মেসিদের নতুন দৌড় হয়ত শুরু হয়ে গেল

‌সরোজ চক্রবর্তী

আর দশজন গড়পড়তা মানুষের সঙ্গে চ্যাম্পিয়নদের এটাই ফারাক। আমি, আপনি যখন চাপের মুখে আরও বেশি করে গুটিয়ে যাই, তখন চ্যাম্পিয়নরা জ্বলে ওঠেন। আমরা যখন মাথা গরম করে উল্টোপাল্টা কাজটা করে বসি, এই চ্যাম্পিয়নরা তখন মাথা ঠান্ডা রেখে আসল কাজটা করে যান। এই কারণেই তাঁরা বারবার ফিরে আসেন।

প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের মতো অখ্যাত দলের কাছে আর্জেটিনা হেরে বসবে, অনেকেই ভাবতে পারেননি। সেটাই স্বাভাবিক। ধারে–‌ভারে কোনও দিক থেকেই আর্জেন্টিনার ধারেকাছেও আসে না সৌদি আরব। কিন্তু এখানেই বিশ্বকাপের মাহাত্ম্য। কখন কে এসে চমক দিয়ে যাবে, বলা মুশকিল। নব্বইয়ে কে ভেবেছিল প্রথম ম্যাচেই বিশ্বজয়ী আর্জেটিনাকে হারিয়ে দেবে ক্যামেরুন!‌

সেবার কিন্তু প্রথম ম্যাচে হেরেও একের পর এক বাধা টপকে ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিল মারাদোনার আর্জেন্টিনা। মেসি তখন নিতান্তই ছোট। কিন্তু গত কয়েকদিনে ঘুরে ফিরে এতবার ওঁকে কথাটা শুনতে হয়েছে, হয়ত মনে গেঁথে গেছে। শুধু দ্বিতীয় ম্যাচে, মেক্সিকোর বিরুদ্ধে গোলটার কথা ভাবুন। হারলেই নিশ্চিত বিদায়। প্রথমার্ধে গোল হয়নি। দ্বিতীয়ার্ধেও প্রায় কুড়ি মিনিট হয়ে গেছে। সময় ক্রমশ কমে আসছে। বিপক্ষের রক্ষণে কার্যত জঙ্গল। এই সময় বক্সের বাইরে বল পেলেন। অন্য যে কেউ হলে উচুতে জোরালো শট নিতেন। এত পায়ের ভিড়। সেখানে মাটি গড়ানো শট নেওয়ার ঝুঁকিই নিতেন না। এখানেই মেসি বাকিদের থেকে আলাদা। ওই রকম একটা পরিস্থিতিতে মাটি গড়ানো শট নেওয়া যায়!‌ এতগুলো পায়ের জঙ্গলে কারও না কারও পায়ে লেগে বলের গতি থমকে যাওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সামান্য ফাকফোকরকেও কী চমৎকার কাজে লাগালেন।

তিন পয়েন্টে একটা অক্সিজেন হয়ত পাওয়া গেল। কিন্তু সংশয় তো কাটল না। উল্টোদিকে লেওয়ানডস্কির পোলান্ড। এখানেও সেই জিততেই হবে। ড্র হলে নানা জটিল অঙ্কের হাতছানি। অনেকেই হয়ত বলবেন পেনাল্টি মিসের কথা। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, ওই অবস্থায় পেনাল্টি মারতেও একটা হিম্মৎ লাগে। পেনাল্টি হল এমন একটা জিনিস, গোল হলে কেউ মনে রাখে না। কিন্তু না হলেই ভিলেন হয়ে যেতে হয়। পেনাল্টি মিসের জন্য কত নায়ক রাতারাতি খলনায়ক হয়ে গেছেন। ধরা যাক পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে শেষমেশ আর্জেন্টিনা যদি হারত, তাহলে কিন্তু ওই পেনাল্টি মিসটাকেই বড় করে দেখানো হত। বলা হত, মেসির জন্যই হারতে হল। এমনকী, তাঁর নিজের দেশেও এমন কথা বলার লোকের অভাব ছিল না। এসব জেনেও পেনাল্টি নিতে গেছেন। পেনাল্টি মিসের পরেও হতাশায় গুটিয়ে যাননি। বরং নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কখনও উইংয়ের দিকে সরে গেছেন। কখনও নেমে গেছেন একটু নিচের দিকে। তাঁকে সামলাতেই ব্যতিব্যস্ত থেকেছে বিপক্ষের রক্ষণ। পায়ে বল থাক না থাক, দু–‌তিনজন যেন তাঁর জন্যই নিযুক্ত। এতে সতীর্থদের সামনে কিছুটা ফাঁকা জায়গা পাওয়া যায়। ফাঁকতালে সতীর্থরা উঠে এসে আচমকা গোল করে যান। ঠিক সেটাই হল। বিপক্ষ যখন মেসিকে তাক করে বসে আছে, তখন কখনও গোল করে গেলেন অ্যালিস্টার, কখনও আবার আলভারেজ। যাঁদের সেভাবে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি পোল্যান্ড শিবির।

সেই পুরনো আর্জেন্টিনার কথা ভাবুন। বিপক্ষ ব্যস্ত থেকেছে মারাদোনাকে নিয়ে। সেই সুযোগে বাজিমাত করে গেছেন কখনও বুরুচাগা, কখনও ক্যানিজিয়া। জন্ম হয়েছে নতুন তারকার। এবারও পরিস্থিতি অনেকটা সেরকমই। আর্জেন্টিনা যে শুধু মেসি–‌নির্ভর নয়, হিসেব বদলে দেওয়ার মতো আরও অনেক তরুণ অপেক্ষা করছেন, সেই বার্তাটাও পরিষ্কার।

প্রথম পর্বের বাধা উতরে যাওয়া বড় একটা স্বস্তি। অন্তত প্রথম রাউন্ডে তো ছিটকে যেতে হল না। এই স্বস্তিটাই যে কোনও বড় দলকে বাড়তি একটা অক্সিজেন দিয়ে যায়। তখনই বড় দল আর ছোট দলের ফারাকটা বোঝা যায়। ছোট দলগুলো গ্রুপ লিগে একে–‌তাকে হারিয়ে দিয়ে বা আটকে দিয়ে চমক দেয়। কিন্তু লম্বা রেসে পিছিয়ে পড়ে। পরের দিকের চাপটা আর সামলাতে পারে না। বড় দলের ক্ষেত্রে আবার ছবিটা অন্যরকম। তারা প্রথম দিকে হোঁচট খায়। ধুলো ঝেড়ে ঠিক উঠে দাঁড়ায়। আবার নতুন উদ্যম নিয়ে ছুটতে থাকে। আর্জেন্টিনার সেই নতুন দৌড় হয়ত শুরু হয়ে গেল।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.