মৌতান ঘোষাল
লাবণ্য আর অমিত ‘রে’, বাঙালির চিরকালীন দুই স্বপ্নের মানুষ। তাদের প্রেম চিরন্তন। কোচিং ক্লাসের প্রথম চিরকুটে লেখা প্রেমপত্র পাঠানো সেই মেয়েটা যার সঙ্গে কলেজ জীবনে আর যোগাযোগ করা গেল না, বা কলেজ ক্যান্টিনে চোখে চোখ, হাতে হাত রাখার পরও বিয়ের আসর পর্যন্ত গড়ালো না যে সম্পর্কটা, সেই না পাওয়া ভালোবাসা, যে মানুষটাকে না পাওয়ার ফলেই সর্বশ্রেষ্ঠ মনে হয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, সেই তো আসলে লাবণ্য বা অমিত ‘রে’। কাজেই এই দুই চরিত্র বাঙালির খুব চেনা। আর এই চেনা চরিত্র দুটিকেই পর্দায় নিয়ে আসা যে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু সেই চ্যালেঞ্জটাই নিয়ে ফেলেছেন পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়। হ্যাঁ অবশেষে মুক্তির জন্য তৈরি তাঁর ছবি “শেষের কবিতা”। যার ‘লাবণ্য ’কঙ্কনা সেন শর্মা আর ‘অমিত’ রাহুল বোস।
তথাকথিত অর্থে সুন্দরী বলতে যা বোঝায় কঙ্কনা কখনোই ঠিক তা নন, সেক্ষেত্রে বাঙালির স্বপ্ন কণ্যা লাবণ্যের চরিত্রে অভিনয় করাটা যে কত বড় চ্যালেঞ্জ তা জানেন তিনি। তবে এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, রবি ঠাকুর কখনই কিন্তু অপরূপা সুন্দরী বলে ব্যাখ্যা করেননি লাবণ্যকে। অমিত লাবণ্যকে প্রথম যখন দেখে তার পরনে সাদা শাড়ি। পাহাড়ের কোলে সেই রূপ কিন্তু এক অদেখা নিষ্পাপ সুন্দর ব্যক্তিত্বের কথাই বলে, যা একেবারেই তথাকথিত সুন্দরের মত নয়। পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় এই ব্যাপারটা ভুলে যাননি। তাই গ্ল্যামারাস সুন্দরী নয়, বরং আটপৌরি কঙ্কনাকেই বেছে নিয়েছেন। ‘কেতকী’ বা কেটি চরিত্রটি অনেক বেশি সংজ্ঞায়িত সুন্দর। যে সুন্দর আমাদের বাস্তব জগতে দেখা স্বাভাবিক, কিছুটা উগ্রও। আর সেই ভূমিকায় যে বাংলা ছবিতে স্বস্তিকা এই মুহুর্তে একেবারে খাপে-খাপ, সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
একই চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে নায়ক রাহুল বোসও। কারণ “মিষ্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার” বা “অন্তহীন” কিংবা “মান গায়ে মুঘলে আজম” এর রাহুল বোসকে রবি ঠাকুরের ‘অমিত রে’ তে কল্পনা করা কিন্তু খুব সহজ নয়। তবে এই দুই অভিনেতার ক্ষেত্রে তাঁদের সব থেকে বড় অস্ত্র অবশ্যই তাঁদের অভিনয়। নিজেদের অভিনয়কে তাঁরা সত্যি সেই মাত্রায় নিয়ে যেতে পারেন যেখানে চরিত্র থেকে তাঁদের আলাদা করাই খুব কঠিন হয়। একই কথা অনেকটাই সত্যি স্বস্তিকার ক্ষেত্রেও।
আর“ শেষের কবিতা”? কবিগুরু নিজের এই উপন্যাসটি লিখেছিলেন সেই সময় যখন দেশ জুড়ে সমালোচনার ঝড় চলছে তাঁকে নিয়ে। আর তার প্রতিফলন দেখা যায় উপন্যাসজুড়ে অমিতের মুখে তাঁর আত্মসমালোচনায়। কাজেই এটা কখনই রবীন্দ্র ভাবাদর্শের লেখা নয়। সাহিত্য জগতের বিদগ্ধ মানুষরাও কোনওদিনই “শেষের কবিতা”কে রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য সাহিত্যের মতো উচ্চমর্যাদার আসনে বসাননি। বরং এই রচনা তাঁর তুলনায় একটু দুর্বল বলেই মনে করা হয়। অথচ এই উপন্যাসই বোধয় সবথেকে বেশি পাঠ্য আপামোর বাঙালি জীবনে। যারা সেই অর্থে উপন্যাসের পাঠক নন, তাঁরাও যুগ যুগ ধরে “শেষের কবিতা”র স্বাদ গ্রহণ করেছেন চেটে পুটে। এর আগেও এই উপন্যাস নিয়ে ছবি হয়েছে। তবে তেমন সাড়া পড়েনি। এবার কিন্তু ছবির পরিচালক থেকে স্টার কাস্ট, এবং সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ। সবমিলিয়ে অনেক বেশি আলোচনায় “শেষের কবিতা”। আর বাঙালির চির প্রেমিক জুটি অমিত-লাবণ্যের ভুমিকায় রাহুল—কঙ্কনা জুটি মন জয় করতে পারেন কিনা দর্শকদের তা জানতে অপেক্ষা আর মাত্র কটা দিনের।