গুড় বাতাসার আত্মকথা

( বিধানসভা নির্বাচনের আবহ। সেবারও হুঙ্কার ছেড়েই চলেছিলেন অনুব্রত মণ্ডল। জাতে উঠেছিল গুড় বাতাসা। সেই অনুব্রত গ্রেপ্তার হতেই আবার যেন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে গুড়বাতাসা। পুরানো সেই লেখাটিকে একটু ফিরে দেখা। গুড় বাতাসার আত্মকথা।)

 

স্বরূপ গোস্বামী

এতদিনে আমি জাতে উঠলাম। আবার নতুন করে সবাই আমার কথা জানতে চাইছে। গত কয়েকদিনে সবথেকে বেশি যে মিষ্টির কথা আলোচনা হয়েছে, তা হল গুড়-বাতাসা। শক্তিগড়ের ল্যাংচা, বর্ধমানের মিহিদানা, কৃষ্ণনগরের সরভাজা, বেলিয়াতোড়ের ম্যাচা, বাগবাজারের রসগোল্লা- এদের সবাইকে আমি দশ গোল দিয়েছি। এই ভোটে কে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, কে সরকার গড়বে, তা নিয়ে বিতরত্ক চলুক। কিন্তু মিষ্টির বাজারে আমি যে চ্যাম্পিয়ন, তা নিয়ে আর কারও কোনও দ্বিমত থাকার কথা নয়। তার জন্য ১৯ মে পর্যন্ত অপেক্ষাও করতে হবে না।
অথচ, আমাকে সবাই ভুলতেই বসেছিল। এই প্রজন্ম না বোঝে গুড়, না বোঝে বাতাসা। বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, গুড়-বাতাসা কী, তা জানতে ওরা বারবার গুগল সার্চ করছে। ফেসবুক, হোয়াটসআপে আমার ছবির ছড়াছড়ি। লাইকের বন্যা বইছে, সঙ্গে নানারকমের কমেন্টস। ওহে ল্যাংচাবাবু, ওহে মিহিদানা, পারবে আমার সঙ্গে পাল্লা দিতে! এতদিন তোমাদের খুব দেমাক দেখেছি। আজ তোমাদের সবার জামানত বাজেয়াপ্ত।
সে এক সময় ছিল। একটু গরম পড়লেই গ্রামে গ্রামে ২৪ প্রহর বসত। আশাপাশের গ্রাম থেকে লোক আসত। যে মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে, তারা বাপের বাড়ি আসত। লাজুক মুখে নতুন জামাইও আসত। প্রায় সব বাড়িতে নানা প্রজাতির আত্মীয়।

gur batasa2
তখনও এগরোল, চাউমিন বা মোগলাইয়ের স্টল আসেনি। তখনও নতুন প্রজন্মের হাতে স্মার্ট ফোন আসেনি। তারা সারাক্ষণ ফেসবুক বা হোয়াটসআপে চোখ ও মন সঁপে দেয়নি। হরিবোল মানে ছিল কীর্তন। হরিমেলার আশেপাশে খাবারের দোকান বলতে ঘুগনি বা পাপড় ভাজা এবং অতি অবশ্যই বাতাসা। ঘুগনি বা পাপাড় ভাজা নিজেদের জন্য। বাতাসা ছিল ছড়ানোর জন্য। কচিকাচাদের বাতাসা কুড়োনোর সে কী হুড়োহুড়ি। একদিকে কৃষ্ণের (কেষ্ট) নাম, অন্যদিকে সেই মঞ্চেই বাতাসা ছড়ানো। কী আশ্চর্য, আজ যখন বাতাসাকে নিয়ে সারা বাংলা উত্তাল, তখনও আরেক কেষ্ট। আগে কেষ্ট ঠাকুরের উদ্দেশ্যে সবাই বাতাসা ছুঁড়ত। এখন কেষ্টবাবু তা ফিরিয়ে দিচ্ছেন।
মিষ্টি নিয়ে সব জেলার কিছু না কিছু বড়াই থাকে। কেউ বড়াই করত ল্যাংচা, মিহিদানা নিয়ে। কেউ বড়াই করত ম্যাচা, মন্ডা, প্যাড়া, নিখুতি নিয়ে। কেউ রসগোল্লা, পান্তুয়া নিয়ে। সেই লড়াইয়ে অনেকটাই পিছিয়ে ছিল বীরভূম। আমার উপস্থিতিকে কেউ পাত্তাই দিত না। মিষ্টির দুনিয়ায় আমি যেন ছাগলের তৃতীয় ছানা। একমাত্র হরিমেলা আর পুজোর ঘর ছাড়া আমার কোনও কদরই ছিল না। জানেন, মনে মনে খুব দুঃখ হত। কিন্তু কার কাছে সেই দুঃখের কাহিনী শোনাবো ?
যাক, একজন অন্তত বুঝেছে। লোকে বলে, অনুব্রত মণ্ডলের মাথায় নাকি অক্সিজেন যায় না। যাদের মাথায় অক্সিজেন যায়, তারা আমার জন্য কী করেছে ? লোকটাকে যে যতই গালাগাল দিক, তিনি কিন্তু আমার কথা ভেবেছেন। কলকাতা থেকে যত সাংবাদিক এসেছে, তিনি একটাই কথা বলে গেলেন, ভোটের দিনে গুড়-বাতাসা চলবে। নির্বাচন কমিশন শো কজ করল। তিনি তা সত্ত্বেও বলে গেলেন, গুড় বাতাসা চড়বে। চড়াম চড়াম ঢাক বাজবে। নির্বাচন কমিশন নজরবন্দী করল। তবুও তিনি বললেন, সব জায়গায় গুড়বাতাসা থাকবে।

anubrata3
একসঙ্গে সাতটা জেলায় ভোট হল। উত্তরবঙ্গের ছয় জেলা নিয়ে কারও কোনও আগ্রহই নেই। সবার চোখ বীরভূমে। সবার মনে একটাই শব্দ- গুড়বাতাসা। সব টিভি চ্যানেল জেনে গেছে, সব কাগজওয়ালারা জেনে গেছে। কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ জেনে গেছে, নরেন্দ্র মোদি জেনে গেছে। এমনকি নির্বাচন কমিশনের মাতব্বররাও ভাবছে, গুড়বাতাসা আসলে কী ?
গুড় বাতাসা আসলে কী ? যে যার মতো, মানে বের করে নিল। কেউ বলল, জমাট বাঁধা রক্ত। কেউ বলল, ওটা আসলে কোড ল্যাঙ্গুয়েজ। বাহিনীর জওয়ানদের জন্য ঢালাও মদ্যপানের ব্যবস্থা থাকবে। কেউ বলল, যে নিষেধ না মেনে ভোট দিতে যাবে, তার পিঠে উত্তম-মধ্যম। একেকজনের কাছে একেক মানে হোক, কথা একটাই, গুড়-বাতাসা।

 

যদি অপারেশন গুড়বাতাসা সফল হয়, কী কী হতে পারে, একবার ভেবে দেখেছেন ? মমতা হয়ত মোদির সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। সঙ্গে নিয়ে গেলেন গুড় বাতাসা। জামাই শ্বশুরবাড়িতে এল। হাতে গুড়বাতাসার প্যাকেট। বাড়িতে কেউ অতিথি এল, স্বচ্ছন্দে গুড়বাতাসা দিতে পারেন। কোথায় পাবেন? চিন্তা নেই, হলদিরাম বা কেসি দাসের আউটলেটে হয়ত পেয়ে যাবেন। কারও উপর রাগ হচ্ছে! বা হুমকি দিতে চান? চুপচাপ গুড়বাতাসা প্যাকেট করে তাঁর বাড়িতে কুরিয়ের করে দিন। সে যা বোঝার, বুঝে নেবে। অথবা, সামনে দাঁড়িয়ে কাউকে হুমকি দিতে চান। শুধু বলে দিন, বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোর গুড় বাতাসা করে দেব। ফ্লিপকার্ট বা স্ন্যাপডিলে অনলাইনে গুড়বাতাসার অর্ডার করতে পারবেন।
আরও কতকিছু ঘটতে পারে। রাজ চক্রবর্তী, সৃজিত মুখার্জি বা কৌশিক গাঙ্গুলির মধ্যে কেউ একজন গুড়বাতাসা নামে সিনেমা বানিয়ে ফেলতে পারেন। ব্রাত্য বসু যদি এই নামে নাটক লেখেন! সুবোধ সরকার তো চাইলে অনায়াসে একটা এই নামে কাব্যগ্রন্থ লিখে ফেলতে পারেন।
কত লোকের সামনে কত নতুন দিগন্ত খুলে গেল!
সত্যিই আমি জাতে উঠলাম।
অনুব্রত মণ্ডল, আপনার জন্য আমার নবজন্ম হল। আপনার কাছে আমি চিরঋণী হয়ে রইলাম। দিদির কাছে অনুরোধ, আবার যদি তিনি ক্ষমতায় আসেন, আপনাকে যেন গুড় বাতাসার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করা হয়।
একটু সাবধানে থাকবেন। আপনার অনেক শত্রু। কেউ যেন আপনাকে গুড়-বাতাসা না করে দেয়।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.