‌স্বপ্নে জড়ানো ছেলেবেলার চড়ুইভাতি

অন্তরা চৌধুরি

শীতকাল এলেই মনটা কেমন পিকনিক পিকনিক করে ওঠে। মনে হয় একছুটে চলে যাই কাছে-দূরে। কিন্তু পিকনিকের বদলে যদি বলা হয় চড়ুইভাতি, তাহলে অনেকের কাছেই ব্যাপারটা অচেনা ঠেকবে। কারণ চড়ুইভাতি বা বনভোজন শব্দটার সঙ্গে আধুনিক প্রজন্ম তেমন পরিচিত নয়। এখনকার পিকনিক মানে তো কোনও বিশেষ জায়গায় দল বেঁধে বেড়াতে যাওয়া। খাওয়া দাওয়া নিয়ে নো টেনশন। তার জন্য ক্যাটারিং বা রান্নার ঠাকুর আছে। থাকে রসনা পরিতৃপ্তির হরেকরকম আয়োজন। চিকেন পকোড়া থেকে বিরিয়ানি। ভাত বাঁধাকপির তরকারি মাং চাটনি-এসব সাবেকিয়ানার এখন নো এন্ট্রি। আর নিজেদের হাত পুড়িয়ে রান্নার করার তো কোনও গল্পই নেই। স্রেফ এনজয়মেন্ট।

কিন্তু এই পিকনিকে মজা কোথায়! এগুলো তো কর্পোরেট পিকনিক। নিজের হাতে রান্না না করলে কি আর পিকনিক জমে! বাঁধাকপিতে যদি একটু পোড়া গন্ধ না ছাড়ে, মাংসে যদি একটু বেশি নুন না হয় তাহলে আর পিকনিক হল কই! আমাদের ছোটবেলায় ছিল বনভোজন বা চড়ুইভাতি। আমরা যারা আশি নব্বইয়ের দশকে বেড়ে উঠেছি তারা ব্যাপারটা ভাল বুঝতে পারবেন। স্কুল বা টিউশনের বন্ধুরা মিলে মোটামুটি একটা কাছেপিঠে জায়গা ঠিক করে নেওয়া হত। সেই জায়গার তেমন কৌলীন্য না থাকলেও চলবে। কেবল একটু গাছপালা, পুকুর বা নদী আর নির্জনতা-এই ছিল ক্রাইটেরিয়া। জিনিসপত্রের মোটামুটি একটা আন্দাজ দাম ধরে নিয়ে একটা নির্দিষ্ট চাঁদা তোলা হত। টিমে একজন বা দুজন ম্যানেজার গোছের থাকত। তারাই কেনাকাটার যাবতীয় দায়িত্ব সামলাতো। কোথায় ডিম, কোথায় কেক, তরিতরকারি, তেলমশলা ইত্যাদি।

গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া তো দূরে থাক ভাবার সামর্থ্যটুকুও ছিল না। তাই প্রাণের চেয়ে প্রিয় সাইকেলই ছিল তখন একমাত্র ভরসা। সেই বিশেষ দিনটির আগমনের অপেক্ষায় দিন গুনতাম। মনের ভেতর উত্তেজনার চোরাস্রোত বইত। তবে চড়ুইভাতি করার আগে বাড়ির লোকের কাছে পারমিশন নিতে বোধহয় সকলেরই বুক কাঁপত। সারাদিন পড়াশোনা বন্ধ করে বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিক করতে যাওয়া ব্যাপারটায় বড়রা অতটা প্রশ্রয় দিত না। তাই আগের দিনগুলোতে সারাদিন পড়ার বিনিময়ে একটা দিন ছুটির ছাড়পত্র মিলত অনেক কষ্ট করে। আগে থেকে সবাই ঠিক করে নিত কে কোন জিনিসপত্র নিয়ে যাবে। সেই অনুযায়ী সবকিছু সাইকেলের পেছনে বেঁধে আগের রাত্রির থেকে রেডি করে রাখতাম।

তারপর শুরু হত আমাদের চড়ুইভাতি অভিযানের পালা। তখন ফোন ছিল না। তাই আগের যে যার মতো ভোরবেলায় উঠে আধো আলো আধো অন্ধকারে কুয়াশা ঢাকা রাস্তা ধরে ঠান্ডার মধ্যে কাঁপতে কাঁপতে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম সেই অচিনপুরের উদ্দেশ্যে। সেই বিশেষ জায়গায় পৌঁছে দেখতাম দলের ম্যানেজার আগেই হাজির হয়ে গেছে। এক এক করে সকলেই এসে জমা হল। হাঁড়ি কড়াই বনের ভেতরে রেখে আমরা বেরিয়ে পড়লাম খেজুর রসের উদ্দেশ্যে। সব দলেই গেছো টাইপের একজন থাকে। সে-ই
তরতর করে গাছে উঠে পেড়ে আনল হাঁড়ি ভর্তি খেজুর রস। পৌষের ভোরে এমন সুশীতল পানীয়ের কোনও তুলনা হয় না। রস পর্ব খাওয়া মিটে গেলে আমরা আবার ফিরে এলাম সস্থানে।

তারপর শুরু হল অপটু হাতে আমাদের সেই বনভোজনের প্রস্তুতি। কোনওরকমে তিনটে বড় সাইজের পাথর এনে উনুন তৈরি হল। দুজন গেল জঙ্গলে শুকনো পাতা আনতে। কাঠ জোগাড় করতে। তারপর চাপানো হল চা। একটু একটু করে সূর্যের আলো স্পষ্ট হচ্ছিল। সোনাঝুরি গাছের ফুল থেকে টুপ টুপ করে ঝরছে শিশির। সরষে ফুলের সুগন্ধে জড়ানো সে এক স্বর্গীয় ভোর। অবশেষে ধোঁয়ার গন্ধ মাখা চা তৈরি হল। তখন অত বাছবিচার ছিল না। নিজেরা করেছি সেটাই বড় ব্যাপার। সেই হি হি ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সেই চা পান করা হল। সঙ্গে ছিল বাপুজি কেক আর বাড়ি থেকে আগের রাত্রে সেদ্ধ করে রাখা ডিম। তারপর স্টিলের গ্লাস নিয়ে একজন বসে গেল বাঁধাকপি কাটতে। একজন বসে গেল পেঁয়াজ রসুন আদা ছাড়াতে। অত ভোরে মুরগি পাওয়া যায়নি। তাই একটু বেলা গড়াতেই আমাদের ম্যানেজার চলে গেল মুরগি কিনতে পাশের গ্রামে। প্রস্তুতি তো মোটামুটি হল। কিন্তু আদা পেঁয়াজ রসুন যে বেটে পরে মাংসে দিতে হয় সেকথা কারওরই খেয়াল ছিল না। কিন্তু তখন তো কিছু করার নেই। অবশেষে পাথরে পাথরে কোনওরকমে আধছেঁচা করা হল। ওদিকে তখন বেলা গড়িয়ে প্রায় দশটা বেজে গেছে।

জলখাবারে ছিল মুড়ি। আমাদের ম্যানেজার আসার সময় চপ নিয়ে এসেছিল। সামনের ক্ষেত থেকে তুলে আনা হল টাটকা টমেটো। সেই সব মিশিয়ে বেশ জমিয়ে খাওয়া হল মুড়ি। সামনেই ছিল নদী। বালি সরিয়ে চুঁয়া খুঁড়ে জল খাওয়া হল সে যে কী আনন্দ বলে বোঝানোর নয়। জীবনে সেই প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ বেশ চেটেপুটে সকলেই বেশ উপভোগ করেছিল।

রান্নায় কেউই তেমন পারদর্শী না হলেও মোটামুটি একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল। কারণ আমরা তখন এখনকার বাচ্ছাদের মত এত প্যাম্পারড ছিলাম না। তাই টুকটাক রান্না কাজকর্ম আমরা সেই বয়সেও শিখে গিয়েছিলাম। দুপুর আড়াইটে নাগাদ মোটামুটি সব খাবার তৈরি হয়ে গিয়েছিল। খুব যে খারাপ হয়েছিল তা বলা যাবে না। বরং প্রয়োজনের তুলনায় কিছু ভালোই হয়েছিল। গাছ থেকে টাটকা শাল পাতা পেড়ে থালা তৈরি করা হল। আমরাও নদীর জলে স্নানটান সেরে সবাই রেডি। বনভোজনের নিয়ম হল সব খাবার একটু একটু করে নিয়ে থালায় সাজিয়ে আগে বনবুড়িকে দিয়ে আসতে হয়। আমরাও সেইমতো সমস্ত খাবার সাজিয়ে বনের এক জায়গায় বনবুড়িকে দিয়ে এলাম। তারপর আমাদের খাওয়ার পালা। সকলেই বেশ কব্জি ডুবিয়ে ভরপেট খেলো। মাংসটা ওই আধছেঁচা মশলা দেওয়ার ফলে বেশ অসাধারণ হয়েছিল।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে আমরা নদীর ধার, সরষে ক্ষেত ফাঁকা হয়ে যাওয়া ধানজমিতে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াই। কচি কাঁচা কিশোর কিশোরীদের কলতানে ভরে ওঠে সেই মৌন প্রকৃতি। তখন সেলফি ছিল না। তাই ছবি নেই। মনের ক্যামেরাতেই সেই ছবি আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে। ইচ্ছে ছিল প্রত্যেক বছর এমন চড়ুইভাতি করব। কিন্তু জীবনের দাবি সবার থেকে বেশি। তাই ওইরকম বনভোজন আর কখনও করা হয়নি। উঠতি বয়সে হয়তো অনেক পিকনিক করেছি। কিন্তু সেখানে সেই সারল্য ছিল না। তাই আজও ফিরে পেতে ইচ্ছে করে সেই ফেলে আসা দিন। হয়তো সেই অচিনপুরে নাম না জানা নদীর ধারে সরষে ক্ষেতের পাশে আজও পড়ে আছে আমাদের সেই ফেলে আসা কিশোরীবেলা।‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.