‘সৌজন্য প্রতিরোধী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’

রবি কর

কথায় বলে কারও সর্বনাশ, কারও পৌষ মাস। এই যে সোমনাথ চাটুজ্যে মারা গেল, কত লোক সব্বনাশ হল গো সব্বনাশ হল বলে কাওয়ালি গাইতে শুরু করল, কিন্তু আমি এই ভরা শ্রাবণেই পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে গান শুনতে পেলাম। না না, সোমনাথ বাবু মারা যাওয়ায় আমি মোটেই আনন্দ পাইনি। বস্তুত এই পৃথিবীতে বউ ছাড়া এমন কেউ নেই, যে মরলে আমি আনন্দ পাব। না না, থুড়ি ক্রিয়াপদে একটু ভুল হয়ে গেল। পাব নয় পেতাম। বউ মরলে আর আনন্দ পাব না। কারণ বউই আমার জীবনে পৌষ মাস নিয়ে আসবে। দাঁড়ান দাঁড়ান। উৎসাহের চোটে লেখাটা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। একটু গুছিয়ে না লিখলে আপনারা হয়তো বুঝতে পারবেন, কিন্তু মাথামোটা এডিটর কিচ্ছু বুঝতে পারবে না।

দেখুন মশাই, বেঙ্গল টাইমসে কাজ করে যা টাকা পাই তাতে সংসার কেন, মাসের পান বিড়ি কেনার টাকাটাও ওঠে না। তাই আজকাল এই ফালতু মিডিয়ায় বেশি সময় না দিয়ে অন্য রোজগারের চেষ্টা করি। বছরখানেক আগে বুদ্ধিজীবী ট্রেনিং ইনস্টিটিউট খুলেছিলাম (পারলে লেখাটা আরেকবার পরে নেবেন।)। তাতে বেশ দু’‌পয়সা হচ্ছিল। কিন্তু আজকাল সে ব্যবসাতেও মন্দা বাজার। বুদ্ধিজীবীতে রাজ্য ছেয়ে গেছে। তাই ঠিক করেছি ‘সৌজন্য প্রতিরোধী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ খুলব। সেটা কী বুঝলেন না তো? বুঝবেন বুঝবেন, আমি বুঝিয়ে দিলেই বুঝবেন।

somnath4

আচ্ছা, বাবা মাকে তো সবাই ভালোবাসে। কিন্তু প্রকাশ্যে না হলেও কখন মানুষ বাবা–‌মাকে গাল দেয় বলুন তো? যখন বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়। সবাই মনে মনে বলে। বাপ–‌মা আমার গলায় কী একটা ঝুলিয়ে দিয়ে গেল রে বাবা! (নিজে দেখে বিয়ে করলে অবশ্য এটা বলার সুযোগ থাকে না।) কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন, বিয়ে দিয়ে বাবা–‌মা আমাদের কত বড় উপকার করেছে। আমিও বুঝতাম না জানেন, ভাবতাম বাবা–‌মা জেনেশুনে আমাকে বিষপান করিয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বেশ কিছু ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম…। না দাঁড়ান, আগে একটু উদাহরণ দিয়ে থেকে শুরু করি।

আচ্ছা বলুন তো, বাড়িতে গ্রে হাউন্ড পোষা থাকলে আপনার সুবিধা না অসুবিধা? নিশ্চয়ই সুবিধা। আচ্ছা বলুন তো দেশের অস্ত্রভাণ্ডারে পরমাণু অস্ত্র থাকলে দেশের সুবিধা না অসুবিধা? নিশ্চয়ই সুবিধা। তাহলে মশাই বাড়িতে খাণ্ডারনি বউ থাকলে সেটা অসুবিধা হবে কেন? দরকার শুধু অস্ত্রকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা। অস্ত্রের মুখ নিজের দিকে না রেখে বাইরের দিকে ঘুরিয়ে দিন। অস্ত্রকে বলুন, তুমি আমার পরম অবলম্বন। তুমি আমাকে রক্ষা কর।

এবার মুল কথায় আসি। সেই সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু হয়েছে জানেন। মরে গেলেই সৌজন্য দেখানো। সৌজন্যের গুঁতোয় মৃতের আত্মীয় স্বজন, পুরনো বন্ধু কেউ কাছে ঘেঁষতে পারছে না। হাসপাতাল থেকে ইলেকট্রিক চুল্লী সারাক্ষণ মড়া ছুঁয়ে উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে। প্রয়াত মানুষটির শেষ ইচ্ছা অনিচ্ছা কোনও দামই পাচ্ছে না।

সুভাষ মুখুজ্জের ইচ্ছে ছিল তার দেহদান করা হবে। কিন্তু তা হলে তো যথাযোগ্য মর্যাদা জানানো হবে না। তাই দেহ গেল কেওড়াতলায়। সুনীল গাঙ্গুলিরও একই দশা হল। সুভাষবাবু তবু শেষ জীবনে বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, সুনীল শেষদিন পর্যন্ত উন্নয়নকে গাল পেড়েছেন। ও হরি! মারা যাবার পরেই শুনি সৌজন্যময়ী “অভিভাবককে হারিয়েছেন।” আর অভিভাবক মারা গেলে যা হয়, সারাক্ষণ শরৎচন্দ্রের লালুর মতো মড়া ছুঁয়ে উন্নয়ন বসে রইল। মড়া না হয় আপত্তি জানাবে না, কিন্তু যদি তার সাঙ্গপাঙ্গরা এসে পড়ে?

তারপরে ভাবুন দুই সুচিত্রার কথা। একজন সারাজীবন রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইলেন, কিন্তু মৃত্যুর পর যে একটু “একলা চলবেন” তার উপায় রইল না। আর একজন, বলতে পারলেন না “আমাকে টাচ করবে না।” ফল কী হল? শেষ যাত্রায় ক্যামেরা যতবার তাঁদের দেখাল তার থেকে বেশি দেখাল উন্নয়নকে।

তালিকায় কত নাম বলব রে ভাই! শৈলেন মান্না, অমল দত্ত। শেষ সংযোজন সোমনাথবাবু। একজন মোহনবাগান ক্লাবে যেতে পারলেন না। আরেকজন আলিমুদ্দিনে যেতে পারলেন না। বেঁচে গেছেন দুজন। প্রথম মান্না দে। কারণ তিনি ভিন রাজ্যে মারা গেছেন। দ্বিতীয়জন প্রিয় দাশমুন্সি। এই দ্বিতীয়জনই হলেন আমার অনুপ্রেরণা। না মানে তিনি নন, তার স্ত্রী।

ভেবে দেখুন তো, প্রিয়বাবুকে কেন যথাযোগ্য মর্যাদা জানানো যায়নি? কেন তার পাশে উন্নয়ন দাঁড়াতে পারেনি? কারণ তাঁর পাশে তাঁর স্ত্রী ছিলেন। এবং সেই স্ত্রীও নেহাত কম যান না। সুযোগ পেলে তিনিও উন্নয়ন হতে পারতেন। কাজেই…

শুনুন মশাই, কার মধ্যে কী প্রতিভা আছে কেউ জানে না। এই যে আমি রবি কর, কাল যে গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্তর মতো বিখ্যাত হব না তা কে বলতে পারে? আমার মৃত্যুর পর যদি আমার পাশে উন্নয়ন বা উন্নয়নের ভাইপো দাঁড়িয়ে পড়ে তাহলে কী হবে ভাবুন তো! আমার দেহটা বেঙ্গল টাইমসের দপ্তরে নিয়ে না গিয়ে আদি গঙ্গার পারে নিয়ে যাওয়া হবে।

তাই বলছি, সময় থাকতে সচেতন হন। যিনি বিখ্যাত তিনি সচেতন হন, যিনি এখনও বিখ্যাত হননি তিনিও সচেতন হন। আপনার ঘরে নিশ্চয়ই বউ আছে। তিনি নিশ্চয়ই দজ্জাল। তার দজ্জালপনা দেখে কপালকে দোষ দেবেন না। তার এই প্রতিভাকে কাজে লাগান। সাবিত্রী যেমন সত্যবানকে যমের হাত থেকে রক্ষা করেছিল, তেমনি তিনিই আপনাকে উন্নয়নের হাত থেকে রক্ষা করবেন।

শুধু দরকার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। আর এই প্রশিক্ষণ দিতে পারে আমার বউ। গ্যারান্টি দিতে পারি মশাই, তার মতো খাণ্ডারনি এদেশে বিরল। সত্বর যোগাযোগ করুন, নামমাত্র খরচে আমার ‘সৌজন্য প্রতিরোধী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’-এ স্ত্রীকে ভর্তি করান। উন্নয়নকে দূরে রাখুন। বিফলে মূল্য ফেরত।

পুলুবাবু, নীরেনবাবু, বুদ্ধবাবু, শঙ্খবাবু, সূর্যবাবু যে যেখানে আছেন আপনাদের জন্য বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা আছে। শুধু বিমানবাবুর জন্য কিছু করতে পারব না। কারণ ওঁর স্ত্রী নেই।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.