নিজের ফোকাস নিজেই নষ্ট করলেন রোনাল্ডো

সরোজ চক্রবর্তী

বয়স ৩৮ ছুঁইছুঁই। আন্তর্জাতিক ফুটবলের নিরিখে অস্তগামী সূর্যই বলা যায়। চার বছর পর বয়স দাঁড়াবে ৪২। সেই বয়সে কি আর দেশের জার্সি গায়ে দেখা যাবে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে?‌ খুবই কষ্টকল্পনা। ৪২ বছরে কি কেউ বিশ্বকাপে খেলেননি?‌ ইতিহাস ঘাটলে এমন নজির নিশ্চয় পাওয়া যাবে। কিন্তু রোনাল্ডো যে খেলবেন না, সেটা হলফ করেই বলা যায়। তিনি রোনাল্ডো। পেলে–‌মারাদোনা পরবর্তী প্রজন্মের অন্যতম মহানায়ক। তিনি খামোকা পার্শ্বচরিত্র হতে যাবেন কেন?‌

ক্লাব ফুটবলের সব ট্রফিতেই লেখা রয়েছে তাঁর নাম। একবার নয়, দু’‌বার নয়। পাঁচ পাঁচবার ব্যালন ডি’‌ওর খেতাব। প্রায় দেড় দশক ধরে মেসির সঙ্গে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের তুলনা চলেছে। দেশের হয়ে গোলের হিসেবে অতীতের সব দিকপালদের ছাপিয়ে গেছেন। একজনকে মহাতারকা খ্যাতি পেতে গেলে আর কী চাই?‌ যেটা নেই, সেটা হল বিশ্বকাপ। বিদায়বেলায় পরিসংখ্যান যতই তাঁর হয়ে সাফাই দিক, একটা অপ্রিয় প্রশ্ন ধেয়ে আসবেই, এতকিছু করেছো। কিন্তু বিশ্বকাপটা তো দিতে পারোনি।

এই প্রশ্নটা বছরের পর বছর তাড়া করে আসছে মেসিকেও। তিনি তবু ২০১৪ তে দলকে ফাইনালে তুলেছিলেন। কিন্তু বিশ্বকাপের আসরে সিআর সেভেনের ট্র‌্যাকরেকর্ড বেশ খারাপ। ২০০৬ এর পর থেকতে কোনওবার কোয়ার্টার ফাইনালেই পৌঁছতে পারেনি পর্তুগাল। প্রতিবার তাঁকে ঘিরে স্বপ্ন দেখেছেন পর্তুগালের জনতা। স্বপ্ন দেখেছেন তামাম বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা অনুরাগীরা। প্রতিবারই তাঁদের চূড়ান্ত হতাশ করেছেন রোনাল্ডো। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা কি তাঁকেও তাড়া করেনি?‌

মাঝে মাঝেই প্রশ্ন ওঠে, ক্লাবের হয়ে খেলার ব্যাপারে যতটা আগ্রহী, দেশের হয়ে সেই তাগিদটা যেন থাকে না। কী করে ভুলে যাবেন ২০১৬–‌র সেই ইউরো ফাইনালের কথা। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ফাইনাল। প্রথমার্ধেই এমন চোট পেলেন, স্ট্রেচারে মাঠ ছাড়তে হল। এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে কোনওরকমে এসে দাঁড়ালেন রিজার্ভ বেঞ্চে। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে সমানে চিৎকার করে গেলেন সতীর্থদের জন্য। যখন শেষ বাঁশি বাজল, আবেগে যেন হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন। যন্ত্রণা আর স্বপ্নপূরণের আনন্দ যেন মিলেমিশে একাকার।

এই রোনাল্ডো পরিশ্রমে এতটুকু শিথিলতা দেখান না। ফিটনেস সম্পর্কে সবসময় বাড়তি সচেতন। এই বয়সেও এতটু উঁচুতে লাফিয়ে হেড করেন, যা বিপক্ষের ডিফেন্ডাররা নাগাল পান না। এই বয়সেও যাবতীয় ট্যাকলকে টপকে এগিয়ে যেতে পারেন। দূর থেকে যেমন জোরালো শট নিতে পারেন, তেমনই ভিড়ের মাঝে অল্প জায়গায়, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যা করার, করেও দিতে পারেন। প্রশ্ন হল, নিজের শেষ বিশ্বকাপে নিজের অস্ত্রগুলো ঠিকঠাক প্রয়োগ করতে পারবেন কিনা।

একবার দেখে নেওয়া যাক গ্রুপে কারা আছে। ঘানা, উরুগুয়ে, দক্ষিণ কোরিয়া। পরের রাউন্ডে যেতে খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এবারের দল নিয়ে বেশ আশাবাদী সিআর সেভেন। দলের মধ্যে অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের একটা মিশেল আছে। আক্রমণে পাশে পাচ্ছেন আন্দ্রেয়া সিলভা, রাফায়েল লিয়াও, জোয়াও ফেলিক্সদের। মাঝমাঠ থেকে সাপ্লাই দেওয়ার জন্য আছেন ব্রুনো ফার্নান্ডেজ, বের্নাদো সিলভা, ভিতিনহার। রক্ষণে পেপে, রুবেল দিয়াস, জোয়াও কানসোনা, দানিলো পেরিয়া, দিয়েগো দালাত। সব যে পরিচিত নাম, এমন নয়। ক্লাব ফুটবলে কেউ কেউ এর মধ্যেই চমক দিয়েছেন। কেউ কেউ আবার কাতারে চমক দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন।

কিন্তু এরই মাঝে একটা বড়সড় বিপত্তি। আর সেই বিপত্তি কিনা বাঁধিয়ে বসেছেন স্বয়ং রোনাল্ডো। ম্যাঞ্চেস্টারের জার্সি গায়ে তাঁর সময়টা মোটেই ভাল যাচ্ছে না। নিজেকে একেবারেই মেলে ধরতে পারছেন না। কোচ এরিক টেন হ্যাগের সঙ্গে সম্পর্ক একেবারেই তলানিতে এসে ঠেকেছে। সেই বিতর্ক ভুলে দেশের জার্সিতে মনোনিবেশ করবেন, এটাই ছিল প্রত্যাশা। কিন্তু সম্পূর্ণ অযাচিতভাবে কিছু বিতর্ক ডেকে এনেছেন স্বয়ং সিআর সেভেন। ম্যান ইউর কোচকে আক্রমণ করে বলেছেন, এই কোচের প্রতি আমার কোনও শ্রদ্ধা নেই। আরও নানা কথা। যার প্রতিক্রিয়া সাঙ্ঘাতিক। কোচের ওপর তাঁর রাগ বা অভিমান থাকতেই পারে। কিন্তু এটা কি তা প্রকাশ্যে আনার সময়?‌ এই বিতর্কের জল কতদূর গড়াবে, রোনাল্ডো কি বুঝতে পারছেন না?‌ এতে ফোকাস নড়ে যাবে না তো?‌

পেশাদারি জগতে একটা কথা খুব চালু আছে— সুইচ অন, সুইচ অফ। অর্থাৎ, যখন তুমি একটা কাজ করছ, তখন অন্যগুলো ভুলে যাও। ফুটবলের ক্ষেত্রেও কথাটা ভয়ঙ্করভাবে খাটে, যখন দেশের হয়ে খেলছ, তখন দেশের হয়েই ভাবো। তখন ক্লাবের জটিলতার কথা ভাবতে যেও না। কিন্তু রোনাল্ডো সেই ক্লাবের বিতর্ককেই টেনে আনলেন। তাও আবার বিশ্বকাপের ঠিক দোরগোড়ায়। এর কী কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, সেদিকে চোখ যাবেই। জানতে না চাইলেও মোবাইল বেয়ে ঠিক পৌঁছে যাবে। যিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় এত ছবি ছাড়েন, তিনি বাইরের জগৎ সম্পর্কে নিস্পৃহ হতে পারেন না। বাইরের জগৎ তাঁকে প্রভাবিত করবেই। এমনিতেই বিশ্বকাপ মানে প্রত্যাশার চাপের পাহাড়। তার মাঝে এসব উটকো ঝামেলা ডেকে আনার কী দরকার ছিল?‌ রোনাল্ডোর মতো মহাতারকা কেন এমন ভুল করে বসলেন?‌ পর্তুগাল দ্রুত ছিটকে গেলে এই ছোট্ট প্রশ্নটাই হয়ত আরও বিশাল আকারে দেখা দেবে।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.