আজ আপনার ডাকে ওরা কেন সাড়া দেবে?‌

সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি

বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি বাম এবং কংগ্রেসকে আহ্বান জানিয়েছেন, বিজেপির বিরুদ্ধে তাঁর সঙ্গে হাত মেলাতে এবং জোটবদ্ধ হতে। সংবাদ মাধ্যমে দেখলাম, তিনি এটাও বলেছেন, ‘‌বিজেপি দেশের সংস্কৃতি ধ্বংসকারী দল, কিন্তু বাম ও কংগ্রেস তা নয়। তাই অবিলম্বে বাংলায় বিজেপির এই অভাবনীয় গতিকে রোধ করতে বামপন্থীরা এবং কংগ্রেস তাঁর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সচেষ্ট হোক।
মুখ্যমন্ত্রীর এই ‘‌আহ্বান’‌ তাঁর স্বভাব–‌প্রকৃতির সঙ্গে একেবারেই বেমানান। বাংলার সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও একেবারেই অপ্রত্যাশিত নয়। এমনিতেই তাঁর মন্তব্যের মধ্যে কতটা তাঁর সুস্থ বোধশক্তির পরিচয় আর কতটা তাঁর অপ্রকৃতিস্থতা, তা নিয়ে জনসমাজে প্রতিদিনই বিতর্ক চলে। অফিসে কাজ করা লোক থেকে চাকুরি প্রত্যাশী বেকার–‌ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে, অবসর সময়ে, ঘরোয়া আড্ডা থেকে চায়ের আসরে, এমনকি রোয়াকে বসেও চলে এই আলোচনা। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার অগ্রগতির যুগে নানা কর্মে ব্যস্ত মানুষেরও মানসিক বিনোদনেরও প্রধান উপকরণ মুখ্যমন্ত্রীর বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থানে বলা উক্তিগুলি। রাজনীতির বাইরে তিনি আজকে সর্বত্র আলোচনার বিষয়, এবং তার সিংহভাগই মানুষের নানাভাবে মনোরঞ্জনের মাধ্যম হিসেবে। সে যতই তাঁর বিরোধীরা রাজনৈতিক ময়দানে তাঁর রাজনৈতিক সমালোচনা করুক, তাঁরাও কর্মবিরতির সময় পারস্পরিক আলাপ আলোচনায় সেই ‘‌রাজনৈতিক ব্যক্তি’‌র ই নানা উক্তিকে স্মরণ করে একটু মানসিক চাপ কাটিয়ে নেন—এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

mamata4
যাই হোক, এবারে কথা হল সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে ৭% ভোট পাওয়া এবং ভোটের অঙ্কে বাংলায় সর্বত্র তৃতীয় স্থানে নেমে আসা একটি দলকে মুখ্যমন্ত্রী কেন পাশে পেতে চান? যিনি ২০১৯ সালের নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের আগের দিনও শয়নে, স্বপ্নে, জাগরণে, চেতন ও অবচেতন মনে নিজেকে ভারতবর্ষের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতেন, তিনি ২২ টা আসনে জিতেও কেন সিপিএম–‌কে কাছে আনতে চাইছেন ?
কারণ টা খুব স্পষ্ট। কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির সারা ভারতবর্ষ জুড়ে এই চূড়ান্ত সাফল্যে এবং বাংলাতেও এই অভাবনীয় প্রভাবে, তিনি হয়তো নিজের দেওয়াল লিখন পড়েই ফেলছেন। আর দু বছর পরেই বাংলায় বিধানসভা নির্বাচন। আর সেখানেই বাংলার ‘‌অগ্নিকন্যা’‌র ‘‌অগ্নিপরীক্ষা’‌। এমনিতেই বিজেপির এই আকাশছোঁয়া উত্থানের পরে তাঁর দল তৃণমুলের নীচুতলার বহু কর্মী–‌সমর্থকরা রাতারাতি বিজেপিতে নাম লেখাচ্ছেন। অনেক বিজয়ী বিধায়কও পা বাড়িয়ে রেখেছেন। আর রাজনৈতিকভাবে কাটমানি–‌সহ নানা দুর্নীতি একের পর এক প্রকাশ্যে আসার পরে, বাংলার শাসকদলের অবস্থা বেশ সঙ্কটে। তাই বাংলার রাজনীতিতে নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে দুটো ক্ষয়িষ্ণু দলকে তিনি পাশে চান, কেন্দ্রের শাসকদলের বাংলায় এই অভাবনীয় গতিকে রোধ করতে।
এখন প্রশ্ন হল এই দুই ক্ষয়িষ্ণু দল কেন তাঁর ডাকে সাড়া দেবে? কংগ্রেসের অবস্থা বাংলাতে দীর্ঘদিন ধরেই সঙ্কটে। তাদের নতুন করে কিছু পাওয়ার নেই এখন বাংলা থেকে। এমনকি ২০১১ সালে বাংলার প্রধান বিরোধী দল তৃণমুলের সঙ্গে তাদের জোট করতে হয়েছিল এই কারণেই যে, একক ক্ষমতায় বামশক্তিকে পরাস্ত করা কংগ্রেসের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু তার পরে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অব্যবহিত পরেই তিনি কেন্দ্রে কংগ্রেসের থেকে সমর্থন তুলে নিলেন। যে দল থেকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত, সেই দলটাকে রাজনৈতিকভাবে শেষ করতে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দল সচেষ্ট হল। কংগ্রেসের একের পর জয়ী বিধায়ক, পুরপ্রধান, পঞ্চায়তের প্রধান, সদস্য–‌ সহ অগণিত কর্মী সমর্থক, শাসকদলের নেতাদের নানা রাজনৈতিক চাপে কংগ্রেসকে পরিত্যাগ করে শাসক দলে যোগ দিলেন। মুর্শিদাবাদ ও মালদার রাজনৈতিক চিত্রটাই পাল্টে ফেললেন মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দল, শুধু বাংলায় নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করার ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে। তাতে কংগ্রেস বাংলায় আদপেই একটা সাইনবোর্ডে পরিণত হয়েছে।
আর বামপন্থীদের বিরুদ্ধে? ২০১১ সালে ‘‌বাংলার মুখ্যমন্ত্রী’‌ হয়েই তাঁর লক্ষ্য ছিল সিপিএম–‌সহ বামেদের নির্মূল করা। এমনিতেই বাংলা থেকে সিপিএম–‌সহ বামজোটকে উৎখাত করতে অতীতে তিনি কখনও কংগ্রেস, কখনও বিজেপি–‌এই দুই সর্বভারতীয় দলের সঙ্গে জোট করেছিলেন। দার্জিলিং ভেঙে গোর্খাল্যান্ড করা গোর্খা জনমুক্তির মোর্চার সঙ্গে পর্যন্ত জোট করেছিলেন, বামেদের উৎখাত করে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হলে ‘‌গোর্খ্যাল্যান্ড’‌ নামের পৃথক রাজ্য গড়ার হীন প্রতিশ্রুতি দিয়ে। ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ‘‌কামতাপুরী’‌ নামে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সঙ্গেও ‘‌অলিখিত’‌ জোট করেছিলেন। তা ছাড়া ২০০৮ থেকে ২০১১ সালে নির্বাচনের আগে পর্যন্ত পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর–‌ সহ জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ‘‌মাওবাদী’দের সঙ্গে তৃণমূলের বোঝাপড়া ছিল পরিষ্কার। সেই সময় কত বামকর্মীর মৃত্যু হয়েছে, তার হিসেব নেই।

mamata2

তারপরে ২০১১ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে বিগত আট বছর ধরে পঞ্চায়েত ভোট থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত, পুরভোট, বিধানসভা, লোকসভা নির্বাচনে বামেদের ওপর চলল নির্মম সন্ত্রাস। নির্বাচনের বলি হয়েছিলেন কয়েকশো বামকর্মী। বিগত আট বছরে ঘরছাড়া বামপন্থীদের সংখ্যাটা কয়েক হাজার ছাড়িয়েছে। একের পর এক পার্টি অফিস দখল। একের পর এক প্রকল্প নিজের নামে চালিয়ে নেওয়া। কলকাতার বুকে নির্মিত উড়ালপুল থেকে গ্রামে গঞ্জে নির্মিত চিকিৎসা কেন্দ্র—সবেতেই একই ছবি। এই আত্মপ্রচার চলল দার্জিলিং থেকে জঙ্গল মহল–‌ সর্বত্র। শিক্ষার অঙ্গনে পরিচালন সমিতির কর্মাধ্যক্ষ থেকে শুরু করে, স্বাস্থ্য, পরিবহণ, এমনকি পুলিশ প্রশাসনেও—মুখ্যমন্ত্রীর ‘‌স্নেহধন্য’‌ লোকেরা নিযুক্ত হলেন। কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের নামে আদপেই একটা যুদ্ধের মহড়া ঘটল রাজ্যের প্রায় ৯৫% স্থানে। এর পাশাপাশি চলতে লাগল মিথ্যে মামলায় বামপন্থীদের জড়িয়ে কারারুদ্ধ করার ঘৃণ্য প্রয়াস। স্বৈরতান্ত্রিক সেই “রোষানল” থেকে বামপন্থী নেতারা শুধু নয়, ছাত্রছাত্রীরাও রেহাই পাননি। এতকিছু করেও তিনি ক্ষান্ত হননি। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জনাদেশ পেয়ে বাংলায় দ্বিতীয়বারের জন্য সরকারের এসেও তিনি শুরু করলেন দল ভাঙানোর খেলা। বিজয়ী বাম বিধায়ক, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলার, পঞ্চায়েত প্রধান–‌সবাইকেই মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে বা ঘরবাড়ি, চাষের জমি, খড়ের গাদা, ধানের গোলা,পুকুর, দীঘি নষ্ট করে দেওয়ার বা জবরদখল করার ভয় দেখিয়ে বা টাকার লোভ দেখিয়ে নিজের দলে টানতে বাধ্য হলেন। জোর করে তাদের সংবাদমাধ্যমের সামনে বলতে বাধ্য করালেন, তাঁরা স্বেচ্ছায় দলবদল করছেন। বাংলার মানুষকে তো দূরের কথা, মুখ্যমন্ত্রী নিজের ছায়াকেও পর্যন্ত বিশ্বাস করেন না, তাই সারা বাংলা বিরোধী শূন্য করার নির্দেশ দেন। আর আজকে লোকসভা নির্বাচনের পরে নিজের দলের সিঁদুরে মেঘ দেখে তিনি বামেদের আহ্বান জানাচ্ছেন, ‘‌বাংলা বাঁচানো’‌র‌ নামে। আদপে নিজের টলোমলো গদিকে সুস্থিত করার অভিপ্রায়ে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে “রক্ত হাত” বলে আপনি, বিরোধী থাকার সময় তাঁর ছায়াটুকুও এড়িয়ে চলতেন, লোকদেখানো সৌজ়ন্যের দোহাই দিয়ে আপনি আজকে তাঁরই নাম নিচ্ছেন বারংবার, তাঁর বাসভবনে যাচ্ছেন ‘‌সৌজন্যের’‌ নামে মানুষকে বার্তা দিতে যে, বুদ্ধবাবুর মতো স্তিতধী, সজ্জন, প্রাজ্ঞ মানুষও নাকি আপনার গুণগ্রাহী।

মাননীয়া, আপনার এই ক্ষমতালোভের নির্লজ্জ প্রয়াসে বামেরা সাড়া দেবে না। যে বামশক্তিকে শেষ করতে আপনি তৎপর হয়েছিলেন, তারা আপনার শেষ দেখতে চাইছে। সারা দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক এই মেরুকরণের রাজনীতির ফলে বামশক্তি আজকে ক্ষীণ এবং ক্ষয়িষ্ণু হলেও, বামপন্থীরা আপনার মতো ক্ষমতালোভী নয়। আর এই বাংলাতে “সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ” তো আপনারই তৈরি। বাম শাসনে যে “রিজওয়ানুর” এর মৃত্যুকে আপনি সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগিয়েছিলেন, তারই ধারা চলছে ইমাম ভাতা থেকে মাদ্রাসা হয়ে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের কারণে। সেই কারণেই হিন্দুত্ববাদী শক্তির এত বাড়বাড়ন্ত বাংলায়। বামপন্থীরা এই স্তিমিত শক্তি নিয়েই বাংলা ও দেশের সেই সবচেয়ে বড় শত্রু বিজেপির মোকাবিলা করবে, কিন্তু বামেদের কাছে পাওয়ার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আপনার কোনওদিনই পূরণ হবে না।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.