অণু গল্প: এক কাপ আদা-চা

বাসু মুখোপাধ্যায়

গলাটা সকাল থেকে খুব খুসখুস করছে। পুজোর পর এই সময়টা ভাল নয়। রাত আর ভোরের দিকে একটু একটু ঠান্ডা পড়ে। আজ ভোরে উঠে একটু হেঁটেছিলেন সামনের রাস্তায়। ঠান্ডা লেগে গেল কী? রোজ সকালে হাঁটার অভ্যাস নেই প্রবোধবাবুর। আজই ভোর ভোর ঘুম ভেঙে গেল আর খুব ইচ্ছে হল বাইরে বেরোতে।
এখন দুপুরবেলা। বৌমা, নাতিকে নিয়ে ঘুমাচ্ছে।
একটু চা পেলে গলার খুসখুসানিটা কমত। কান্তা থাকলে এখন আদা দিয়ে চা বানিয়ে দিত। কতদিন হল কান্তার চলে যাওয়া? পাঁচ বছরেরও বেশি হয়ে গেল। এখন তাঁর সত্তর চলছে। ভেবেছিলেন কান্তাকে ছাড়া কী ভাবে থাকবেন। পাঁচ বছর খুব কম সময় নয়। আছেন তো!
বৌমাকে একবার ডেকে বলবেন? নাহ্ থাক। একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠবে। মনে মনে গাল দিতে দিতে চা করবে। থাক।
সন্ধ্যেবেলায় এক কাপ চা প্রবোধবাবু পান। ছেলে অফিস থেকে আসার পর বৌমা বানায়। খুব দামি চা।
#‌#‌#‌
আচ্ছা চা’টা নিজে বানিয়ে নিলে কেমন হয়? কান্তা মাঝে সাঝে বাপের বাড়ি গেলে তিনিই তো রান্না করে নিতেন। ভাতে ভাত। ছোটতে সুজনও যেত মায়ের সঙ্গে। বড় হওয়ার পর আর যেত না। বাপ বেটায় আতপ চালের ভাত, ঘি আর আলু- ডিম সব সেদ্ধ একসঙ্গে মেখে চেটেপুটে খেতেন।
#‌#‌#‌
নাহ্ নিজে করার দরকার নেই। আধুনিক রান্নাঘর। কী যেন বলে মড্যুলার কিচেন। রান্নাঘরে ঢুকলে তাঁর কেমন বিদেশ–‌বিভুঁই মনে হয়। সব ঝাঁ চকচকে, আর কত্ত কিছু। তাঁদের সময় এতসব কিছুই লাগত না। একটা গ্যাস ওভেন মানেই বিলাসিতা। আরও আগে গুল, কয়লা, তারও আগে কাঠ। ওহ্ সেসব কী দিন ছিল। রান্না করা তো নয়, যেন যুদ্ধ!

tea
কাজের মেয়েটা খুব ভাল। মধুর মা। এই নামটাই জানেন। ছেলের পরিচয়ে পরিচয়। তার কাজ নিয়ে কথা, নাম জানতে বয়ে গেছে কারুর।
মধুর মা কে বললেন, “আমাকে একটু চা খাওয়াতে পারো?”
মধুর মা বলল, “বৌদিকে বলি?”
— “না থাক। বৌদিকে বলতে হবে না।”
মধুর মা কিন্তু কিন্তু করে বলল, “আমার ঘরে স্টোভ আছে, চাও আছে। তবে খুব ভাল নয়, করে দেব বাবু?”
মধুর মার জন্য একটা আলাদা ঘর বরাদ্দ আছে। সিঁড়ির নীচে ছোট্ট ঘর। স্টোভ রেখেছে। হয়তো কখনও নিজে চা-টা করে খায়।
— “হ্যাঁ হ্যাঁ করে দাও। আমার একটু গরম কিছু খেতে ইচ্ছে করছে।”
— “আপনার কাপ তো..”
— “কেন তোমার বাড়তি কাপ তো আছে আমাকে তাতেই দিও।”
— “আচ্ছা আমি কাপ ভাল করে গরম জলে ধুয়ে দেব।”
#‌#‌#‌
চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রবোধবাবুর মনে হল সেই পুরানো দিনের চা। গলা খুসখুসের কথা শুনে মেয়েটা আদা জোগাড় করে চায়ে দিয়েছে। চায়ে তেমন ফ্লেভার নেই। এমন চা’ই তো খেতেন তাঁরা।
মধুর মা খুব আগ্রহ নিয়ে জিগ্যেস করল, “ভাল হয়েছে বাবু?’
— “খুব ভাল হয়েছে মধুর মা। আজ বহুদিন পর আদা দেওয়া চা খেলাম। আচ্ছা, তোমার নাম কী?”
— “আমার নাম কতদিন কেউ ধরেনি বাবু। সেই মধুর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আর কেউ সে নামে ডাকেনি। আমার নাম রানি।”
— “রানি বাহ্ সুন্দর নাম। আমার মেয়েকে আমরা প্রথমে রানি বলেই ডাকতাম তারপর রানি কবে যেন রানু হয়ে গেল।”
#‌#‌#‌
রাত্রিবেলায় প্রবোধবাবুর বৌমা প্রবোধবাবুর ছেলেকে বলল, “তোমার বাবা তো রীতিমতো রাসলীলা শুরু করেছে মধুর মা’র সঙ্গে। জানো আজ দুপুরে মধুর মা নিজের স্টোভে চা করে নিজের কাপে বাবাকে চা খাইয়েছে। তুমি ভাবতে পারছ জল কতদূর গড়িয়েছে?”
সুজন পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, “আরে বুড়োদের অমন হয়। তুমি বরং মধুর মাকে ছাড়িয়ে অন্য একটা কাজের মেয়ে রাখো।”
প্রবোধবাবু বাথরুমে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় সব কথা স্পষ্ট শুনতে পেলেন।
তীব্র ব্যথায় মুচড়ে উঠল বুক। এক কাপ সস্তার আদা-চায়ের এত ক্ষমতা? এভাবে ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে পারে?
টলোমলো পায়ে প্রবোধবাবু এগোলেন তাঁর ঘরের দিকে..

(‌বেঙ্গল টাইমসে জমজমাট অণু গল্পের আসর। প্রতি শনিবার ও রবিবার থাকছে বাছাই করা কিছু অণু গল্প। কিছু গল্প আমন্ত্রিত। তবে পাঠকের জন্যও দরজা খোলা। চাইলে আপনারাও পাঠাতে পারেন আপনাদের লেখা অণু গল্প। লেখা পাঠানোর ঠিকানা:‌ 
bengaltimes.in@gmail.com)‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.