একটি মূল্যবান সাক্ষাৎকার এবং দু–‌চার কথা

অভিরূপ কুমার

প্রথমেই বলে রাখি, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার সরাসরি দেখার সুযোগ হয়নি। কখন দেখানো হবে, জানতাম। কিন্তু সেই সময় দেখার কোনও উপায় ছিল না। বাধ্য হয়ে, পরে ওয়েবসাইট থেকেই দেখলাম।

এখন এটা একটা মস্ত সুবিধা। আগে ভাল কোনও অনুষ্ঠান মিস করে গেলে আর দেখার সুযোগ ছিল না। এখন নিজের সুবিধামতো সময়ে দেখে নেওয়া যায়। এই সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে সত্যিই চমৎকার একটা সাক্ষাৎকার।

একেক কাগজ একেকভাবে তার ব্যাখ্যা করল। কেউ দেখাল, কেন্দ্রকে দায়ী করলেন অভিজিৎ। কেউ লিখল, রাজ্যের প্রশংসায় অভিজিৎ। পুরো সাক্ষাৎকারটা দেখার পর মনে হচ্ছে, একেবারেই বোকা বোকা সরলীকরণ। অহেতুক কারও প্রশস্তিও করেননি। কাউকে আক্রমণও করেননি। যেটা মনে করেন, সেটাই বলেছেন। তাঁর মতো মানুষের পক্ষে যতটা স্পষ্ট করে বলা যায়, সেটাই বলেছেন। যে ভাষায় দিলীপ ঘোষ বা সুজন চক্রবর্তী কথা বলবেন, সেটা তো অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষা হতে পারে না। তিনি বলেছেন তাঁর মতো করে। বুঝতে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

abhijit1

তিনি অর্থনীতির বিশারদ। অর্থনীতিবিদ শুনলেই ছোটবেলা থেকে কেমন যেন ভয় লাগে। টিভিতে যাঁদের কথা শুনি, অনেক কথাই মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে চলে যায়। তাঁরা বুঝিয়ে দেন, অর্থনীতি খুব জটিল জিনিস। সবার এটা বোঝার কথা নয়। সেই হিসেবে অভিজিৎবাবুর কথা মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে চলে যাওয়ারই কথা। কিন্তু একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ কী সহজভাবে গোটা সমস্যাটাকে তুলে ধরলেন!‌ যাঁরা পারেন, তাঁরা পারেন। যাঁরা পারেন না, তাঁরাই বোধ হয় দুর্বোধ্যতার আশ্রয় নেই।

শুরু থেকেই সহজ একটা পরামর্শ, আরও বেশি টাকা ছেপে মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়া হোক। এছাড়া কোনও সহজ উপায় নেই। মুদ্রাস্ফীতি কী হবে, এসব নিয়ে ভাবার দরকার নেই। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে শিল্পও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। কোম্পানির মালিকদের সাহায্য দিয়েও লাভ হবে না। কারণ, মানুষ কিনতে পারবে না। তার থেকে মানুষের যদি কেনার ক্ষমতা থাকে, কোম্পানি বন্ধ হবে না। কয়েক মাস আগেও তিনি এই জাতীয় কথা বলেছিলেন। তখন ব্যাপারটা তেমন বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। কিন্তু আজ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ সেই পথেই হাঁটছে। বোঝা গেল, তাঁর অর্থনৈতিক দর্শন খুব সহজ হলেও অনেক বেশি কার্যকরী।

abhijit2

করোনা মোকাবিলা নিয়ে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন। যেগুলো মোটেই রাজ্য সরকারের সুরে সুর মিলিয়ে বলা নয়।

১)‌ তথ্যগোপন একেবারেই উচিত নয়। সব রাজ্য যে পদ্ধতিতে তথ্য দিচ্ছে, সেই পদ্ধতিই মেনে চলা উচিত। নইলে, বিভ্রান্তি বাড়ে। ঠিক, ভুল যাই হোক, একটাই পদ্ধতি থাকা উচিত।
২)‌ যেখানে যেখানে টেস্ট হচ্ছে, স্থানীয়ভাবে রিপোর্ট জানানো হোক। সবকিছু এক জায়গা থেকে ঘোষণা হলে মানুষের মনে স্বচ্ছতা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়।
৩)‌ তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা থাকলে খুব একটা গুজব ছড়ায় না। স্বচ্ছতা না থাকলে মানুষ গুজবকেই বিশ্বাস করে।
৪)‌ বাংলায় মৃত্যুর হার বেশি দেখানো হচ্ছে, কারণ সেই সংখ্যক টেস্ট হয়নি। টেস্টের সংখ্যা বেশি হলে মৃত্যুর হার বেশি মনে হত না। শুরু থেকেই বলছি, টেস্ট বাড়াতে হবে। এখন সরকার সেই চেষ্টা করছে।
৫)‌ সরকারের ওপরও চাপ থাকে। কী কী চাপ থাকে, সে ব্যাপারে কিছুটা অভিজ্ঞতা আছে। সরকারের পলিসি বদল করা এত সহজ নয়। সময় লাগে।
৬)‌ আমি বিরাট কিছু ব্যস্ত নই। পৃথিবী বদলে যাবে, এমন কোনও মহৎ কাজ করছি না। তাই রাজ্যকে পরামর্শ দেওয়ার মতো সময় অবশ্যই আছে। তবে আমাদের ভূমিকা খুবই সামান্য। অনেক বিষয়েই খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। রাজ্যের কোথায় কোথায় খামতি আছে, চিফ সেক্রেটারিকে সেটা স্পষ্ট করেই জানিয়েছি। সেই অনুযায়ী কিছু পদক্ষেপও হয়েছে।
৭)‌ পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা শুরু থেকে ভাবাই হয়নি। অথচ, এটা ভাবা কিন্তু খুব একটা কঠিন ছিল না। কজন, কোথায় আটকে আছেন, আমরা কিছুই জানি না। রাজ্যগুলিও জানে না। তাঁদের ঠিকানা নেই, যেখানে কাজ করতে গেছেন, সেই মালিকরা কতদিন রাখবেন, সেটা আগেই ভাবা উচিত ছিল। যে যেখানে আছেন, তাঁকে সেখানেই অস্থায়ীভাবে রেশন কার্ড দেওয়া গেলে কিছুটা সমাধান হত।

আরও অনেক মূল্যবান সব কথা। নিছক সমালোচনা নয়। অহেতুক প্রশস্তি করাও নয়। একটা সঠিক দিশা দেখানোর চেষ্টা। সব সমালোচনার কথা হয়ত প্রকাশ্যে বলা যায় না। বলা শোভনীয়ও নয়। বিদ্যান মানুষদের একটা পরিমিতি বোধ থাকাটাই কাম্য। তাঁরা অল্প কথায়, অনেক কিছু বুঝিয়ে দিতে পারেন। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের সাক্ষাৎকারে সেটাই বুঝিয়ে দিয়েছেন।

সঞ্চালকও সংযম দেখিয়েছেন। হোমওয়ার্ক ছিল। রিসার্চ ছিল। কিন্তু অহেতুক বাচালতা ছিল না। ইদানীং অনেক অ্যাঙ্কর, অনেক চ্যানেল কর্তা নিজেরাই এত বকবক করেন, অসহ্য লাগে। তাঁরা ভাবেন, তাঁরাই মাতব্বর। যাঁরা সাক্ষাৎকার, তাঁর কথা লোকে শুনতে চায়। অ্যাঙ্করের নয়। এই শিষ্টাচারটা অনেকে বিসর্জন দিয়েছেন। সুমন অন্তত সংযমটা দেখিয়েছেন। ধন্যবাদ তাঁকেও।

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো মানুষের সাক্ষাৎকার নিতে গেলেও একটা আলাদা যোগ্যতা লাগে। সেটা সবার থাকে না। থাকার কথাও নয়।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.