ক্যাশলেস

খুচরোর আকাল। ব্যাঙ্ক, এটিএমে লম্বা লাইন। কীভাবে সামাল দিচ্ছেন মধ্যবিত্ত। একটি গল্পে উঠে এল সেই ছবিটা। এই সময়ের পটভূমিতে লিখেছেন সব্যসাচী কুণ্ডু।

বাজারের থলি হাতে সুজয় বাজার করতে বের হচ্ছিল। মিতা এসে বলল, বাবু আজ মটন খেতে চাইছে, বাজার করে ফেরার পথে যেন মটনটা নিয়ে আসে। আচ্ছা, বলে সুজয় বেরিয়ে পড়ল। অন্য দিনের মতো রবিবারটাও সুজয়ের বেশ ব্যস্ততার মধ্যেই কাটে। অন্যদিন অফিস আর বাড়ি করেই কেটে যায় আর রবিবারটা সবজি বাজার, হাটমশলা আর বাড়ির টুকটাক কাজ করেই কখন যে সময় পেরিয়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না।
বাজারে পৌঁছে সুজয় ঠিক করলো আগে ভজহরিদার দোকান থেকে খাসি মাংসটা নিতে হবে। দেরি করে গেলে যদি ভালো মাংসটা না পাওয়া যায়! ভজহরিদা দেখতে পেয়েই এক গাল হেসে বললেন, “আসুন দাদাবাবু। কতো দেবো? বেশ তাজা মাংসটা আছে।” সুজয় বলল, “এক কেজি দিন আর দেখবেন চর্বি যেন না থাকে।” আচ্ছা বলে ভজহরিদা কাজে লেগে গেল। সুজয় বুক পকেট থেকে বাজারের লিস্টটা বের করে একবার চোখ বুলিয়ে নিল, কিছু লিখতে ভুলে যাইনি তো। একটু পরে ভজহরিদা মাংসটা দিয়ে বললেন, “আসুন দাদাবাবু।” সুজয় মাংসটা থলিতে ঢুকিয়ে পেছনের পকেটে হাত দিতেই বুকটা ছ্যৎ করে উঠল। যা! মানিব্যগটাই তো বাড়িতে রয়ে গেছে। এখন উপায়! আবার বাড়ি যেতে আসতে তো অনেক সময় নষ্ট হয়ে যাবে। ভেবেছিল বাজার করে এসে বাবুকে নিয়ে একবার সেলুনে যাবে। বাবুর চুলগুলো বেশ বড় হয়েছে। ভজহরিদা হয়ত ধারে দিয়ে দেবে কিন্তু ধার নেওয়াটা সুজয় পছন্দ করে না। তাই অনেক ভেবে সুজয় মাংসটা ভজহরিদাকে ফেরত দিয়ে বলল, “আমার মাংসটা একটু সাইড করে রাখুন, মানিব্যগটা আনতে ভুলে গেছি। ওটা নিয়ে এসে মাংসটা নিয়ে যাব।” আজ বাজার করবে বলে সুজয় কালকেই এ টি এম থেকে প্রায় একঘণ্টা লাইনে দাড়িয়ে টাকা তুলেছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান ভজহরিদাই করে দিলেন। বললেন, “টাকা নেই তো কি হয়েছে, বুক পকেটে আপনার স্মার্ট ফোনটা উঁকি দিচ্ছে, পে টি এম আছে নিশ্চয়। তাহলে পে টি এম করে দিন।” সুজয় আশ্বস্ত হয়ে তাই করে দিল। একটা সমস্যা তো মিটল, কিন্তু তারকারি কিনতে তো টাকা লাগবেই। তাই সুজয় বাড়ির পথ ধরল। রাস্তায় ঘোষদার সাথে দেখা। সুজয়ের অফিসের কলিগ। “ কি সুজয়বাবু খালি ব্যগ নিয়ে চললে কোথায়? বাজার করবে না? বেলা তো অনেক হল। বেশি দেরি করলে কিন্তু টাটকা সবজিগুলো সব হাতছাড়া হয়ে যাবে।” ঘোষদা কে ব্যাপারটা বলতেই উনি হো হো করে হেসে উঠলেন, “এই দেখো, তুমি দেখছি আমাদের বাজারে অনেকদিন আসোনি। সব্বাই এখন পে টি এম আর কী বলে যেন সুইপ মেশিন চালু করে দিয়েছে। কুছ পরোয়া নেহি, এসো।” সুজয় বুক পকেটে হাত দিয়ে দেখল হ্যাঁ কার্ড ফোল্ডারটা আছে।

RPT---Balurghat: A person pays his bill at a tea stall using Paytm app at Balurghat in South Dinajpur on Saturday. PTI Photo(PTI12_3_2016_000055B)
বাজারে গিয়ে দেখল, সত্যি তো সব যেন কেমন রাতারাতি পাল্টে গেছে। প্রথমেই সুনীলদার আলু পেঁয়াজের দোকানে গেল। দেখল, সুনীলদা একমনে আলু পেঁয়াজ ওজন করে খদ্দেরদের দিচ্ছেন আর ওনার ছেলে সবার থেকে হিসাব করে করে দাম নিচ্ছেন। কেউ টাকায় দাম মেটাচ্ছেন কেউবা কার্ডে। সুজয় আলু, পেঁয়াজ, আদা, রসুন নিয়ে এ টি এম কার্ডে দাম মিটিয়ে অন্য দোকানে চলল। যেতে যেতে মালঞ্চদির দোকানে বেশ তাজা তাজা ফুলকফি দেখতে পেল। দেখেই ইচ্ছে করছে নিতে। কিন্তু পকেটে তো টাকা নেই। হঠাৎ দোকানের খুঁটিতে একটা সাইন বোর্ড দেখতে পেল। “পে টি এম এক্সসেপটেড হেয়ার।”নিচে একটা মোবাইল নাম্বার। আরও নিশ্চিত হতে সুজয় মালঞ্চদিকে জিজ্ঞেস করল, “কি গো মালঞ্চদি তুমিও পে টি এম চালু করে দিয়েছ।” শুনে একগাল হেসে মালঞ্চদি বলল কী করব বলুন দাদাবাবু, না করে উপায় আছে?‌ আমার ব্যবসাটাই তো উঠে যাচ্ছিল। তবে খুব সুবিধা হয়েছে জানেন। খুচরো নিয়ে ঝামেলা অনেক মিটে গেছে। আর বিক্রি বাটা আগের থেকে অনেক বেড়ে গেছে। তা আপনাকে কী দেব বলুন, এই দেখুন তাজা ফুলকফি আছে, গাজর আছে, বেগুন আছে, দিন থলিটা।” সেখান থেকে জিনিস পত্র নিয়ে সুজয় মাছের বাজারে চলল। কানুদার দোকান থেকে টাটকা দেখে এক কেজি রুই মাছ নিয়ে, পে টি এমে দাম দিয়ে সুজয় বাড়ির রাস্তা ধরল। হঠাৎ মিতার ফোন। “হ্যালো, এই তুমি তো মানিব্যগটাই ভুলে গেছ, বাজার করবে কী করে।” সুজয় বলল, “কুছ পরোয়া নেহি গিন্নি, বাজার হয়ে গেছে, বাড়ি এসে সব বলছি।”

মিতা সব শুনে তো খুব খুশি, বলল, “যাক বাবা বাঁচা গেছে, হাটমশলাটা না হয় বিগ বাজার থেকে হয়ে যাবে কিন্তু এই সবজি বাজারটা নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম। এ টি এমে যা লম্বা লাইন। তাও তো সব এ টি এমে টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না।” সুজয় বলল, “আরে বিগ বাজার তো আছেই, পাড়ার দোকানেও তো পে টি এম আর কার্ড চালু করে দিয়েছে। হাটমশলাটা বরং বিকেলে এনে দেব।” চায়ের কাপটা নিয়ে সুজয় জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, মোড়ের মাথায় কোন রাজনৈতিক দলের সভা হচ্ছে মনে হচ্ছে। কেউ একজন ভাষণ দিচ্ছেন। “ বন্ধুগন, প্রধানমন্ত্রী সাধারণ মানুষের সব টাকা আত্মসাৎ করে নিয়েছেন। আজ সাধারণ মধ্যবিত্তের বাড়িতে হাড়ি চড়ছে না। কোনও এ টি এমে টাকা নেই, ব্যাংক বলছে টাকা নেই আর উনি ক্যাশলেস সোসাইটির কথা বলছেন। স্বাধীনতার প্রায় ঊনসত্তর বছর অতিক্রান্ত কিন্তু আজও দেশের প্রায় ষাট শতাংশ মানুষের ব্যঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই তাহলে উনি কোন মুখে ক্যাশলেস সোসাইটির কথা বলেন। ওনাকে এর জবাব দিতে হবে। উনি গরিবদের অপমান করেছেন ওনাকে ক্ষমা চাইতে হবে। আসুন আমরা দলমত নির্বিশেষে গর্জে উঠি। বাহাত্তর ঘণ্টার জন্য ভারত বন্ধ ডাকি।”শুনতে শুনতে সুজয় ভাবল, বাঃ রে এতদিন ক্ষমতায় থেকেও তোমরা গারিবি দূর করতে পারলে না, দেশের মানুষকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দিতে পারলে না। মানে নিজের মুখেই স্বীকার করছ যে এতদিন ক্ষমতায় থেকেও তোমরা মানুষের জন্য কিছু করনি। আজ একজন চাওয়ালার ছেলে দেশকে ডিজিটাল করতে চাইছে ক্যাশলেস সোসাইটি গড়তে চাইছে আর তোমরা ওমনি কাঠি করা শুরু করে দিয়েছ। যদি উনি দেশের জন্য স্বপ্ন দেখতে পারেন তাহলে আমরা সেটা সফল করার জন্য একটু সহযোগিতা তো করতেই পারি। এমন সময় মিতা এসে বলল, “ওই সব গুলবাজি না শুনে তাড়াতাড়ি বাবুকে নিয়ে সেলুনে যাও, দেরি করে স্নান করলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে যে।”

 

flipkart-bigshoppingdays

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.