রাহুল বিশ্বাস
শোলে সিনেমার গব্বর সিয়ের একটা ডায়লগ মনে এল। রামপুর গ্রামের বাসিন্দারা মুখ বুজে সব জুলুম মেনে নিচ্ছে দেখে গব্বর বলেছিল, “ঠাকুর নে হিজড়ো কি ফৌজ বানা রাখি হ্যায়।”
সোলে সিনেমাটি গরমাগরম সংলাপের জন্য বিখ্যাত হলেও এই সংলাপটির আমরা তীব্র নিন্দা করি। এই সংলাপে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অকারণে অপমান করা হয়েছে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অপমান করার বা অন্য কাউকে তৃতীয় লিঙ্গ বলার কোনও অভিপ্রায় আমাদের নেই। কিন্তু আমাদের রাজ্যের বাম দলগুলির মাঝারি নেতাদের কার্যকলাপ দেখে এই সংলাপটিই মনে এল। বামফ্রন্টের ফৌজ দেখে গব্বর সিং কী বলত, কে জানে!
বাম নেতাদের কথা বলব। তার আগে তৃণমূলের দুই নেতার কথা বলে নিই। শিউলি সাহা এবং শীলভদ্র দত্ত। তাঁরা ভাল কী মন্দ, সে বিচারের ভার আমাদের নয়। কিন্তু আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার প্রশ্নে তাঁদের কুর্নিশ করতেই হবে। দল সাসপেন্ড করেছে। হয়ত বহিস্কারও করবে।সামনের নির্বাচনে টিকিট পাওয়ার কোনও চান্স নেই। অন্য দলের টিকিট পেলেও জেতার আশা নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক কেরিয়ারে লালবাতি জ্বালার সমূহ সম্ভাবনা। তবুও তাঁরা আনুগত্য বদল করেননি। মুকুল রায়ের হাত ছাড়েননি। এই আনুগত্য শিক্ষণীয়।
এর বিপরীতে রাখুন তাপস চট্টোপাধ্যায়কে। রাখুন আবু আয়েশ মণ্ডলকে। বামপন্থীরা নিজেদের আদর্শবাদী বলে বড়াই করেন। বলেন, ক্ষমতা নয়, আদর্শের জন্য তাঁরা পার্টি করেন। আর পার্টির আদর্শের প্রতি অনুগত থাকলেই দল বা প্রশাসনের কোনও পদে বসা যায়। তাপসবাবু ১৫ বছরের চেয়ারম্যান। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এলাকায় সিপিএমের মুখ। ধরেই নেওয়া যায়, মার্কসবাদ তাঁর রক্তে টগবগ করে ফুটছে। কিন্তু পৃথিবীর নিজের চারিদিকে একপাক খেতে যা সময় লাগে, তার থেকেও কম সময়ে তিনি রাজনীতির ঘুরপাক খেলেন।
অন্তত একটু অভিনয় তো করতে পারতেন। মাস কয়েক ধরে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারতেন। তারপর সপ্তাহ দুয়েক ধরে মা মাটি মানুষের ভাল-টা তুলে ধরতে পারতেন। উন্নয়নের কর্মযজ্ঞের প্রশংসা করতে পারতেন। বলতে পারতেন, সত্যিটা স্বীকার করতে ভয় পাই না, দল যা পারে করুক। তারপর দল বদলালে এতটা চোখে লাগত না। অন্তত দল ছাড়ার পটভূমিটা তৈরি হত। কিন্তু আপনার সবুর সইল না। ভোটের মুখে আয় আয় তু তু বলতেই ছুট লাগালেন ?
যে দলে গেলেন, সে দলের শিউলি, শীলভদ্ররা এখনও খাতায় কলমে আছেন। পারলে গোপনে দেখা করে একটু আনুগত্যের শিক্ষা নেবেন। এতদিন যে দলে ছিলেন, তারা কথায় কথায় আদর্শের বড়াই করে। আনুগত্যটাও কিন্তু একরকমের আদর্শ । নতুন দলে গিয়ে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে দেখে শিখবেন। প্রবীণ নেতা। একেবারে শুরুর দিন থেকে আছেন। অনেক অপমানিত হয়েছেন। কিন্তু দল ছাড়ার কথা ভাবেননি।
আচ্ছা, নতুন দলে গিয়ে কী বলবেন ? গত পনেরো বছরে রাজারহাটে কোনও উন্নয়ন হয়নি ? বললে, সেই থুথু কার গায়ে লাগবে ? ৩৪ বছরেরর ‘হার্মাদরাজ’এর বিরুদ্ধে গলা ফাটাবেন ? সেই হার্মাদদের মধ্যে আপনি কি প্রেমের ঠাকুর শ্রীচৈতন্য ছিলেন ?
দলের পঞ্চায়েত সদস্যরা বা পুরসভার কাউন্সিলররা অনেক সময় বাধ্য হয়ে দল বদলান। কিন্তু তাদের বলার মতো একটা অজুহাত থাকে। ভয়, প্রলোভন। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে এর কোনওটাই খাটে না। মনে হয়, এতদিন তৃণমূল আপনার সম্বন্ধে যা বলত, সেটাই সত্যি। জমির দালাললি, সিন্ডিকেট, তোলাবাজিতে মদত দেওয়ার যে অভিযোগ এতদিন উঠত, আপনার দলবদল তাকেই সত্য প্রমাণ করেছে। শাসক দলের নাম লিখিয়ে আপনি আসলে এইসব ধান্দাবাজি বজায় রাখতে চান।
ভারী অদ্ভুত একটা কথা শুনছি। আপনার নতুন দপ্তরে নাকি তিনজনের ছবি থাকবে। জ্যোতি বসু, সুভাষ চক্রবর্তী ও মমতা ব্যানার্জি। মনে পড়ে যাচ্ছে সন্তান দলের কথা। সেখানে স্ট্যালিন, হিটলার আর নেতাজি। আর তাঁদের সঙ্গে বালক ব্রহ্মচারি। তৃণমূলে যখন গেছেন, তখন মমতা ব্যানার্জির ছবি টাঙাতেই হবে। তাহলে অন্তত জ্যোতি বসুকে রেহাই দিন। রেহাই দিন সুভাষ চক্রবর্তীকেও। দল বদল করেছেন, বেশ করেছেন। কিন্তু প্লিজ, সবকিছু এভাবে ঘেঁটে দেবেন না। ওঁদের অন্তত মুক্তি দিন। আপনার ডিগবাজির সঙ্গে ওই দুজনকে নাই বা জড়ালেন।
ছবি আর কর্মকান্ড দেখে অনেককিছুই চেনা যায়, বোঝা যায়। কেন জানি না, আপনাকে দেখে, আপনার কাজকর্ম দেখে বারবার মনে হত, আপনি মোটেই বামমনস্ক নন। আর দশজন বাম মনস্ক লোকের সঙ্গে কিছুতেই আপনাকে মেলানো যেত না। এই ফারাকটা আমাদের মতো সাধারণ লোকের চোখে ধরা পড়েছে, এতদিন সিপিএমের তাবড় তাবড় নেতাদের চোখে ধরা পড়ল না। বারবার মনে হত, আপনি সুযোগ পেলেই দল বদল করবেন। আপনি দুঃসময়ে থাকবেন না। কী আশ্চর্য, আপনার দলের কেউ বুঝতে পারল না! তারা জামাই আদরে আপনাকে পনেরো বছর ধরে চেয়ারম্যান রেখে দিল।
তাঁরা কতটা মানুষ চেনেন, সেটাও যেন আপনি বুঝিয়ে দিলেন। ধন্যবাদ, তাপসবাবু। নতুন জায়গায় ভাল থাকুন।
তাপসবাবু চলে গেলেন। এবার তাঁকে ‘বিশ্বাসঘাতক’, ক্ষমতালোভী, সুবিধাবাদী—এসব বলা হবে। এতদিন এগুলো বুঝতে পারেননি কেন ? পনেরো বছর ধরে তাঁকে চেয়ারম্যান রাখতে হল কেন ? সেটা কি আপনাদের ব্যর্থতা নয় ? সেটা কি আপনাদের দূরদর্শিতার অভাব নয় ? আক্রমণ করে নিজেদের আর হাস্যাস্পদ করবেন না। বরং, এই সুযোগে একটু আত্মসমালোচনা করুন।