অন্য অরবিন্দ, অন্য বারীণ, নতুন ভাবনা বয়ে আনল ব্রাত্যর বোমা

আজ পনেরোই আগস্ট। সবাই জানেন স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু তার আড়ালে আরও অনেক কিছু। যেমন, ঋষি অরবিন্দর জন্মদিন। এই সময়ের সাড়াজাগানো নাটক ‘বোমা’। সেখানে উঠে এসেছে অরবিন্দর কথা। সেই নাটকের রিভিউ লিখলেন নন্দিনী মুখার্জি।।

ব্রাত্য বসুর বোমা নাটকে প্রাক স্বাধীনতা আমলের ভারতবর্ষে সশস্ত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটটিকে ধরা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটের কেন্দ্রীয় চরিত্র অরবিন্দ ঘোষ। নাটকের প্রথম অর্ধে তার উপস্থিতি মাত্র দুটি দৃশ্যে। কিন্তু অদৃশ্য সত্তার মতো তিনি আছেন সব কিছুর মধ্যেই। তিনিই বিপ্লবী দলের নেতা “বড়কর্তা।” আবার বিরতির পরে তিনি বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ছেড়ে দিলেও ধ্যানের চোখে দেখতে পাচ্ছেন, ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশের বিদায়ের ঘণ্টা বেজে গিয়েছে। কিন্তু তিনি এটাও দেখতে পাচ্ছেন যে, সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাত, পরনিন্দা, গোষ্ঠীবাজি থেকে ভারতবাসী মুক্তি পাবে না। পরস্পরের দিকে বোমা ছুঁড়তেই থাকবে।

boma2
নাটকের প্রথমার্ধের কথায় আগে আসি। সময় ১৯০৮ সাল, স্থান উত্তর কলকাতার মানিকতলা। যেখানে একটি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সাধুসন্ত থাকেন, নামগান হয়, শরীরচর্চা হয়। কিন্তু ভিতরে ভিতরে নিঃশব্দে চলে বোমা বানানো, নানা সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম। বারীন ঘোষ (শ্রী অরবিন্দের ভাই), উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র কানুনগো প্রভৃতি নেতারা এই প্রতিষ্ঠানে দেশের জন্য কাজ করেন।
নাটকের মাধ্যমে আমরা দেখি শ্রী অরবিন্দ সশস্ত্র বিপ্লব থেকে নিজেকে আস্তে আস্তে সরিয়ে নিচ্ছেন। তিনি কলকাতা শহরেই আলাদা ভাবে থাকেন। নাটকের একটি দৃশ্যে বারীন ঘোষ তার দাদার সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। অরবিন্দ তখন গুরুর কাছে যোগচর্চা করছেন। বারীন নেতৃত্বের নেশায় পাগল। তাঁর ধারণা, শ্রী অরবিন্দের থেকেও তিনি বড় বিপ্লবী। কিন্তু শ্রী অরবিন্দ তাঁকে অকারণ হত্যালীলা বন্ধ করতে বলেন। তিনি বলেন, “যদিও জানি তুমি আমার কথা শুনবে না, কিন্তু তোমাদের তৈরি এই বোমাই একদিন তোমাদের দিকে ছুঁড়ে মারা হবে, এই কথাটা বারীন তুমি মনে রেখো।”
নাটক এগিয়ে চলে। আলিপুর বোমা মামলায় শ্রী অরবিন্দ সহ বারীন ও অন্যান্য নেতারা গ্রেপ্তার হন। বোমা তৈরির কারখানাতেও হানা দেয় পুলিশ। কিন্তু শ্রী অরবিন্দ নির্বিকার। নিজের প্রতি আস্থা তাঁর ষোল আনা। তিনি ব্রিটিশ পুলিশকে জানিয়ে দেন এই সমস্ত কার্যকলাপের সঙ্গে তাঁর কোনও যোগ নেই। অবশেষে প্রখ্যাত ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাশ মামলা লড়ে ব্রিটিশ পুলিশকে হতভম্ব করে দিয়ে, শ্রী অরবিন্দকে বেকসুর খালাস করিয়ে আনেন। কিন্তু অন্য বিপ্লবীদের কঠিন শাস্তি হয়। কারও ফাঁসি, কারও দ্বীপান্তর। এই সময় হেমচন্দ্র কানুনগো চিৎকার করে অরবিন্দকে বলেন, আপনি শুধু নিজেকেই বাঁচালেন? আপনি কাপুরুষ।
নাটকের একেবারে শেষ পর্বে, যেন এই অভিযোগের জবাব দেওয়ার জন্যই, কল্পনা নামে সশস্ত্র বিপ্লবের এক নেত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন, শ্রী অরবিন্দ। তখন তিনি ঋষি। পণ্ডিচেরিতে থাকেন। কল্পনার কাছে ঋষি অরবিন্দ বলে যান নিজের জীবন দর্শন। আসলে জীবন যতই সামনের দিকে এগিয়েছে, ততই তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছে, মহামূল্যবান মানব জীবনের উদ্দেশ্য কী? কী আমাদের প্রকৃত কর্ম হওয়া উচিত? পরাধীন ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ তাড়িয়ে স্বাধীনতা এলে মানবিকতা, প্রগতি এগুলোও একই সঙ্গে আসবে তো? নাকি ব্রিটিশ রাজাদের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে দেশি রাজাদের হাতে? আর আপামর জনগণের জীবনযাত্রার মান একই থাকবে? আসলে ক্ষমতার মাহাত্ম্য এমনই যে তাতে অধিকাংশ মানুষের মাথাই ঘুরে যায়। তাঁদের পদস্খলন হয়, পাপ বাড়তে থাকে।– এই বোধটি যতই ওঁর ভেতরে জেগেছে, ততই উনি সক্রিয় রাজনিতি থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন।

boma3
শেষ দৃশ্যে পণ্ডিচেরিতে সমুদ্রের তীরে ঋষি অরবিন্দ বসে আছেন, ধীরে ধীরে সূর্যোদয় হচ্ছে, কল্পনা তাঁর নিজের জীবনের কিছু ঘটনা বলে প্রশ্ন করছেন, তিনি ঠিক করেছেন কিনা? যা যা করেছেন তা অকপটে বলে চলেছেন, উনি স্থিরভাবে সব কথা শুনছেন, অস্থির নেত্রীকে শান্ত করছেন। ওই মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে নেত্রীর মন ধীরে ধীরে শান্তি পাচ্ছে। তিনি ঋষি অরবিন্দের সান্নিধ্যে এসে জীবনের সম্পূর্ণতা খুজে পাচ্ছেন।
আলো, ধ্বনি, অপূর্ব অভিনয় সব মিলে নাটকে শ্রী অরবিন্দের চরিত্রটি জীবন্ত করে তুলেছেন দেবশঙ্কর হালদার। বিশেষত শেষ দৃশ্যে শ্রী অরবিন্দর বিপ্লবী থেকে আধ্যাত্মিক চেতনাসমৃদ্ধ ঋষিতে রূপান্তর দর্শক হিসাবে আমাদের মুগ্ধ করে। এই মুগ্ধতার রেশ নিয়েই বাড়ি ফিরেছি আমরা।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.