কড়া বার্তাটা সেদিন দেওয়া বেশি জরুরি ছিল

স্বরূপ গোস্বামী

হঠাৎ প্রশাসন নাকি খুব সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আমফানেক ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি রুখতে শাসকদল নাকি দারুণ সক্রিয়। কাউকে দল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। কাউকে ধমকে পদত্যাগ করানো হচ্ছে। আর এতেই ধন্য ধন্য রব উঠছে। মুখ্যমন্ত্রী নাকি দুর্নীতি রুখতে দারুণ কঠোর।

ভালর ভানটাও ভাল। তাই, সরকার যদি একটি দুটি ক্ষেত্রেও পদক্ষেপ নিয়ে থাকে, সেটাকেও সাধুবাদ জানাতেই হয়। এটা দেখে যদি কারও টনক নড়ে। কিন্তু এই দুর্নীতির শিকড় অনেকটাই গভীরে। গলদটা একেবারে গোড়াতেই থেকে গেছে। তাই এত সহজে নির্মূল হওয়ার নয়।

mamata9

ঠিক দু বছর আগে। এমনই সময় হয়েছিল পঞ্চায়েত ভোট। মানুষের স্মৃতি বড়ই দুর্বল। সেই ভোট কী প্রহসনে পরিণত হয়েছিল, আমরা সবাই এতদিনে দিব্যি ভুলে গেছি। তাছাড়া, কলকাতা নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া দেখে বাংলার ছবি কতটুকুই বা বোঝা যায়!‌ অন্তত ৩৪ শতাংশ আসনে বিরোধীরা মনোনয়ন দিতেই পারেননি। বাকি অন্তত তিরিশ শতাংশ আসনে মনোনয়ন দিলেও পরে লিফলেট ছড়িয়ে তুলে নিতে হয়েছে বা শাসক দলের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। কোথাও কোথাও প্রার্থীকে বা তাঁর বাড়ির লোককে কিডন্যাপ করা হয়েছে। আর যেসব জায়গায় তথাকথিত ভোট হয়েছে, তার চেহারাটাও ভয়ঙ্কর। কোথাও সকাল সাতটাতেই ভোট হয়ে গেছে। আবার কোথাও সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। রাতেই অপারেশন শেষ। গণনাতেও ছাড় নেই। সেখানেও চলেছে ছাপ্পা। যদি কোথাও বিরোধীরা জিতেছেন, সেখানেও রেহাই নেই। জোর করে তাঁকে আনা হয়েছে নিজেদের কব্জায়। মোদ্দা কথা, কুড়ি শতাংশ মানুষও নিজের ভোটটা দিতে পারেননি। কলকাতার মিডিয়ায় এগুলো প্রতিফলিত হয় না। প্রথমত, মেরুদণ্ড নামক জিনিসটি মূলস্রোত মিডিয়া অনেক আগেই প্রশাসনের সিন্দুকে জমা রেখেছে। দ্বিতীয়ত, গ্রাম বাংলার প্রশাসন ও বাস্তবতা সম্পর্কে সবজান্তা মিডিয়া কর্তাদের ন্যূনতম ধারণাটুকুও নেই।

এতবড় রাজ্য। বিক্ষিপ্তভাবে দুটো একটা জায়গায় এমনটা হতেই পারত। কিন্তু ঘটনা হল, রাজ্যের কোনও ব্লকই এই সন্ত্রাসের আওতার বাইরে ছিল না। ব্লক প্রশাসন, জেলা প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে এই সন্ত্রাস হয়েছে। এবং ‘‌অনুপ্রেরণা’‌ ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না। সেদিন গলা ফুলিয়ে তিনি বলেছিলেন কুৎসা। বলেছিলেন, বিরোধীদের প্রার্থী দেওয়া লোক নেই।

সেদিনই এই লাগামহীন গাজোয়ারিতে সেদিন সিলমোহর দেওয়া হয়েছিল। গায়ের জোরে পঞ্চায়েত দখল করলে তার পরিনাম কী হতে পারে, সেদিন বোঝেননি?‌ যাঁরা লাঠি নিয়ে অন্যকে প্রার্থী দিতেই দিল না, তাদের কাছে স্বচ্ছ প্রশাসনে প্রত্যাশা করেন কীভাবে?‌ যারা ডাকাতি করে জেতে, তারা জেতার পরেও ডাকাতিই করে। সেদিন সেই দুর্বৃত্তরা উপর তলা থেকে কোনও ধমক বা তিরষ্কার পায়নি। পিঠ চাপড়ানিই পেয়েছিল। এইসব দুর্বৃত্তরা কোনও দলের হয় না। নিশ্চিত থাকুন, এরা সবাই একদিন সুট সুট করে কেটে পড়বে। জার্সি বদলেও একই অপকর্ম করবে। কারণ, যারা এদের নেবে, তারাও সব অপকর্মের বায়োডাটা জেনেই নেবে। এরাও বুঝবে, গা জোয়ারিটাই এদের অধিকার। সেটার জন্যই এদের এত কদর।

পঞ্চায়েত ভোটের আগে যদি জেলার নেতাদের কড়া বার্তা দিতেন, আজ এই দিন দেখতে হত না। সেদিন যদি বলতেন, কোথাও গাজোয়ারি করা চলবে না, তাহলে এই দুর্বৃত্তরা পঞ্চায়েতের দখল নিতে পারত না। আজ এভাবে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত হত না। যেখানে বিজেপির কোথাও কিছু নেই, সেসব আসনেও তারা লোকসভায় জিতল!‌ মানুষের ঘৃণা কোন পর্যায়ে পৌঁছলে এমনটা হয়, সেটা আন্দাজ করার ক্ষমতাও নেই। তাই আত্মসমীক্ষাও নেই। সেই গাজোয়ারি আর মিথ্যাচারের ট্রাডিশন সমানে চলেছে। আজ সর্বদলীয় সভায় যে বার্তাই দিন, এই বিষবৃক্ষ নিজের হাতেই বপন করেছেন। ‘‌অনুপ্রেরণা’‌র জল হাওয়াতেই এরা বেড়ে উঠেছে। এই ‘‌অনুপ্রেরণা’‌ এবার ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসার পালা।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.