‌করোনা রোধ:‌ হার্ড ইমিউনিটি?‌ না বৈজ্ঞানিক প্রথায় লকডাউন?‌

অম্লান রায়চৌধুরী

চরম অতিমারির সময়ে – লকডাউন বনাম হার্ড ইমিউনিটি, শিথিল লকডাউন বনাম কঠোর লকডাউন, জীবন বনাম জীবিকা ইত্যাদি নিয়ে নানান ভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা সমালোচনায় সারা বিশ্ব এখন ব্যস্ত। উপায় বার করার চেষ্টাতে। কিন্তু করোনা কিছুতেই তার সংক্রমণের থাবা কমাচ্ছেনা। বরংচ বেড়েই চলেছে।

সংক্রমণের মধ্য দিয়ে হার্ড ইমিউনিটি বলি, শিথিল অথবা হার্ড লকডাউনই বলি, কোনটা যৌক্তিক, কোনটা যৌক্তিক নয়, আর এর বাস্তবায়নে কাঠামো এবং পদ্ধতিগত রূপরেখা চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায় এবং অধিকার, কোনওটাই একজন সাধারণ নাগরিকের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। এই নাগরিক বিশ্বের যে প্রান্তেই অবস্থান করুন না কেন। এ এক বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু অবশ্যই রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের সুস্পষ্টতাকে দেখতে পাওয়া, সুনিশ্চিত হওয়া এবং শঙ্কাহীন জীবন প্রত্যাশা করা যে কোনও বিশ্ব নাগরিকের অধিকার ভুক্ত।

পরিতাপের বিষয়, যে করোনা ভাইরাসের মতো বৈশ্বিক সমস্যাকে বৈশ্বিক ভাবে মোকাবিলার লক্ষ্যে সামান্যতম পদক্ষেপের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়নি। বরং প্রতিটি দেশের স্থানিক সমস্যা হিসাবে রেখে দিয়ে, স্থানীয় কর্মপন্থার মধ্যে দিয়ে একে মোকাবিলার চেষ্টা করা হয়েছে – যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে বৈশ্বিক মহামারী হিসাবে ঘোষণা করেছে এবং অনেকটাই ঘোষণার মধ্যেই নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রেখেছে। তাদেরকে এক্ষেত্রে যদিও অনেক গুরুত্ত্বপূর্ণ দিক নির্দেশের পরেও – এমন অভিযোগে অভিযুক্ত করাই যায়।

PTI22-03-2020_000097B

জিনোমগত বিশিষ্টের কারণে কেউ হয়ত স্থানিক পদক্ষেপকেই যৌক্তিক মনে করতে পারেন, কিন্তু করোনা ভাইরাসের জিনোমগত তারতম্য বিদ্যমান থাকলেও, গতিপ্রকৃতির মূল ধারা যদি বিবেচনায় আনা হয়, তবে অঞ্চল ভেদে এর বৈশিষ্ট্যের কোনও তারতম্য ঘটে না, অর্থাৎ একে প্রতিরোধের পদ্ধতি প্রায় একই থেকে যায়। ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের আগে পর্যন্ত এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণের দুটি পথই খোলা আছে, তা হল, সংক্রমণের মধ্য দিয়ে হার্ড ইমিউনিটি অথবা লকডাউন।

শিথিল–‌কঠোর যাই হোক, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সুইডেন ব্যতিত বিশ্বের সকল দেশ শেষ পর্যন্ত লকডাউনের পথ বেছে নিয়েছে। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় সুইডেন হার্ড ইমিউনিটির পথ অবলম্বন করেছে। যুক্তরাজ্য প্রথমে হার্ড ইমিউনিটির কথা ভাবলেও পরে এখান থেকে সরে এসেছে এবং তা অনেকটা বাধ্য হয়েই। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশ সিদ্ধান্ত নিয়ে হার্ড-ইমিউনিটির দিকে না গেলেও প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল হার্ড ইমিউনিটির দিকেই। ভারতে হার্ড-ইমিউনিটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে করোনা ভাইরাসকে যেভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে, তাতে এমনও হতে পারে হার্ড ইমিউনিটি শেষ ভরসা, এমন চিন্তাও কর্তৃপক্ষের মাথায় থাকতে পারে।

হার্ড ইমিউনিটি বলতে কী বোঝায় এবং তার সঙ্গে করোনার কী সম্বন্ধ – সেটা একটু বুঝে নেওয়ার দরকার। হার্ড ( Herd) শব্দের অর্থ হল জনগোষ্ঠী এবং ইমিউনিটির অর্থ হল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। সমাজের বেশির ভাগ মানুষের শরীরে যখন কোনও বিশেষ জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়, অর্থাৎ অল্প কিছু মানুষ বাদে বেশিরভাগ মানুষই কোনও নির্দিষ্ট রোগ প্রতিরোধী হয়ে যায়, তখন তার সুবিধে অন্য মানুষেরা পেতে শুরু করেন তাকেই বলে হার্ড ইমিউনিটি।

ধরা যাক, কোনো অঞ্চলে ১০ লাখ মানুষ আছেন, এরমধ্যে ৮ লাখ মানুষ কোনও নির্দিষ্ট ভাইরাসজনিত রোগের ভ্যাকসিন নিয়ে প্রতিরোধী হয়েছেন, তাহলে বাকি ২ লাখ অপ্রতিরোধী লোকও সেই নির্দিষ্ট ভাইরাস থেকে আক্রান্ত হবার কম ঝুঁকিতে থাকবে। অর্থাৎ ১০ লাখের এই জনগোষ্ঠী এই ভাইরাস প্রতিরোধের ক্ষমতা অর্জন করবে। এই অঞ্চলের কিছু শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন না নিয়ে এবং সংক্রমিত না হয়েও অর্থাৎ ইমিউনড না হয়েও সংক্রমণের হাত থেকে বেঁচে যাবেন। অর্থাৎ, একের থেকে অন্যের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণের শৃঙ্খল ভেঙে যাবে। এই অঞ্চলে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে উঠবে।

এখন প্রশ্ন হল, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে কি হবে না। করোনাভাইরাসের যেহেতু এখনও ভ্যাকসিন নেই, তাই এক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি হতে হলে, তা হতে হবে সংক্রমণের পথ ধরেই। অর্থাৎ কোটি কোটি মানুষকে সংক্রমিত করেই তৈরি করতে হবে হার্ড ইউমিনিটি। প্রাথমিকভাবে অত্যন্ত সংক্রামক রোগ হামের ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি পেতে হলে ৯০% মানুষক আক্রান্ত হতে হবে। তবে যখন কোনও রোগ সূচকীয় হারে সংক্রমিত হতে থাকে তখন যদি মোট জনসংখ্যার অর্ধেকও প্রতিরোধী হয়ে যায়, তাহলে মহামারী আর সেই হারে ছড়াতে পারে না। জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার হারের সাথেও রয়েছে হার্ড ইমিউনিটির সম্পর্ক। জীবাণু ছড়ানোর হারকে R ( Reproduction number ) দ্বারা প্রকাশ করা হয়।

umminity2

করোনাভাইরাসের R এর মধ্যে ৫.২ থেকে ২ , এমনটাই এখন পর্যন্ত ধারণা। অর্থাৎ একজন আক্রান্ত মানুষ দুজনের মাঝে এটি ছড়াতে পারেন। ১, ২, ৪, ৮, ১৬, ৩২, ৬৪ এই হারে ছড়াতে থাকবে। তবে কোনও অঞ্চলের অর্ধেক লোক যদি প্রতিরোধী হয়, তাহলে একজন আক্রান্ত মানুষ সংক্রামণ একজনেই ছড়াবে। অর্থাৎ ছড়ানোর হার কমে যাবে। তবে কোনও অঞ্চলের অর্ধেক লোক যদি প্রতিরোধী হয়ে ১, ১, ১, ১, ১, ১, ১, ১ … তার মানে যত বেশি মানুষ প্রতিরোধী হয়ে উঠবে সংক্রমণের হার তত কমে আসবে এবং একসময় শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।

ধারণা করা হচ্ছে যে, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে হার্ড ইউমিনিটি অর্জনের জন্য মোট জনসংখ্যার ৬০% মানুষ কে আক্রান্ত হতে হবে । অর্থাৎ আমাদের দেশের ক্ষেত্রে প্রায় ৮০ কোটি মানুষকে আক্রান্ত হতে হবে। এই আক্রান্তদের মধ্যে আবার কমপক্ষে ১০%কে হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হবে। মানে ৮ কোটি লোককে, তার মধ্যে মৃত্যুর হার দাঁড়াবে কমপক্ষে – ৫% , ৪০ লক্ষ মানুষের।

এবার সমস্যাটা দাঁড়াবে – ৮ কোটি মানুষের হাসপাতালের ব্যবস্থা, যেটা প্রায় অসম্ভব ভারতের ক্ষেত্রে। যা হিসাব পাওয়া যায়, তাতে এত মানুষকে অন্যান্য অসুখের সাথে আলাদা ভাবে করোনাকে জায়গা দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। সেখানে হার্ড ইউমিনিটির জন্য সংক্রমণকে বেছে নেয়া কতটা ভয়াবহ হতে পারে আমাদের দেশের পক্ষে তা অবশ্যই বিশেষভাবে ভাবতে হবে আমাদের দেশের ক্ষেত্রে ।

এখনও এই বিষয়ে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি যে যারা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন তাঁরা ঠিক কতটুকু প্রতিরোধী হচ্ছেন বা আদৌ প্রতিরোধী হচ্ছেন কি না! কেননা বিভিন্ন দেশে কোভিড থেকে সুস্থ হওয়া ব্যক্তিদের আবার করোনাতে আক্রান্ত হতে দেখা গেছে। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ফ্লু জাতীয় ভাইরাসে মিউটেশন হয় নিয়মিত নতুন নতুন প্রকরণের সৃষ্টি হয়। কেউ একজন একটি প্রকরণ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে প্রতিরোধী হলেও পরবর্তীতে যদি অন্য কোনও প্রকরণ দিয়ে সংক্রমিত হয়, তাহলে প্রথম ক্ষেত্রে যে ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে সেটি দ্বিতীয়টির বেলায় কোনও প্রতিরোধ গড়ে তুলবে না। সুতরাং ফ্লু জাতীয় ভাইরাসের ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটির মধ্য দিয়ে কোনো কার্যকর ফলাফল পাওয়া যাবে কি না তা নিশ্চিত হয়ে বলার সুযোগ নেই। তাই মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে মৃত্যুর ঝুঁকিতে ফেলে দেয়ার কৌশল কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

এই নানান সমস্যার থেকে নিষ্কৃতি একমাত্র ভ্যাকসিনের প্রয়োগেই। যার হদিশ কিছুটা হলেও পাওয়া গেছে অক্সফোর্ডের খবরে ।

সেই পর্যন্ত আমাদের উচিত লকডাউনের ব্যবস্থাকে আরও বৈজ্ঞানিক উপায়ে ব্যবহার করা ও মানুষকে সজাগ করা এই ভাইরাস সম্বন্ধে। তাই পদ্ধতিগত লকডাউনের নানা দিক নিয়ে ভাবা উচিত। মাথায় রাখতে হবে জীবন ও জীবিকার কথা । বয়স্ক মানুষদের জীবন যাত্রার কথা। স্বাস্থ ব্যবস্থায় কোনও গাফিলতি না রাখা। রোগীর বেডের যথাযথ ব্যবস্থা করা। নতুন সেন্টার খোলা যেখানে শুধু কোভিড রোগীকেই রাখা হবে। তাদের সংখ্যা বাড়ানো। সাধারণ ও ইমারজেন্সি রোগীর জন্য আলাদা বন্দোব্যস্ত করা। বিভিন্ন সামাজিক সংস্থাগুলোকে সাময়িক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা ।

এগুলোকে নিয়েই তৈরি হোক বৈজ্ঞানিক লক ডাউন প্রক্রিয়া – যার জন্য ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ কি প্রস্তুত ?‌

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.