হীরক রাজার দেশে

ময়ূখ নস্কর

ভ্রমণ মানেই শিক্ষামূলক ভ্রমণ। ভ্রমণের মাধ্যমে যে শিক্ষা হয় তা আর কিছুতে হয় না। গত বছর আমার সেই রকম শিক্ষা হয়েছিল। সেই শিক্ষার কথা বলব। কিন্তু তার আগে ‘‌হীরক রাজার দেশে’‌র কথা একটু বলে নিই। সেখানে বেড়াতে গিয়েই তো আমার শিক্ষা হল।
আপনারা তো জানেন, হীরক রাজার দেশে এক সর্বনেশে দেশ। রাজারাজড়া এখন আর নেই বটে, কিন্তু দেশটা তো আছে! সেই পাহাড়টা তো আছে! সেই যে পাহাড়ে উদয়ন পণ্ডিত আত্মগোপন করেছিলেন কিম্বা গুপি বাঘা এর হাতে ওর হাতে তালি মেরে হুস করে হীরকের যে পাহাড়ে গিয়ে হাজির হয়েছিল! গিয়েছিলুম সেই পাহাড়ে।
যাওয়া এমন কিছু কঠিন নয়। ট্রেনে করে আসানসোল। সেখান থেকে একটা গাড়ি বুক করলেই হবে। পুরুলিয়াগামী ট্রেনে আদ্রায় নেমে অটো বা টোটো নিয়েও চলে যেতে পারেন। আর আপনার পায়ে যদি ভূতের রাজার জুতো থাকে তা হলে তো কথাই নেই! “জয়চণ্ডী পাহাড়” বলে হাতে তালি মারলেই হবে।

jaychandi1
হ্যাঁ, পুরুলিয়ার জয়চণ্ডী পাহাড়ই হল হীরক রাজার দেশ। মানে সেখানেই সিনেমাটার আউটডোর শুটিং হয়েছিল। পাহাড়ের সামনেই বেশ খানিকটা খোলা জায়গা, সেখানে সত্যজিৎ রায় মঞ্চ। অস্কারজয়ী পরিচালককে স্মরণ করার জন্য। অবশ্য মঞ্চ না থাকলেও ক্ষতি ছিল না। এখানে গেলে আপনার চোখ নিজে থেকেই তাঁকে স্মরণ করতে শুরু করবে। মন ভাববে, এই মাঠই কি মূর্তির মাঠ? ওই পুকুরেই কি গুপি বাঘা মুখ ধুতো? পাহাড়ের ওই খাঁজেই কি উদয়ন পণ্ডিতের সঙ্গে দেখা হয়েছিল গুগাবাবার?
আচ্ছা বেশ, ধরে নিলাম সিনেমায় আপনার আগ্রহ নেই। কিন্তু ভূগোল তো পড়েছেন! সেই যে মাধ্যমিকের সিলেবাসে ছিল, আবহবিকার, শল্কমোচন? একবার কষ্ট করে পাহাড়ের মাথায় উঠুন, সেই সব বইয়ে পড়া জিনিসের উদাহরণ চোখের সামনে দেখতে পাবেন। মনে হবে, আগে এসব দেখলে ভূগোলটা আরেকটু ভাল ভাবে জানা যেত, মাধ্যমিকে কটা নম্বর বেশি পাওয়া যেত।
কিন্তু আগে তো এখানে থাকার কোনও ব্যবস্থা ছিল না, তাই কেউ আসতও না। ব্যবস্থা হয়েছে হালে। মূল পাহাড়ের আশেপাশে কয়েকটা ছোটখাটো টিলা, তারই একটাতে কয়েকটা কটেজ বানান হয়েছে। যদিও ভাড়া বেশ চড়া।
সে যাই হোক, শিক্ষার কথা বলি। গতবছর পুজোর ছুটিতে উঠেছিলাম সেই কটেজগুলোর একটাতে। তাতে বেশ কিছু টাকা খরচ হলেও সংসারের লক্ষ্মী খুশি হয়েছিলেন। কাছেই রঘুনাথপুর। কথা দিয়েছিলাম, সেখান থেকে সিল্কের শাড়ি কিনে দেব। তাছাড়া রঘুনাথপুর রাজবাড়িতে পুজো হয়, সেখানে দশমীর সিঁদুর খেলাও হবে। হু-হু বাবা যে সে রাজবাড়ি নয়। মাইকেল মধুসুদন দত্ত একদা এই রাজবাড়ির ম্যানেজার ছিলেন।

jay chandi2
দশমীর সকালে গৃহলক্ষ্মী ঠাকরুন রঘুনাথপুর ভ্রমণের তোড়জোড় করছিলেন আর আমি একা একা পাহাড়ের মাথায় উঠেছিলাম। আর তাতেই আমার শিক্ষার সূচনা হল। পাহাড়ের একদিকে খোলা মাঠ, কটেজে ফেরার পথ তার উপর দিয়েই। আমি ভাবলাম, আজ একটু অন্যদিক দিয়ে যাই। বিবাহিত পুরুষ কিন্তু সঙ্গে বউ নেই অর্থাৎ বাধা গরু ছাড়া পেয়েছে। চললাম ঘুরপথে। পথে এক মাঝবয়সী লোক ছাগল চরাচ্ছেন। তাঁকে বললাম, “এদিক দিয়ে হোটেলে ফেরার রাস্তা আছে?” তিনি হাত নেড়ে ঘাড় নেড়ে বোঝালেন, ওই গাছগুলোর তলা দিয়ে খানিকটা গেলেই হোটেল।
গাছগুলো? খানিকটা গিয়েই বুঝলাম এ রীতিমতো জঙ্গল। বিস্তৃতিতে সে জঙ্গল বড় নয়, জঙ্গলের গাছগুলোও মহীরুহ নয়, কিন্তু নিবিড় অরণ্য বলতে যা বোঝায়, এ হল তাই। তারপরে মিনিট ৪০ ধরে আমার কী হল তা ভাষায় বোঝাতে পারব না। যে দিকে তাকাই সবুজের সমুদ্র। সেই সমুদ্রে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি। মাথার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে সবুজের ঢেউ আর মাঝে মাঝে উকি দিচ্ছে জয়চণ্ডী পাহাড়ের চূড়া। দিক হারালাম, হাত–‌পা ছড়ে গেল, ভয় পেলাম, সাপের ভয়, শেয়ালের ভয়, পড়িমরি করে ছুটতে গিয়ে ঠোকর খেয়ে পায়ের ছাল উঠে গেল। বিস্তর নাকানিচোবানির পরই কটেজে পৌঁছেছিলাম। আর লাভ করেছিলামলে দুটি শিক্ষা।

শিক্ষা ১ঃ জয়চণ্ডী পাহাড়ের উল্টোদিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের “পথসাথীতে” থাকার ব্যবস্থা আছে। সেখানে খরচ কম। ঘরও অনেক।
শিক্ষা ২ঃ বউয়ের আঁচল ছেড়ে একা একা কোথাও যেতে নেই।‌

 

mahalaya cover

https://www.bengaltimes.in/BengalTimes-OctoberIssue.pdf

 

বেঙ্গল টাইমসের নতুন ই ম্যাগাজিন। এই ছবিতে ক্লিক করলেই পড়তে পারবেন। ক্লিক করুন। পড়ে ফেলুন।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.