শান্তি ফেরাতে গেলে সদিচ্ছা চাই। যেটা রাজ্য সরকারের নেই। বিনয় তামাংদের উস্কানি দিয়ে মোর্চায় বিভাজন আনা যায়, পাহাড়ে শান্তি আনা যায় না। প্রতিটি পদক্ষেপেই অস্বচ্ছ্বতা। তাই এই বৈঠকও প্রহসন হয়ে উঠবে। লিখেছেন স্বরূপ গোস্বামী।।
আজ পাহাড়ে শান্তি বৈঠক। কিন্তু এই বৈঠকের পর শান্তি কি ফিরবে? নিদেনপক্ষে, শান্তি ফেরানোর প্রক্রিয়া কি শুরু হবে? তেমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বরং, পাহাড় আরও অশান্ত হয়ে উঠলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
সরকার কি সত্যিই শান্তি ফেরাতে চায়? সত্যিই কি সদিচ্ছা আছে? সরকারের আচার–আচরণে তা মনে হচ্ছে না। বারবার দাবি উঠছিল সর্বদলীয় বৈঠকের। তৃণমূল ছাড়া এই রাজ্যে প্রধান তিনটি শক্তি হল বাম, কংগ্রেস, বিজেপি। অথচ, এই আলোচনায় তারাই নেই। ডাকা হল শুধু পাহাড়ের দলগুলিকে। অথচ, সেই তালিকায় তৃণমূল ঢুকে পড়ল। হ্যাঁ, শেষ পুরনির্বাচনে পাহাড়ে তৃণমূল লড়াই করেছে। দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে উঠেও এসেছে। সেদিক থেকে তৃণমূল থাকতেই পারে। কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন কেন, পাহাড়ের সাংসদ এখনও বিজেপির। তিনি মোর্চার সমর্থনে জিতলেও সরকারিভাবে তিনি বিজেপিরই নির্বাচিত প্রতিনিধি। যে দলের সাংসদ, সেই দলই ডাক পেল না। পাহাড়ে অশান্তি হলে তার রেশ পড়ে শিলিগুড়িতেও। সেই শহরের মেয়র ও বিধায়ক অশোক ভট্টাচার্য। তাঁকেও ডাকার দরকার মনে হয়নি। দার্জিলিং জেলাতেই পাহাড়–লাগোয়া আরও একটি বিধানসভা মাটিগাড়া–নকশালবাড়ি। সেখানকার বিধায়ক কংগ্রেসের শঙ্কর মালাকার। তিনিও ডাক পাননি। অর্থাৎ, এখানেও সেই একপেশে মনোভাব। মুখ্যমন্ত্রীর যা ইচ্ছে হয়েছে, তাই করেছেন।
মোর্চার প্রতিনিধি কে? বিনয় তামাং। মোর্চাকে ভেঙে এতদিন বিভিন্ন বোর্ড ও পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। সেটা ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। কারণ, অধিকাংশ উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যানই সরে দাঁড়িয়েছেন। সরাসরি নতুন রাজ্যের আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন (বা, বাধ্য হয়েছেন)। মুখ্যমন্ত্রী যদি পাহাড়ে বিভাজনের নোঙরা রাজনীতি না করতেন, হয়ত এমন পরিস্থিতি তৈরি হত না। মানুষ ভুল থেকে শিক্ষা নেয়। কিন্তু রাজ্য সরকার ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে, এমনটাও মনে হচ্ছে না। এখনও সেই বিভাজনের রাজনীতিই করা হচ্ছে। মোর্চার মধ্যে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা। বিনয় তামাংকে মোর্চা নেতা বলে তুলে ধরার চেষ্টা। গুরুং আর বিনয় তামাংয়ের ফাটল এখন প্রকাশ্যেই চলে এসেছে। অর্থাৎ, মোর্চার সুর বা দাবি কী হবে, সেটাও মুখ্যমন্ত্রীই যেন ঠিক করে দেবেন।
এই বৈঠকের ফল কী হবে? পাহাড়ের লোকেদের কথা সেভাবে শোনাই হবে না। মুখ্যমন্ত্রীই একতরফা বলে যাবেন। কোনও বিরুদ্ধ মত, কোনও সমালোচনা শোনার অভ্যেস তাঁর নেই। আবার নিজের মতকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। আবার উস্কানিমূলক মতব্য করবেন। বৈঠকে হাজির হওয়া নেতারা মেনে নিলেও পাহাড়ের নেতারা এইসব সমাধানসূত্র মানবেন না। আবার হয়ত অশান্তি শুরু হবে।
বিনয় তামাংকে যতই মোর্চা নেতা বলে তুলে ধরা হোক, যতই তাঁকে দল ভাঙানোর কাজে লাগানো হোক, প্রভাবে তিনি বিমল গুরুংয়ের একশো মাইলের মধ্যেও নেই। বিমল গুরুং পাশে না থাকলে বিনয় তামাংরা কেউ নন, ঠিক যেমন মমতা ব্যানার্জি পাশে না থাকলে ববি হাকিম বা শোভন চ্যাটার্জিরাও কেউ নন। মাঝখান থেকে বিনয় তামাং হয়ত আর পাহাড়ে উঠতেই পারবেন না। এমনকী যদি তাঁর ওপর হামলা হয়, তাও অবাক হওয়ার কিছু নেই। গুরুংরা যথারীতি বলবেন, এর সঙ্গে মোর্চা যুক্ত নয়। পাহাড়ের মানুষের জনরোষে এই ঘটনা ঘটেছে।
বিনয় তামাংদের যেভাবে উস্কানি দেওয়া হয়েছে, তাঁর কোনও অঘটন ঘটলে সেই দায় রাজ্য সরকার নেবে তো? একটা পদক্ষেপ নিলে পরের পরিস্থিতিগুলো কেমন হতে পারে, এই দূরদর্শিতা না থাকলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে, তাই হবেও। তাই শান্তি বৈঠক যদি করতে হয়, তবে শান্তির মানসিকতা দরকার। সদিচ্ছা দরকার। একদিকে, বিভাজনের ছুরি, অন্যদিকে শান্তি আলোচনা, দুটো একসঙ্গে চলতে পারে না। সেই বৈঠকও প্রহসন হয়ে দাঁড়ায়।