ডেঙ্গি হইতে সাবধান

কোথা থেকে এল এই ডেঙ্গি ? কতদিনের পুরানো ? কীভাবে বুঝবেন আপনার ডেঙ্গি হয়েছে ? হলে কী করবেন ? কখন হাসপাতালে ভর্তি হবেন ? এই রোগ এড়াতেই বা কী করবেন ? আমাদের মনে এসব নানা প্রশ্ন। সুন্দরভাবে সব উত্তর মেলে ধরলেন অ্যাপোলো গ্লেনেগিলসের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. সুশোভন মণ্ডল।।

dr susobhan monda

কলকাতাবাসীদের জন্য একটা কথা চালু আছে, ‘রাতে মশা, দিনে মাছি, এই বেশ ভাল আছি।’ কিন্তু মশা যে শুধু রাতেই কামড়ায় না, দিনেও কামড়ায়, তা বোধহয় বঙ্গবাসীদের থেকে এখন কেউ ভাল জানে না। ডেঙ্গির মশা, যার বিজ্ঞানসম্মত নাম এডিস ইজিপ্টি, সাধারণত দিনে কামড়ায়। সুতরাং, শুধু রাতেই নয়, দিনের বেলাতেও আমাদের সাবধানে থাকতে হবে, যাতে মশা না কামড়াতে পারে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ম্যালেরিয়ার জীবানুবহনকারী মশারা রাতে কামড়ায়। এই মশারা যখন ওড়ে, তখন পু-পু করে আওয়াজ হয়। ডেঙ্গির মশাদের ক্ষেত্রে এরকম আওয়াজ হয় না ঠিকই, কিন্তু এদের চেনার উপায় হচ্ছে গায়ে ডোরাকাটা দাগ। যাই হোক, ডেঙ্গি প্রসঙ্গে আসা যাক।

ডেঙ্গির ইতিহাস

ডেঙ্গি শব্দটি সোয়াহিলি ভাষা ডিঙ্গা থেকে এসেছে। যার অর্থ সাবধানতা। ডেঙ্গি আক্রান্তরা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথার জন্য খুব ধীরে চলেন, মনে হয় যেন সাবধানে চলছেন। সেই থেকে এই ডিঙ্গার ব্যবহার। এই অসুখের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে এক চিনা মেডিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়াতে ২৬৫-৪২০ খ্রীষ্টাব্দে জিন সাম্রাজ্যে ডেঙ্গির মতো এক অসুখের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম সুনিশ্চিত ডেঙ্গির কথা পাওয়া যায় ১৭৮৯ সালে, যার ব্যাখ্যা করেন বেঞ্জামিন রাস। তিনি হাড়ভাঙ্গা রোগ বলে অসুখটির বিবরণ দেন। সুতরাং, ডেঙ্গি বহুদিন ধরেই মানুষকে আক্রান্ত করছে।

ডেঙ্গির প্রকারভেদ
ডেঙ্গির কারণ হল ডেঙ্গি ভাইরাস। যার বাহক হল এডিস ইজিপ্টি মশা। যার কামড়ে মানুষের রক্তে এই ভাইরাস প্রবেশ করে এবং ডেঙ্গি হয়। এটি একপ্রকারের ফ্লাডি ভাইরাস। এই ডেঙ্গি আবার চার প্রকারের হয়।
ডেঙ্গি-১, ডেঙ্গি-২, ডেঙ্গি-৩, ডেঙ্গি-৪।
এই বছর শ্রীরামপুরে ডেঙ্গি আক্রান্তদের রক্তের নমুনা থেকে ডেঙ্গি-২ কে চিহ্নিত করা হয়েছে। এবং তা নিয়ে যথেষ্ট হইচই পড়েছে। এর কারণ ডেঙ্গি-২ অন্য তিন ভাইয়ের থেকে একটু বেশিই আক্রমণাত্মক। রক্তে এদের সংখ্যা বা যাকে বলে ভাইরাল লোড, খুব বেশি থাকে। তার ফলে, ডেঙ্গির দরুণ অন্যান্য প্রতিক্রিয়া বা জটিলতা বেশি হয়। ১৯৯৬ সালে দিল্লিতে ডেঙ্গি-২ এর এপিডেমিক হয়েছিল।

ডেঙ্গির লক্ষ্মণ

ডেঙ্গি হলে জ্বর, গায়ে ব্যথা, মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা ও চোখের ভেতরে ব্যথা হতে পারে। গায়ে ছোট ছোট লাল দাগ দেখা যেতে পারে। যে সমস্ত মহিলাদের জ্বরের সময় মেনুস্ট্রিয়াল পিরিয়ডের সময় হয়ে আসে, তাদের রক্তক্ষরণ অনেক বেশি হয়। ডেঙ্গিতে শ্বেত রক্তকণিকা ও অনুচক্রিকা (platelet) কমতে শুরু করে। অনুচক্রিকা কমতে কমতে যদি বিপদসীমার নিচে চলে যায়, বা অনুচক্রিকা কমার হার যদি অনেকটা হয়, তাহলে চিকিৎসকেরা অনুচক্রিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যাকে বলে platelet transfusion . বাজারে পেপে পাতার রসের খুব প্রচলন হয়েছে অনুচক্রিকা বাড়ানোর জন্য। কিছু ওষুধের কোম্পানি ট্যাবলেটের আকারে বাজারে বের করেছে। এ প্রসঙ্গে বলা ভাল, এর প্রয়োগে অনুচক্রিকা বাড়ে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। এর জন্য আরও ক্লিনিক্যাল স্টাডির প্রয়োজন আছে।

dengu

এই অনুচক্রিকা কমে যাওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। যেমন নাক, দাঁতের মাড়ি, পাকস্থলি ইত্যাদি। এবং শরীরের চামড়ার তলায় ছোপ ছোপ লালচে দাগ দেখা যেতে পারে। যার অর্থ চামড়ার তলায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে। একে ডেঙ্গি হেমারেজিক ফিভার বলে। এই রক্তক্ষরণ চলতে থাকলে দেহে রক্তের পরিমাণ কমে যায় এবং বিভিন্ন অঙ্গে রক্তের সঞ্চালন সঠিক পরিমাণে হয় না। এই ভয়ঙ্কর অবস্থাকে ‘ডেঙ্গি শক সিনড্রোম’ বলে। এছাড়াও ডেঙ্গির জন্য পেটে বা ফুসফুসে জল জমতে পারে। যাকে ডেঙ্গি ক্যাপিলারি লিক সিনড্রোম বলা হয়। এর থেকেও শক সিনড্রোম হতে পারে। এছাড়াও, ডেঙ্গির জন্য মানুষের রোগ প্রতিরোধকারী সিস্টেম বিপজ্জনক রূপ নিতে পারে। এই ভয়ঙ্কর কমপ্লিকেশনটির নাম ম্যাক্রোফাজ অ্যাক্টিভেশন সিনড্রোম।

কখন হসপিটালে ভর্তি হতে হবে ?

কী কী হলে আপনাকে হসপিটালে ভর্তি হতে হবে? যদি আপনার পেট ব্যথা হয়, বা খুব বমি হয়, পেটে বা ফুসফুসে জল জমে, অথবা রক্তক্ষরণ হয়।

ডেঙ্গির পরীক্ষা
ডেঙ্গি জ্বরের প্রথম এক থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে এন এস ওয়ান অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করলে ডেঙ্গি ধরা পড়তে পারে। সুনিশ্চিত পরীক্ষার জন্য ডেঙ্গি সেরোলজি পজিটিভ আসে জ্বর শুরুর ৬ দিনের পর থেকে।

সতর্কতামূলক পদক্ষেপ

বর্তমানে ডেঙ্গি ভাইরাস মারণকারী কোনও ওষুধ নেই। শুধু কমপ্লিকেশনের চিকিৎসা করা হয়। তাই আমাদের উচিত, সেইসব দিকে নজর দেওয়া, যাতে মশা না কামড়াতে পারে। সাধারণত, ডেঙ্গির মশা ঘরের আশি মিটারের মধ্যে বসবাস করে। তাই এই চত্বরে কোনও জল জমতে দেওয়া যাবে না। টব ও এসি মেশিনের জল নিয়মিত পরিষ্কার করা উচিত। অথবা আমাদের দৈনন্দিন ব্যস্ত জীবনে পর্যাপ্ত সময় না পাওয়া গেলে জলের মধ্যে নুন ফেলে দিলে মশার লার্ভা বেঁচে থাকতে পারে না। দিনের বেলায় ফুলহাতা জামা ও ফুলপ্যান্ট পরে থাকলে অনেকটাই নিশ্চিন্ত। এছাড়াও বিভিন্ন মশা বিতাড়নকারী ওষুধ তো আছেই। একটি কথা মনে রাখা দরকার, জ্বর এবং ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাজার-চলতি এন এস এ আই ডি জাতীয় (পেইনকিলার) ওষুধ খাবেন না। তাতে রক্তে প্লেটলেটের পরিমাণ আরও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

সুতরাং, যদি আপনার বাড়িতে মশা থাকে, আপনি বাড়ির সামনে লিখে রাখতেই পারেন, মশা হইতে সাবধান।

(লেখক অ্যাপোলো গ্লেনিগেলস হসপিটালের চিকিৎসক)

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.