‘রসুন’ সংস্কৃতির আসল জন্মদাতা কিন্তু হেমন্তই

 

ময়ূখ নস্কর

আজ থেকে তিরিশ–‌চল্লিশ বছর আগে ছিল ক্যাসেটের জমানা। তখন প্রায় প্রতিটি বাঙালি বাড়িতে ‘‌লিজেন্ডস অফ গ্লোরি’‌ নামে একটি ক্যাসেট থাকত। সম্ভবত বাংলা গানের ইতিহাসে এটিই জনপ্রিয়তম ক্যাসেট। সলিল চৌধুরির সুরে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়েক কণ্ঠে দশটি গানের সংকলন। এই ক্যাসেটটি বাঙালির জীবনে ‘‌রসুন’‌ সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছিল।

‘‌রসুন’‌ মানে পেঁয়াজ–‌রসুন নয়। এই শব্দটির সৃষ্টিকর্তা বিজেপি নেতা তথাগত রায়। তথাগতবাবু ব্যঙ্গ করে বলতেন, বাঙালিকে রসুন সংস্কৃতি ছাড়তে হবে। অর্থাৎ বাঙালি রবীন্দ্র–‌সুকান্ত–‌নজরুলে আচ্ছন্ন। সিপিএম নাকি জোর করে বাঙালিকে ‘‌রসুন’‌ খাওয়াতে চাইছে। রসুন–‌এর প্রতি তথাগতবাবু বা বিজেপির রাগ থাকা স্বাভাবিক। কারণ, রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচিন্তা বা ঈশ্বরচিন্তার সঙ্গে তাঁদের স্বদেশচিন্তা বা ঈশ্বরচিন্তা খাপ খায় না। নজরুল মুসলমান। আর সুকান্ত বামপন্থী। কিন্তু তথাগতবাবুর মন্তব্য থেকে একটা কথা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, বাংলা কবিতার ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর হলেন এই তিনজন। যাঁরা তাঁদের পছন্দ করেন না, তাঁরাও এই তিনজনের নাম এক নিশ্বাসেই উচ্চারণ করেন।

hemanta16

কিন্তু প্রশ্ন হল, রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের পাশে সুকান্ত স্থান পেলেন কীভাবে?‌ এই স্থান তো মাইকেল বা জীবনানন্দও পেতে পারতেন। একুশ বছরের সাহিত্য জীবনে সুকান্ত যত প্রতিভারই পরিচয় রাখুন, রবীন্দ্র–‌নজরুলের পাশে বসার মতো সৃষ্টিসম্ভার তাঁর ছিল না। বাংলার বাম শাসকরা জোর করে সুকান্তকে প্রথম সারিতে বসিয়ে দিয়েছেন, একথা বলা যাবে না। কারণ, বিষ্ণু দে বা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও বামপন্থী। এবং তাঁরা কবি হিসেবে সুকান্তর থেকে কম তো নন, বরং বেশি। তাহলে সুকান্ত প্রথম তিনজনের মধ্যে স্থান পেলেন কীভাবে?‌

এই প্রশ্নের উত্তর হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এই লেখার শুরুতে যে ক্যাসেটটির কথা বলেছি, তাতে আছে সুকান্তর লেখা তিনটি গান। অবশ্য সুকান্ত গান লিখতে জানতেন না। এই কবিতাগুলি গান হবে, এই ভেবে লেখেনওনি। নিছক কবিতা হিসেবেই লিখেছিলেন। তাঁর কবিতায় সুর দিয়ে গানে পরিণত করেছিলেন সলিল চৌধুরি। আর সেই গানে প্রাণ দিয়েছিল হেমন্তর কণ্ঠ। অবাক পৃথিবী, বিদ্রোহ, রানার, ঠিকানা এই গানগুলি না থাকলে বাঙালি হয়ত এতদিনে সুকান্তকেও ভুলে যেত। যেভাবে ভুলে গেছে দীনেশ দাসের মতো একদা সাড়া জাগানো ‘‌কাস্তে’‌ কবিকে। দীনেশ দাস বা বিষ্ণু দে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে কবিতাগুলো লিখেছিলেন, সেগুলি বাঙালি আর পড়ে না। কিন্তু সুকান্তর লেখা ‘‌রবীন্দ্রনাথের প্রতি’‌ বাঙালি আজও মনে রেখেছে। কারণ, বিষ্ণু দে বা দীনেশ দাশের কোনও রচনায় হেমন্ত কণ্ঠ দেননি। তাই তাঁদের রচনা সাধারণ মানুষের মনের মণিকোঠায় পৌঁছয়নি। তাই তাঁরা রবীন্দ্র–‌নজরুলের পাশে স্থানও পাননি।

হেমন্ত আর সুকান্তের সেতুবন্ধন একদিকে যেমন সলিল চৌধুরি, অন্যদিকে অবশ্যই সুভাষ মুখোপাধ্যায়। দুজনেই পদাতিক কবির অত্যন্ত প্রিয়। হেমন্তর সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, দুজনের আলাপও ছিল। আবার সুকান্ত সমগ্র থেকে জানা যায়, প্রথম জীবনে হেমন্তর কণ্ঠ খুব একটা ভাল লাগত না সুকান্তর। তাঁর বৌদি সরযূ দেবী লিখছেন—
‘‌সুকান্ত সে সময় রেডিওর যে কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পীকে মোটেই পছন্দ করতো না তিনি হলেন হেমন্ত কুমার মুখোপাধ্যায়। একথা শুনলে আজকের দিনে নিশ্চয়ই সকলে খুব অবাক হবেন। কিন্তু কথাটা একেবারেই মিথ্যা নয়।
হেমন্তকুমার তখন নতুন শিল্পী। সবে রেডিওতে গাইছেন। তাঁর নরম নিচু কণ্ঠস্বর মোটেই পছন্দ হত না সুকান্তর। হেমন্তর প্রোগ্রামের আগেই সে বলতো, বৌদি, এবার একজন ভদ্রমহিলা গান গাইবেন। শুনবে তো এসো।
আজ হেমন্তকুমার একথা শুনলে নিজেও নিশ্চয়ই হাসবেন। সে সময় সুকান্ত তাঁকে পছন্দ না করলেও পরবর্তীকালে তিনিই সুকান্তর গান গেয়ে তাকে সাধারণ মানুষের কাছে অনেকখানি জনপ্রিয় করে তুলতে পেরেছিলেন। যা সুকান্ত দেখে যেতে পারেনি।’‌
সেই সুকান্তর লেখাই সলিল চৌধুরির সুর বেয়ে পৌঁছে গেল হেমন্তর কাছে। আর হেমন্তকেও বিভিন্ন ফাংশানে, অনুষ্ঠানে এই গান গাইতেই হত। রবীন্দ্রনাথের গানকে মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবীর কবল থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে (‌এমনকী পুজো প্যান্ডেলে)‌ পৌঁছে দিয়েছিলেন। সেই হেমন্তই অকাল মৃত সুকান্তকে মৃত্যুঞ্জয়ী সুকান্ত–‌তে পরিণত করেছেন। বাঙালির ‘‌রসুন’‌ সংস্কৃতির অন্যতম স্রষ্টা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এই রসুন–‌এর স্বাদ–‌গন্ধ থেকে বাঙালির মুক্তি নেই। ‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.