায় সাধারণ মানুষ দিন দিন বিরক্ত হচ্ছেন। এটা মমতা ব্যানার্জির নজরেও আসছে না। যদিও তিনি সারা রাজ্য পরিদর্শন করেন। তবু তাঁর চোখে পড়ে না। তিনি এখন ক্ষমতার চূড়ায়। ক্ষমতাই তাঁকে মানবদরদী অবস্থান থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। সম্প্রতি বাংলায় বন্যায় জেলাগুলির যা অবস্থা, তার প্রতি কোনও আগ্রহ দেখছি না। এখন জল কমার সময় তিনি পরিদর্শন করতে বেরোচ্ছেন। প্রশাসনও একেবারে সক্রিয় নয়। অতীতে তিনি সব সময়ই তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেন। এজন্যই তাঁর এত জনপ্রিয়তা। কোনও শক্তিকেই পরোয়া করতেন না। ক্ষমতার চূড়ায় এসে তাঁর মধ্যেও আসতে আরম্ভ করেছে আত্মসন্তুষ্টি।
মমতা ব্যানার্জি উন্নয়নের বেশ কিছু করেছেন, এটা ঘটনা। যা সিপিএমের ৩৪ বছরেও হয়নি। তিনি ক্ষমতায় এসেই বলেছিলেন, ‘ওরা যা ৩৪ বছরে করেনি, আমি তা ৫ বছরে করে দেখাব।’ সেটা তিনি করে দেখিয়েছেন। কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, রেশনে ২ টাকার চালও দিয়ে মানুষের বিরাট উপকার করেছেন। কিন্তু শুধু উন্নয়নই মানুষের চাহিদার সবকিছু নয়। মানুষ চায় কর্মসংস্থান। এ রাজ্যে যুবক–যুবতীরা ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার হয়েও সমাজে সেরকম মর্যাদা পাচ্ছেন না। তারা চলে যাচ্ছে দেশের ভিন রাজ্যে। রাজ্যে কোনও চাকরি নেই। এত পয়সা খরচ করে যদি মাসিক মাইনে এত কম হয়, তা হলে যাবে না না তো কী করবে। মমতা সিঙ্গুর নিয়ে যে জমি নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন, সেটা সঠিক। তিনি জোর করে জমি কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই জমি নীতি কেন্দ্রের সঙ্গে এখনও না পাল্টাতে পারলে রাজ্যে কোনও চাকরি তৈরি হবে না। শিল্পপতিরা নিজে থেকে কখনই চাষীদের বুঝিয়ে জমি নেবেন না। সরকারকেই ল্যাম্ড ব্যাঙ্ক তৈরি করে জমি দিতে হবে শিল্পপতিদের। এ ছাড়াও নোটবন্দীর ফলে রাজ্যে সব রকম ব্যবসায় আরও দুরবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়াও সিন্ডিকেট পুরোপুরি বিলোপ করতে হবে। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ফলে সব বড় কোম্পানিই ধুঁকছে অর্থের অভাবে। কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। সম্প্রতি রাজ্যে যে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে কোনও পরিকল্পনা দেখছি না রাজ্য সরকারের। তিনি ব্যস্ত উপনির্বাচন নিয়ে। নদীগুলি ও বাঁধ প্রকল্পগুলিতে যদি ড্রেজিং না হয় দীর্ঘদিন ধরে, তা হলে এই অবস্থা হবেই। সেজন্য তাঁকে এই ব্যাপারগুলি নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে বসে একটা আশার আলো দেখাতে হবে।
জ্যোতিবাবু একসময় রাজ্যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে দেশে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি যখন একবার সুযোগ পেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার, দলের সম্পাদক প্রকাশ কারাত তাঁকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করায় তিনি বলেছিলেন, ‘এটা ঐতিহাসিক ভুল’। সেরকমই মমতা ব্যানার্জিও এখন ক্ষমতার চূড়ায় পৌঁছে আরও বেশি ক্ষমতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। তাঁরও হয়তো ভাবনা, আমি দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছতেই পারি। জ্যোতিবাবুকে ভাগ্যিস দূরদর্শী প্রকাশ কারাত আটকাতে পেরেছিলেন। সেজন্য আরও কিছুদিন দলটি রাজ্যে শাসনক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল। সেই সুযোগ যদি মমতার এসে যায়, মমতা কী করবেন, এখনও আমরা জানি না। তবে এটুকু বলা যায়, সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস ও বিজেপি সবচেয়ে প্রভাবশালী দল। এই দুটি দল যে কোনও সময় কাউকে অনেক ওপরে নিয়ে যেতে পারে। আবার খুব তাড়াতাড়ি রাজনীতি থেকে ছিটকেও দিতে পারে। এর উদাহরণ চরণ সিং, ভি পি সিং, দেবেগৌড়ারা। মমতা ব্যানার্জির দল তৃণমূল কংগ্রেস ২০১৯–এর লোকসভা নির্বাচনে খুব বেশি হলে ৪২টি আসনই পেতে পারে। লোকসভা নির্বাচন ৫৪২টি আসনের মধ্যে এই সংখ্যাটা খুবই নগণ্য। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে গেলে ২৭২টি আসন পেতে হবে কোনও দল বা জোটকে। ৪২টি আসন পেয়ে কি দেশের শীর্ষে বসে দেশ চালানো সম্ভব! সুতরাং নিজ দলের ক্ষমতা বুঝেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। ক্ষমতার চূড়ায় ওঠা যেমন কঠিন কাজ, তেমনই নিচে নামতেও বেশি সময় লাগে না। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ২০০৬ সালে সিপিএম বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনে ২৩৫টি আসন পেয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মাথা ঘুরে গিয়েছিল। বলেছিলেন, ‘আমরা ২৩৫, ওরা ৩৫’। ভেবেছিলেন, আমি এখন রাজ্যের মানুষকে যা বলব, তাই গ্রহণযোগ্য হবে মানুষের কাছে। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। সকলের অলক্ষ্যে কোথা থেকে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলন করে মমতা ব্যানার্জি উঠে আসলেন, এটা তিনি অনুমান করতে পারেননি। এজন্যই তাঁর পতন হয়েছিল। এখন সিপিএম একটা ছোট দলের মতো হয়েই দাঁড়িয়েছে। যে দল দীর্ঘ ৩৪ বছর দোর্দণ্ডপ্রতাপে দেখিয়েছিল, তাদের দল এখন ভঙ্গুর। বুদ্ধবাবুকেও ধাক্কা খেতে হয়েছিল। এই আত্মসন্তুষ্টি তৃণমূলের মধ্যেও চলে আসছে। তারাও এখন ভরসা করে না সাধারণ মানুষকে। সেজন্যই যে নির্বাচনই হোক না কেন, গণতন্ত্রে বিশ্বাস রাখা ভুলে একচেটিয়া ক্ষমতার দিকেই এগোচ্ছে। সেই পরম্পরা এখনও চলছে। ভিন রাজ্যেও সকলেই জানেন, বাংলায় নির্বাচন ৭–৮ ভাগে হয়। কারণ এখানে গণতন্ত্র নেই। ক্ষমতার নেশায় শাসকদল যারাই হোক না কেন, তারা একই পথ রিগিং ও ছাপ্পাকে অবলন্বন করবে।
মমতার এখন রাজনীতি ভুলে রাজ্যের বন্যা কবলিত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোই শ্রেয়। টিভিতে চোখে দেখা যায় না মানুষের এই দুরবস্থা। তিনি দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েই জনপ্রিয় হয়েছেন। এতেই তাঁর পথ আরও মসৃণ হবে। ভোটে রিগিং পরম্পরা দূর করে নিজের কাজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। তাঁর উন্নয়নের কাজই তাঁকে ফিরিয়ে আনবে এবং কর্মসংস্থান তৈরির দিকে মন দিয়ে এবং রাজ্যে গণতন্ত্র বজায় থাকলে মানুষ বারবার মমতাকেই ফিরিয়ে আনবে।