রমানাথ রায়: তিক্ত হাসির চোরাস্রোত

 

অন্তরা চৌধুরি

ramanath2

প্রচলিত সাহিত্যের বিরোধী লেখক রমানাথ রায়, যিনি সম্পূর্ণ নতুন এক ঘরাণার জন্ম দিয়েছিলেন। মানুষের মনোজগতের জটিল রূপ নিয়েই তাঁর গল্প। এই প্রসঙ্গে সমকালীন সমাজ ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক অনুষঙ্গও উঠে এসেছে। সমকালীন রাজনীতি মানুষের জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা বেশ কয়েকটি গল্পে তীব্র খোঁচার মাধ্যমে উপস্থাপিত করেছেন রমানাথ রায়। মরণাপন্ন মানুষকে নিয়ে কোথাও চলে ঘৃণ্য রাজনীতি, কোথাও বা কে কাকে ভালবাসবে সেটাও নির্ধারণ করে দেয় রাজনীতি। এরকম কয়েকটি গল্প নিয়ে আমরা আলোচনা করব, যেখানে খাপখোলা তরোয়ালের মতই গর্জে উঠেছে তার শাণিত ব্যঙ্গের কষাঘাত।

জন্ম ১৯৪০, মধ্য কলকাতায়। ইছামতী নদীর ধারে বাংলাদেশের যশোর জেলার এক বেনামী গ্রাম গোগোতে তাঁর পৈতৃক নিবাস।

তিনি ছিলেন শাস্ত্রবিরোধী লেখক। তাই তাঁর গল্প কিছুটা অ্যাবসার্ড। রমানাথ রায়ের গল্পে বিষন্নতা মেশানো একটা চাপা কৌতুক আছে। তাঁর লেখায় উইট এবং হিউমার থাকে। কখনও থাকে হালকা স্যাটায়ার। সঙ্গে থাকে সামান্য ফ্যান্টাসি।

 

গল্পের নাম ‘কাঁকর’। রমানাথ রায় তাঁর গল্পে আবেগ বা সহানুভূতির ধারে কাছেও যাননি। আবেগহীন এক নগ্ন বাস্তবে গল্পের শুরু থেকেই পাঠককে তিনি আছড়ে ফেলেন। গল্পের শুরু এইভাবে-

‘হরিবাবুর জন্ম কলকাতায়। তিনি রেশনের চাল খেয়ে বড় হয়েছেন। ফলে কাঁকর চিবোতে চিবোতে তাঁর দাঁত যেমন শক্ত এমন মজবুত হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, তিনি এখন নরম ভাতের বদলে শক্ত কাঁকরই বেশি পছন্দ করেন। কাঁকর চিবোতে না পারলে তাঁর এখন সুখ হয় না। পাকস্থলী তৃপ্তি পায় না। তাই ভাতের সঙ্গে কাঁকর তাঁর চাই। না হলে তাঁর চলে না। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।’১

গল্পের শুরুতেই কি অসাধারণ খোঁচা রেশন ব্যবস্থা তথা সরকারকে। ভেজাল মেশাতে মেশাতে তার শিকড় যে কতদূর বিস্তৃত হতে পারে এবং সেই আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে সরকারের নীচুতলা থেকে ওপরতলা পর্যন্ত মানুষ কিভাবে যুক্ত থাকে এই গল্প না পড়লে তা বোঝা যাবে না। যে রেশনের চাল সাধারণ মানুষের প্রাপ্য, দুমুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে থাকবে সেই চালেই কাঁকরের শ্রীবৃদ্ধি ঘ্টছে। কিন্তু লেখক ঘুরিয়ে নাক দেখালেন। ভাতের সঙ্গে কাঁকর খেতে খেতে এমন অভ্যেস হয়ে গেছে হরিবাবু কাঁকর ছাড়া আর ভাত খেতেই পারছেন না। ভেজাল খেতে খেতে সেই ভেজালকেই এখন সত্যি বলে মনে হয়। আর খাঁটি জিনিসকে মনে হয় ভেজাল। এই গল্প একই সঙ্গে চরম ব্যঙ্গাত্মক ও চরম সাংঘাতিকও বটে। হরিবাবু ভাতের সঙ্গে পাথর না পেয়ে অস্থির হয়ে গেছেন। অফিসে তাঁর এক বন্ধু এই উদ্বিগ্নতার কথা জানতে পেরে জানায় যে, ভাতে কাঁকর কম পড়লে-

‘চুন সুরকির দোকান থেকে ছোট ছোট পাথরকুচি এনে রাখি। কাঁকর কম পড়লে সেই পাথরকুচি গুঁড়ো করে ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে দিই। তবে রেশনের চালে যে কাঁকর থাকে তার মত খেতে লাগে না।’২

হরিবাবু চালে কাঁকরের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য আবেদন করেন রেশনের দোকানে। কিন্তু তিনি নিরুপায়। কারণ গোডাউন থেকে তিনি যেমন চাল পান তেমনি বাজারে ছাড়েন। কাজেই এ ব্যাপারে তাঁর কিছু করার নেই। এরপর হরিবাবু ফুড কর্পোরেশনের বড়কর্তার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি জানান যে তাঁরও কিছু করার নেই। দিল্লি থেকে যা পান তাই তিনি দেন জনসাধারণকে। হরিবাবুকে তিনি জানান বহু অনুরোধ করেও কোনও ফল হয়নি-

‘বারবার বলেছি, লোকে এখন চালের চেয়ে কাঁকর বেশি পছন্দ করে।’৩।

এরপর হরিবাবু দেখা করেন খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। খাদ্যমন্ত্রী তখন কাঁকর খাচ্ছিলেন। হরিবাবুর সমস্যার কথা শুনে তিনি জানান যে-

‘এটা আজ শুধু আপনার সমস্যা নয়, এটা আজ জাতীয় সমস্যা।’৪

খাদ্যমন্ত্রী আশ্বাস দেন এ বিষয়ে আন্দোলন করার এবং কেন্দ্রের ওপর চাপ বাড়ানোর। এই খাদ্যমন্ত্রী হরিবাবুকে পাথরকুচির ব্যবস্থা করে দেন। গোডাউন থেকে সেই পাথরকুচিই নিয়ে আসেন তিনি। কিন্তু ভেজালের হাত এত লম্বা যে সেই পাথরকুচিতেও রয়েছে অজস্র ভেজাল-

‘ঝাড়তে গিয়ে কাঁকর থেকে আরশোলার ডিম বেরোল, টিকটিকির লেজ বেরোল, মরা চামচিকে বেরোল। এছাড়া প্রায় দুশো গ্রামের মত ধুলো আর চালের খুদ বেরোল।’৫।

দুর্নীতির স্তর কতটা লঙ্ঘন করলে এমন সমাজ ব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। শাসকশ্রেণীর ওপরতলা থেকে নীচুতলা সকলেই কম বেশি এইসব আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত।

 

 

 

 

ramanath roy

এরকমই আরেকটি গল্প ‘মেয়েরা’। এই গল্পটিও উত্তম পুরুষে রচিত। সম্পূর্ণ অনাড়ম্বরভাবে গল্পের শুরু-

‘আমি বিয়ে করব। সংসার পাতব। খুব ইচ্ছে আমার। তাই রোজ একটি মেয়েকে চপ খাওয়াই, কাটলেট খাওয়াই। মাঝে মাঝে সিনেমা দেখাই। তবু মেয়েটি আমাকে বিয়ে করল না। বিয়ে করল আরেকজনকে।’৬

কারণ ভালভাবে বেঁচে থাকতে গেলে যে সমস্ত সৌখীন জিনিসের দরকার তার কোনওটাই গল্পকথকের ছিল না। এখনকার মেয়েরা অত বোকা নয়। বিয়ের আগেই পাত্রকে বাজিয়ে দেখে নেয় যে নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের সমস্ত উপকরণ সেই ছেলের ঘরে মজুত আছে কি না।

তাই গল্পকথক জীবনের সারসত্য বুঝে গেছে। সে কেমন মানুষ সেটা নিয়ে কারও মাথা ব্যথাই নেই। তার ঘরে ফ্রিজ, টিভি, টেলিফোন আছে কি না সেটাই সকলের কাছে যোগ্যতার মাপকাঠি। তাই সে দরজার বাইরে নোটিশ ঝুলিয়ে দেয়-

‘স্থির করিয়াছি আমি জীবনে বিবাহ করিব না।  আপনারা আমাকে আর বিব্রত করিবেন না। দয়া করিয়া কারণ জানিতে চাহিবেন না।’২৬

এই নোটিশটি বেশ অভিনব। আসলে বাস্তব যেখানে পৌঁছতে গিয়ে বারবার থমকে দাঁড়ায়, লেখকের অন্তর্দৃষ্টি সেই দুর্ভেদ্য প্রাচীরকে ভেদ করে অনায়াসে পৌঁছে যায়। উপমাগুলো ও মোড়কটা আগাগোড়াই কৌতুকের যার চরম ক্লাইম্যাক্স ওই নোটিশবোর্ড। এই গল্প আসলে বিয়ের জন্য ব্যাকুল এক যুবকের বিয়ের প্রতি আতঙ্কের অভিমুখে যাত্রা। বিবাহ-অনুরাগ থেকে বিবাহ-বিরাগে গমন। এই যাত্রাপথের অনুষঙ্গ হিসেবে নারীদের ও তাদের বিচিত্র চাহিদার আনাগোনা।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে কি রমানাথ রায়কে হাসির লেখক বলা যায়? যে হাসি আমরা পরশুরাম বা প্রভাতকুমারের লেখায় পেয়েছি সে হাসি এনার গল্পে কোথায়! ওনার গল্প পাঠে এক তিক্ত হাসির চোরাস্রোত আমাদের মনের গহনে বয়ে চলে।

তথ্যসূত্রঃ

১) রমানাথ রায় গল্প সমগ্র, রমানাথ রায়, অবণীন্দ্রনাথ বেরা, বাণীশিল্প, ১৪ এ, টেমার লেন, কলকাতা ৯। এপ্রিল ২০১৫। পৃ.১৬১।

২) তদেব পৃ. ১৬৩।

৩) তদেব। পৃ. ১৬৪।

৪) তদেব। পৃ. ১৬৫।

৫) তদেব পৃ. ১৬৭।

৬) তদেব। পৃ. ২৪০।

৭) তদেব। পৃ. ২৪৮।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.