‌হিন্দুত্ব ছাড়া বিজেপির সামনে কোনও প্রচারের কোনও অস্ত্র নেই

সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি

লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়ে গেছে। এবারের লোকসভা নির্বাচন নিঃসন্দেহেই কেন্দ্রের শাসকদলের কাছে বড় একটা চ্যালেঞ্জের। পাঁচ বছরের নানা কাজের মূল্যায়ন হবে জনগণের দেওয়া রায়ে। আর যেভাবে একটা প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া উঠেছে গোটা দেশ জুড়ে, তা দেশের শাসক শিবির কে যথেষ্টই উৎকণ্ঠায় রেখেছে।
তবুও একটা আশ্চর্যের বিষয় হল, কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপির এবারের নির্বাচনের হাতিয়ার কিন্তু তবুও সেই ধর্মীয় মেরুকরণ। ২০১৪ সালে তদানীন্তন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে প্রোজেক্ট করে বিজেপি যে কেন্দ্রের শাসক পরিবর্তনের হাওয়া তুলেছিল,তাতে প্রচ্ছন্নভাবে মেরুকরণ থাকলেও, মূল অস্ত্র ছিল কেন্দ্রের তদানীন্তন শাসক মনমোহন সিং এর কংগ্রেস সরকারের নানা আর্থিক দুর্নীতি। নরেন্দ্র মোদী দেশকে “সুশাসন” দেওয়ার অঙ্গীকার করে “আচ্ছে দিন” এর স্লোগান দিয়েছিলেন। তারপর বিপুল ভোটের মার্জিনে জিতে কেন্দ্রে সরকার গড়ে, ‘‌সবকা সাথ সবকা বিকাশ’‌ বা ‘‌মেক ইন ইন্ডিয়া’‌ ইত্য্যাদি নানাবিধ স্লোগান ছিলো তাঁর গলাতে। কিন্তু সেইসব স্লোগান যে কীভাবে রূপায়িত হল, তা দেশের প্রতিটি মানুষই প্রত্যক্ষ করেছেন।
শুরু হয়েছিল ধর্মীয় বিভাজন করা, জাতপাতের ভিত্তিতে দেশের মানুষকে বিভক্ত করে দেশের মূল সমস্যা গুলো থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখা। দেশের সর্বত্র দেখা গেল অ-হিন্দুর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো, নিগ্রহ, নির্যাতন এবং হত্যা। কোথাও গো-মাংস রাখার মিথ্যা অপবাদে আখলাখকে পিটিয়ে খুন করল কিছু উন্মত্ত গো-রক্ষক এর দল। কোথাও ঘরফেরতা জুনেঈদকে ট্রেনের মধ্যেই পিটিয়ে মারা হল। আবার কোথাও শুধু বিধর্মী হওয়ার অপরাধে সামান্য দিনমজুর আফরাজুলকে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়েছিল রাজস্থানে। কর্ণাটকের ম্যাঙ্গালোরে বা গোয়াতে ভাঙা হল গির্জা। কয়েক হাজার মানুষকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হল। উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান,হরিয়ানা,মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যে দলিত হওয়ার অপরাধে নির্যাতিত হল কয়েকশো মানুষ। তাদের নলকূপ থেকে পান করার জলটুকু পর্যন্ত সংগ্রহ করতে বাধা দেওয়া হয়েছিল অনেক জায়গায়। এর পাশাপাশি চলতে লাগল বিরুদ্ধ মতের কণ্ঠরোধ করা। যুক্তিবাদী, প্রতিবাদী গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকার, কালবুর্গী, গৌরী লঙ্কেশদের পরিণতির কথা সারা দেশ জানে। আর বিরোধী মানেই হয় ‘‌ভারত-বিরোধী’‌ বা ‘‌দেশদ্রোহী’‌ এই তকমা সেঁটে দেওয়া হল দেশের বরেণ্য মানুষজনের গায়ে। জাতীয়তাবাদের নামে চলতে লাগল স্বৈরাচারীর আগ্রাসন। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি আকাশচুম্বী হওয়ায় সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত হল। তার ওপর প্রধানমন্ত্রীর ‘‌তুঘলকি সিদ্ধান্ত’‌ নোটবন্দীর ফলে হাজার হাজার মানুষের কর্মহীনতা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বাজারে বিরাট মন্দা।

modi

গোটা দেশজুড়ে এই অস্থিরতার পরেও প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল কিন্তু নিজেদের ‘‌সাম্প্রদায়িকতার আলোয়ান’‌ খুলে ফেলেননি। বস্তুতঃ এইটাই তাঁদের একমাত্র সম্বল। কারণ জনহিতকর যে কোনও কাজ করতে তাঁর সরকার ব্যর্থ। তাঁর সরকার বেকারত্বের সমস্যা মেটাতে অপারগ। কয়েক হাজার কৃষক আত্মহত্যা করেছেন ফসলের দাম না পেয়ে। ক্ষুধার সূচক ১০০ ছুঁয়েছে এই সরকারের শাসনাধীনেই। এইসব সমস্যা থেকে দেশবাসীর দৃষ্টি ঘোরাতেই এই ‘‌চরম হিন্দুত্বের’‌ পথ নেওয়া। বিরোধীদের ভেঙে দেওয়া জাত ও ধর্মের ভিত্তিতে। যাতে নোটবন্দীর ফলে একজন হিন্দু ব্যবসায়ী যৌথভাবে একজন মুসলমান বা খ্রিষ্টান ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিরোধিতা করতে না পারে। বা যাতে একজন হিন্দু কৃষক একজন অ-হিন্দু কৃষকের সঙ্গে একযোগে আন্দোলনের রাস্তায় হাঁটতে না পারে, ঋণ মকুবের দাবিতে। ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই কারণেই এই বিভাজন। এক সম্প্রদায়ের মনে আরেক সম্প্রদায়ের সম্পর্কে বিষ ছড়ানো। দেশবাসীকে বিভক্ত করে দেওয়া । আসলে চূড়ান্ত ধনতান্ত্রিক এবং একইসঙ্গে স্বৈরতান্ত্রিক একটা সরকার এইভাবেই মানুষের বিশ্বাস, বা যা মানুষের কাছে পবিত্র, তাকে বিকিকিনির বাজারে টেনে নামিয়েছে। এইটাই আদপে একটা বুর্জোয়া শাসনব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি।

modi10

তাই আজও ধর্মীয় মেরুকরণই এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্যেই “সাম্প্রদায়িকতার তাস” খেলছে প্রধানমন্ত্রী ও শাসকদলের অন্যরা। যে কেরল কোনওদিন ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি, চিরকাল যুক্তি, বিচার ও মুক্তচিন্তার পথে হেঁটেছে, প্রধানমন্ত্রী সেই রাজ্যে গিয়ে প্রকারান্তরে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরোধিতা করে শবরীমালা মন্দিরে নারীর প্রবেশাধিকার নিয়ে কেরলের সরকারকে দোষারোপ করে এসেছেন শুধু সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যেই। সীমান্তে জ়ঙ্গি আক্রমণের ভারতের সেনাবাহিনীর ৪২ জন মারা যাওয়ার পরে ‘‌জাতীয়তাবাদের’‌ ধুয়ো তুলে দেশবাসীর সহানুভূতি আদায় করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। কাশ্মীরী ব্যবসায়ীদের ওপর নানা স্থানে ‘‌হিন্দুত্ববাদী’‌রা অমানবিক নির্যাতন করেছে। আর ভারতীয় সেনার জঙ্গিদমন অভিযানকে তিনি নিজের সাফল্য বলেই দাবি করছেন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছে তাঁর ‘‌বায়োপিক’‌। উদ্দেশ্য একটাই। জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার আবহ তৈরি করা সারা দেশজুড়ে। মালেগাঁও বিস্ফোরণে অভিযুক্ত একজনকে তাঁর দল প্রার্থী ও করেছে এবারের নির্বাচনে। আর এতসব কিছুর সঙ্গে রয়ে গেছে সেই বছরের পর বছর ধরে চলে আসা সাম্প্রদায়িকতার সেই ভয়াবহ তাস- অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ।
খাদ্য-বস্ত্রের সংস্থান করা নয়, দারিদ্র্যমুক্তি নয়, বেকারত্ব দূরীকরণ নয়, নারী সুরক্ষা নয়, কৃষকের ঋণ মকুব নয়, শ্রমিকের মজুরি নয়, শিক্ষার প্রসার ঘটানো নয়। হিন্দুত্ব ছাড়া বিজেপির হাতে আর প্রচারের মতো আছে কী?

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.