বাংলা আজও ছাত্র আন্দোলনকে ভুলে যায়নি

রাজ্যে সম্প্রতি দুটো উল্লেখযোগ্য ছাত্র আন্দোলন এবং তার আশাতীত সাফল্য দেখে পশ্চিমবঙ্গে অতীতে ছাত্র আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এই দুটো ছাত্র আন্দোলনকে অনেকে ‘অরাজনৈতিক’ তকমা দিয়ে রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে রাখার চেষ্টা করলেও এই দুটো আন্দোলন কিন্তু পারতপক্ষে রাজনীতিরই নামান্তর। কারণ বাস্তবিকই যেখানে শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অনাচারের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জাতি-ধর্ম-বর্ণ এবং বয়স নির্বিশেষে সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ একজোট হয়ে প্রতিবাদ করেন বা আন্দোলনের সামিল হন-তা আদপে নীতির বিরুদ্ধে নীতিরই লড়াই। অর্থাৎ কার নীতি শ্রেষ্ঠ বা কে নীতির রাজা—তাই নিয়েই লড়াই। তাই আমার বিচারে এই ছাত্র আন্দোলন বাংলার শাসকদলের বিরুদ্ধেই যুবসমাজের লড়াই।

cmc

সাত বছর হয়ে গেল বাংলায় তৃণমূল সরকার রাজ চলছে। এই সাত বছরে রাজ্যে শিক্ষা বা শিক্ষাঙ্গনগুলোর কী পরিণতি হয়েছে, তা সমস্ত জনসাধারণই প্রত্যক্ষ করছেন। বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে মুখে যত প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল,তিনি নাকি বাংলার শিক্ষায়তনগুলোকে রাজনীতি মুক্ত করবেন। তার বাস্তব রূপ প্রকাশ পেয়েছিল সেদিনই, যেদিন গার্ডেনরিচের একটি স্কুলের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্কুলের মধ্যে গুলি চলেছিল তৃণমুল কাউন্সিলর ইকবাল ওরফে মুন্নার নেতৃত্বে এবং পুলিশ ও.সি. তাপস চৌধুরী নিহত হন গুলিবিদ্ধ হয়ে। এবং তারপরে সময় যত এগিয়েছে, দেখা গেছে শুধু স্কুল বা কলেজই নয়, বাংলার শিক্ষাব্যবস্থাটাই তৃণমূলের “রাহু গ্রাসে” পড়েছে। পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ভাঙড়ের একটি স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি হয়েছিলেন তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা আরাবুল ইসলাম। এতসবেও মুখ্যমন্ত্রী তৃপ্ত হননি। তাই তার খামখেয়ালীপনার শিকার হয়েছে প্রাথমিক স্কুলের বাংলার পাঠ্যপুস্তকগুলো যেখানে তার অবসর সময়ে লেখা কিছু মামুলি শব্দবন্ধ-(ছড়াও বলা যায় না) পাঠ্যসূচীতে স্থান পেয়েছে। আবার ইতিহাস বই এর পাঠ্যসূচীতে স্থান পেয়েছে সিঙ্গুর আন্দোলন। আর এ ছাড়া টেট নিয়ে বা এস.এস.সি নিয়ে পরীক্ষার ফর্ম তোলা থেকে শুরু করে,পরীক্ষার দিনক্ষণ ঘোষণা এবং তার ফল প্রকাশ নিয়েও কয়েক লাখ পরীক্ষার্থীকে যে প্রতিবছর কী নিদারুণ শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে-তা সরকারের তাঁবেদারি করা কিছু তৃতীয় শ্রেণীর দৈনিক ছাড়া প্রায় সব সংবাদপত্রেই প্রকাশিত হয়েছে। আর এই অনাচারের, এই ঘুণধরা শিক্ষাব্যবস্থার সর্বশেষ সংযোজন কলেজ়ে কলেজে তৃণমূল ছাত্রপরিষদের “দাদা” দের তোলা আদায়। কোথাও ইংরেজি অনার্সে ভর্তি হতে ২০০০০ টাকা ,কোথাও ভূগোল অনার্সে ৬৫০০০ টাকা, কোথাও প্রায় ১ লাখের কাছাকাছি ভেট দিয়ে অনার্সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়া। অথচ খোদ মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী তারা নাকি তাদের দলের যুবদের এই কেচ্ছা-কাহিনী সম্পর্কে কিছুই অবগত নন, তাদের দাবি স্বচ্ছতা মেনেই কলেজে কলেজে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির প্রক্রিয়া চলছে !!

cmc2

গোটা পশ্চিমবঙ্গে এই ঘৃণ্য শিক্ষাব্যবস্থায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিল তা বস্তুতঃ তৃণমূল পরিচালিত শিক্ষাব্যবস্থার এই হীনতা এবং স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধেই। আর সেই প্রতিবাদ কিন্তু মোটেই সাধারণ প্রতিবাদ ছিল না। বহু ছাত্রী দীর্ঘসময়ে অনশনের কারণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ পুলিশ ডেকে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের হটিয়ে দেওয়ার হুমকি দিলেও তাঁরা পিছপা হননি। সোমাশ্রী চৌধুরী নামে জনৈকা ছাত্রী তো গুরুতর অসুস্থ অবস্থাতেও অনশন চালিয়ে গিয়েছেন শত বাধা এবং হুমকির মুখেও। এই আন্দোলনেরই ফলশ্রতিস্বরূপ কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি মেনে প্রবেশিকা পরীক্ষার দাবি মানতে বাধ্য হয়েছিল। তেমনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজেও ডাক্তারি পড়ুয়াদের দাবি ছিল একটি নতুন কলেজ হোস্টেলের। বাস্তবিকই যে হোস্টেলে ডাক্তারি পড়ুয়ারা রাত্রিবাস করেন তা বাসের অযোগ্যই শুধু নয়, চরম অস্বাস্থ্যকরও বটে। বিশেষতঃ এই বর্ষায় ভাঙা টিনের শেড যে কোনও সময়ে ভেঙে পড়ে নিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। তাই পড়ুয়াদের দাবিই ছিল নতুন একটি হোস্টেলের, যা একেবারেই ন্যায্য। মুখ্যমন্ত্রী সব সরকারী হাসপাতাল গুলোকে নীল-সাদা রঙে ঢেকে দেন, বিশাল বিশাল ব্যানার ও ফ্লেক্স লাগিয়ে তার ও তার সরকারের “অনুপ্রেরণা” এবং “উন্নয়ন” এর প্রচার হয় অলি-গলি থেকে শহরের রাজপথ, হাসপাতালের গায়ে সুপার স্পেশ্যালিটির তকমা দেওয়া হয়—আর সেখানে নিরাপত্তা ও সুস্থ জীবনযাপনের স্বার্থে ভবিষ্যতের ডাক্তারদের এইটুকু দাবি তো যথেষ্টই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল পড়ুয়াদের এই দাবিতেও সরকার প্রথমে কর্ণপাত করেনি। সরকারের ইচ্ছাকৃত এই উদাসীনতায় ডাক্তারি পড়ুয়াদের জেদের আগুনও গিয়েছিল কয়েকগুণ বেড়ে। তাই অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ছাত্র-ছাত্রীদের এই আন্দোলন সমাজের প্রায় সব মানুষকেই স্পর্শ করেছিল মানবিকতার খাতিরে। অনিকেত নিজেও গুরুতর অসুস্থ হয়েছিলেন দীর্ঘ উপবাস ও অনশনের কারণে। এখানেও প্রায় দু সপ্তাহ লড়াইয়ের পরে মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ পড়ুয়াদের দাবি মেনে নতুন একটি ১১ তলা হোস্টেল তৈরি করতে সম্মত হন। সেই সঙ্গে পুরনো হোস্টেলের সংস্কার করার দাবিও মেনে নেন। সিনিয়র ছাত্রদের নতুন হোস্টেলের দুটো ফ্লোর ছেড়ে দেওয়া এবং ফার্স্ট ইয়ার ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছাত্র দের নতুন হোস্টেলে দুটো আলাদা আলাদা ফ্লোর দেওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া নয়।

বাংলায় এই দু-দুটো ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-ছাত্রী দের অভাবনীয় সাফল্য এটাই প্রমাণ করে, যে বাংলা অতীতে অনেক গৌরবময় ছাত্র আন্দোলনের কাহিনী দেখেছে সেই ধারাটি আজও প্রবহমান। শুধু একটা স্ফুলিঙ্গ দরকার জ্বলে ওঠার জন্য, যা “সোমাশ্রী” বা “অনিকেত” দের হাতে জ্বলে উঠেছিল যথাক্রমে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। বাংলার বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের যে উষ্মা এবং ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে দিনের পর দিন তা এই জন-জাগরণ এবং আন্দোলনের মাধ্যমেই সমাজে দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আর সমাজের সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনেই তা প্রভাব বিস্তার করছে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.