অনেক ক্ষত থেকেই গেল

সুবর্ণ ভট্টাচার্য

শুধু বাংলা উপন্যাস লিখে এত টাকা পাওয়া যায় ? তা দিয়ে যখন তখন, যেখানে সেখানে ফ্ল্যাট কেনা যায় ? কুড়ি বছর চাকরি না করেও সমুদ্রে বিশাল বাংলো বানানো যায় ? আয়েস করে কুড়ি বছর কাটানো যায় ? যদি কমলেশ্বর মুখার্জির ‘ক্ষত’ দেখেন, মনে হবে, সত্যিই হয়ত যায়।
কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে নারীদের ঘনিষ্ঠতা হয়, এ নতুন কিছু নয়। সেই ঘনিষ্ঠতায় অনেকের জীবন ওলট-পালট হয়ে যায়, এমনটাও দেখা যায়। কিন্তু একজন মাঝারি মানের বাংলা সাহিত্যিকের এমন রাজকীয় জীবন দেখে চোখে সর্ষেফুল দেখারই কথা।
কয়েকদিন ধরেই প্রচার, খুব সাহসী ছবি ‘ক্ষত’। কেউ বলছেন, বোল্ড ছবি। প্রসেনজিতেরও দাবি, এমন ছবি তিনি আগে কখনও করেননি। ভাগ্যিস করেননি। নইলে তাঁকে ঘিরে যে ‘মহানায়ক’ আবহ তৈরি হয়েছে, তা হত না। এতটা পথ পেরিয়ে এসে কেন যে এমন আজগুবি একটা ছবি করতে গেলেন!

khkawto2
ছবির প্রমোশনে ভাল ভাল কথা সবাইকেই বলতে হয়। বলিউডের এক তারকাকে প্রতিটি ছবি বেরোনোর আগে বলতে শুনেছি, এটাই নাকি তাঁর শ্রেষ্ঠ ছবি। হয়ত মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। কিন্তু প্রসেনজিতকেও যদি এই সস্তা বাক্যের আশ্রয় নিতে হয়, তাহলে কষ্ট হয় বৈকি।
ছবিতে তিনি একজন লেখক। নাম নির্বেদ লাহিড়ী। পত্রিকা অফিসে চাকরি করেন। বাড়িতে স্ত্রী রাইমা, ও সন্তানরা। রাইমার বন্ধু রাহুল। তার স্ত্রী পাওলি। নিজের বাড়িতে একটি অনুষ্ঠানে পাওলিকে দেখেই গেল মাথা ঘুরে। যেভাবেই হোক, তাকে চাই। এনে ফেলতে হবে বিছানায়। সুযোগও এসে গেল। রাহুলের চাকরি গেল, বিকল্প চাকরির ব্যবস্থা করলেন প্রসেনজিৎ। পাওলিও আস্তে আস্তে নিজেকে সঁপে দিলেন। বেশ চলছিল। বিপদ হল বেড়াতে গিয়ে। এই গোপন সম্পর্কের কথা জেনে গেলেন রাইমা। ছাড়াছাড়ি। আরও এক দফা বাকি ছিল। এবার গোপন অবস্থায় দেখে ফেললেন পাওলির স্বামী রাহুল। বেচারা আত্মহত্যা করলেন।

khawto3

তারপর থেকে প্রসেনজিৎ গেলেন স্বেচ্ছা নির্বাসনে। চাকরি ছেড়ে, লেখালেখি ছেড়ে বিরাট এক বাংলো নিলেন ওড়িশায়। কুড়ি বছর পর সেখানে হাজির এক নবীন প্রেমিক প্রেমিকা। শেষপর্বে জানা গেল, সেই প্রেমিক নাকি পাওলির ছেলে। আর পাওলি ? তিনি এখন অ্যাসাইলামে।
রাইমা কোথায় ? তাঁর সন্তানরা কোথায় ? আর কোনও হদিশ নেই। কুড়ি বছর কোনও খোঁজখবর ছাড়াই কীভাবে থেকে গেলেন লেখক, তাও জানা নেই। সারা পৃথিবীর নানা রকমের এলাহি রান্না। কুড়ি বছরের বেকার জীবনে রোজ রোজ সেই জোগাড় হয় কী করে?
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই স্মরণীয় সংলাপ উঠে এসেছে নির্বেদের কণ্ঠে- শরীর শরীর শরীর, তোমার মন নাই কুসুম। এখানে নায়কেরও বোধ হয় মন ছিল না। তাই শরীর নিয়েই মেতে থেকেছে। শরীরকে ঘিরেই যত ভাঙাগড়ার খেলা। আর সেটাই নিয়ে গেল চরম পরিণতির দিকে। ছবিটি ‘এ’ সার্টিফিকেট পেয়েছে। তাই বলা হচ্ছে সাবালক ছবি। কিন্তু সংলাপগুলি বেশ জোলো। একটা ‘বুদ্ধিজীবী’ ভাব আনার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোথাও তা মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ত্রিধা বা রণবীরের মতো এই প্রজন্মের কাপলরা কীভাবে তার সঙ্গে রিলেট করছেন, সেটা নিয়েও বড় প্রশ্ন।
এমন অনেক প্রশ্ন। তবে ছবির লোকেশন চমৎকার। কেওনঝড়েও দিব্যি তাহলে আউটডোর লোকেশান হয়। উঠে এসেছে পালামৌ জঙ্গল। তবে সেই জঙ্গলের সঙ্গে বাংলার, বাংলা সাহিত্যের এত স্মৃতি জড়িয়ে আছে, একটু তুলে ধরা যেত। বিশেষ করে একজন সাহিত্যিক যখন সঙ্গে গেছে, তার কথায় সঞ্জীবচন্দ্র, বিবূতিভূষণ বা বুদ্ধদেব গুহর কথা উঠে আসবে না?
সবমিলিয়ে ছবিটা খুব বেশি চলার কথা নয়। বাণিজ্যিক সাফল্যের আশা না রাখাই ভাল। চতুর্থ দিনেই মাল্টিপ্লেক্সের করুণ দশা। এক সপ্তাহে ফিকে হয়ে যাওয়ারই কথা। এই ছবি নাকি সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে। এগিয়ে থাকার এই যদি নমুনা হয়, তাহলে পিছিয়ে থাকলে কী হত!

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.