নব্য বাঙালির ১৩ পার্বণ

বাঙালির বারো মাস একই আছে। তবে তেরো পার্বণ বদলে গেছে। নব্য বাঙালির তেরো পার্বণ কী কী ? বাংলা নববর্দীষের আগে দীর্ঘ গবেষণার পর  কলম ধরলেন রবি কর।  

আম্বেদকর লোকটা যে একটা মহা ‘ইয়ে’ সেটা আমরা সবাই জানি। আমরা জানি, সংরক্ষণ- টংরক্ষণ চালু করে লোকটা দেশের সাড়ে সর্বনাশ করে গিয়েছেন। আমরা, অর্থাৎ জেনারেল কাস্টের  লোকেরা গলায় পৈতে ঝুলিয়ে প্রকাশ্যে নিজেকে অন্যদের থেকে উঁচু বলে জাহির করি, সংস্কৃতের ‘স’ না জানা ব্রাহ্মণকে বাড়িতে ডেকে পুজো করাই, বিয়ের সময় ‘সবর্ণ’ পাত্রী খুঁজি, মেয়ে ভিনজাতে প্রেম করলে আড়ং ধোলাই দিই- অর্থাৎ বর্ণভেদ আমাদের কোষে কোষে, মজ্জায় মজ্জায়। কেবল চাকরির সময় আমরা বর্ণভেদ বিরোধী, আম্বেদকর বিরোধী।

 

কিন্তু এই আম্বেদকর লোকটার জন্য এবছর বাঙালিদের যা সুবিধা হয়েছে না! গুরু বেছে বেছে একটা দিনে জন্মেছিল বটে! ১৪ এপ্রিল। তার পরের দিনই বাংলা নববর্ষ। মানে পরপর দুদিন ছুটি। আর এবছর ?  কী বলব দাদা, কেস পুরো জমে দই। শনি, রবি এমনিই ছুটি, সোমবারটা সি.এল. নিতে পারলেই মঙ্গল (১৪ তারিখ), বুধ (১৫ তারিখ) টানা ৫ দিন নো অফিস। তাই জীবনে প্রথমবার আম্বেদকরকে শ্রদ্ধা জানিয়ে শুরু করছি বাঙালির ১৩ মাসের বর্ণনা, যার প্রথমটি হল –

ছুটি ছুটি পার্বণঃ আলস্য দর্শন শাস্ত্রের জননী। আর বাঙালি মাত্রেই কমবেশি দার্শনিক। তাই আলস্য আমাদের ভারি প্রিয়। আগে রাজনৈতিক দলগুলো  সোমবার কিম্বা শুক্রবার বনধ ডেকে আমাদের দার্শনিক হওয়ার সুবিধা করে দিত, কিন্তু এখন সেই কাজে ভাটা পড়েছে। তাই বাঙালি তাকিয়ে থাকে ক্যালেন্ডারের দিকে। পরপর দুদিন ছুটি বা শনি-রবির আগে-পিছে ছুটি পেলেই হল, চালাও পানসি বেলঘরিয়া, থুড়ি দিঘা। ইদানীং ডুয়ার্স, মন্দারমণি, সুন্দরবন জনপ্রিয় হলেও দিঘা ইজ দিঘা। এত কাছ থেকে ভেজা সালওয়ার পরা বউদি আর কোথাও দেখা যায়? যায় না। অবশ্য বউদি দেখাটা বোনাস। আসলে বাঙালি কিছু দেখার জন্য বেড়াতে যায় না, যায় হোটেলে বসে মদ খাওয়ার জন্য। যদি হোটেল পাওয়া না যায় ? ভয় কি রে পাগল, বন্ধুর ফ্ল্যাটে লাল জল আর নীল ছবি  তো আছেই!

 

রবীন্দ্রনাথ পার্বণঃ  পয়লা বৈশাখের ধামাকা কাটতে না কাটতেই ২৫ শে বৈশাখ এসে হাজির। বাঙালি ছোটবেলায় সুকুমার রায় আর বড়বেলায় রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কারও কবিতা পড়ে না, (রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য কোনও কবির একটা কবিতা মুখস্ত বলতে গেলে বাঙালির টুপি ও জাঙ্গিয়া স্থানবদল করতে পারে) তাই রবীন্দ্রনাথ বাঙালির সবথেকে প্রিয় কবি। আগে হয় সকাল ৬ টায় আর সন্ধে ৬ টায় রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হত। কিন্তু এখন মধ্যম পন্থা, অর্থাৎ দুপুর ১২ টায় রবীন্দ্রনাথের গলায় দড়ি, থুড়ি মালা দেওয়া হয়। ওয়াকিবহাল মহলের খবর, বর্তমান বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিনী (অর্থাৎ মহিলা কবি) নিজে ১২ টার আগে ঘুম থেকে ওঠেন না, তাই এই ব্যবস্থা। এবার অবশ্য ২৫ বৈশাখ শনিবারে পড়েছে, তাই একটা ছুটির দিন মাটি। কিন্তু যতক্ষণ কবিনী আছেন ভাই, বাঙালির ছুটির লাগি কোনও ভয় নাই। তিনি চাইলে জন্মের ১৫০ বছরে, মৃত্যুদিনে  ‘মিষ্টি ছুটি’ পাওয়া যায়। এবার হয়তো শুক্রবার ছুটি দিয়ে দেবেন। একান্তই যদি না দেন তাহলে মনের দুঃখ মনে চেপে, ট্র্যাফিক সিগন্যালে রবীন্দ্রসংগীত শুনেই এবছরটা কাটাতে হবে।

tero parbon4

ভোট ভোট পার্বণ যারা বলে বাঙালি কর্মবিমুখ তারা একবার এসে দেখে যাক! দাদা-দিদি-ভাইপোদের গদিতে বসানোর জন্য বাঙালি যেমন নাকেমুখে রক্ত তুলে খাটে, তেমনটা দুনিয়ার আর কোনও জাত পারে না। এত খাটুনি, এত মেহনত নিজের পিছনে দিলে মানবজমিনে সোনা ফলে যেত। কিন্তু বাঙালি তো আর পাঁচটা জাতের মতো নয়, দেশ ও দশের কথা সে যদি না ভাবে তো কে ভাববে ? যে রাজনীতি করে না, সেও ভোটের খবর রেখে রেখে খবরদার হয়ে গেল। কে কার সঙ্গে জোট করবে, কে কার পিছনে গোঁজ দেবে, কে করল সাবোতাজ, কে পরল মাথায় তাজ- এর পাশাপাশি কে কটা ফিতে কাটল, কে কটা রেপ করাল, কেজগ ছুড়ল, কে কব্জি কেটে নিল, কে বোম মারার নিদান দিল, নিহত যুবকের বাড়ি গিয়ে কে ক’আউন্স চোখের জল ফেলল, সব খবর রাখে বাঙালি। খবর কে দেয়? কেন,  টি ভি চ্যানেল। প্রাথমিক সমীক্ষা, বুথ ফেরত সমীক্ষা, ফল ঘোষণা। ওফ ভোট তো নয়, এক একটা পানিপথের যুদ্ধ! আর ভোটগুলো আসেও  বছর ধরে ধরে, পঞ্চায়েত, লোকসভা, পুরসভা, বিধানসভা পরপর চার বছরে চারটে। পঞ্চম বছরটা যে কী কষ্টে কাটে!

 

খেলা খেলা পার্বণ  ভোট পার্বণে তবু একটা বছর গ্যাপ যায়। কিন্তু খেলা পার্বণে নো ফাঁক। অলিম্পিক, কমনওয়েলথ, এশিয়ান, ফিফা বিশ্বকাপ একটা শেষ হলেই আর একটা হাজির। আর ক্রিকেটের তো কথাই নেই, একটার জায়গায় দুটো বিশ্বকাপ, তার ওপর বচ্ছর বচ্ছর আই পি এল। একবার ঢাকে কাঠি পড়লেই হল, বাঙালি পাছার কাপড় মাথায় তুলে ইডেনে হাজির। ওই স্টেডিয়ামে মাঝে মাঝে হয় রনজি, বোনঝি ইত্যাদি কি সব টুর্নামেন্ট, কিন্তু সেগুলো দেখতে সাতটা কাকও মাঠে যায় না। বাঙালি হল আন্তর্জাতিক, বুঝলেন আন্তর্জাতিক! ব্রাজিল কেন ৭ গোল খেল, হকিতে কেন সোনা এল না, সব খবর তার নলেজে। কিন্তু একবার জিগ্যেস করুন হকি আর ফুটবলে ভারতের ক্যাপ্টেন কে? বাঙালির পিলে ব্যোমকে যাবে। বাঙালি বাড়িতে বসে দেখে, মণিপুরের মেয়ে বক্সিংয়ে ফাটিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু নিজের মেয়ের বেলা ? ‘কি রে তুই এখনও খেলছিস, আজ তোর গানের ক্লাস নেই?’

 

মেলা মেলা পার্বণ মেলা বলতে কেউ যেন না ভাবে, এঁদো গাঁয়ের পেঁদো মেলার কথা বলা হচ্ছে। ওসব আদাবন বাদাবনের মেলায় বাঙালি, মানে শিক্ষিত বাঙালি যায় না। জেলার মেলা মানে পৌষ মেলা, যেখানে যেতে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। আর আসল মেলা হল বইমেলা। ‘সব মেলার সেরা বাঙালির তুমি বুক-মল”। না মশাই, ছন্দ মেলানোর জন্য ভুলভাল লিখিনি। বই মেলাকে দেখলে একটা শপিং মলের কথাই মনে হয়। গাঁইয়া লোকের ভিড় নেই, সবাই সাজুগুজু, মাইকে রবীন্দ্র সোনগীত, আর কি সুন্দর সুন্দর স্টল! ফুডকোর্টটা কি সুন্দর! আরে ভাই, এ কি গুপ্তিপাড়ার রথের মেলা, যে ঝাঁকায় করে তালপাতার পাখা আর জিভেগজা বিক্কিরি হবে? ময়দানের মেলায় তবু  পায়ে একটু ধুলো লাগত, মিলনমেলা পুরো ঝক্কাস! বইমেলা মানেই খাওয়াদাওয়া, কুইজ, সেলফি, আনন্দর স্টলে লাইন। সঙ্গে উপরি পাওনা অডিটরিয়ামে ব্যান্ডের গান। সেই গান শোনায় যে বাধা দেবে তার ১৪ গুষ্টিকে…। এবছর অমর্ত্য সেনকে অবধি সিটি মেরে স্টেজ থেকে নামিয়ে দিয়েছি।

tero parbon1

থিম থিম পার্বণ‘আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি’, থিমের সময় এল কাছে। এই বছরের আশ্বিন মাস এলেই আগামী বছরের থিমের চিন্তা শুরু হয়ে গেল। মাটির ভাঁড়, আখের ছিবড়ে, বোতাম, বিস্কুট, বোঁদে, দিদিমার গুড়াখুর কৌটো, দিদিমণির ছবি, পিসেমসাইয়ের ধুতি ইত্যাদি হরেক উপকরণ নিয়ে হাজির হল থিম শিল্পী। পুজোটা গৌণ, থিমটাই  আসল। থিম কথাটার মানে অভিধানে যাই লেখা থাক, বাঙালি জানে আসল মানে ঝুলন। শুরু হয়েছিল বইমেলা দিয়ে। এবারের থিম আমেরিকা- গেট যেন টুইন টাওয়ার গেট, মণ্ডপ যেন স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, টয়লেট যেন নায়গ্রা। কিন্তু কালে কালে এর কপিরাইট কেড়ে নিয়েছে দুগ্যিপূজা। কলকাতা আর তার আশেপাশে ২০ হাজার পুজো তার ১০ হাজার থিম। বছর ৩০ আগে বাঙালি শিশুরা যেভাবে ঝুলন সাজত, ঠিক সেই কায়দায় প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে গড়ে ওঠে রাজস্থান, কাশ্মীর, মিশর, কয়লাখনি এমনকি ভুতুড়ে বাড়ি। শুধু দুর্গাপূজা কেন আজকাল সব পূজারই থিম হয়।  বছর দুয়েক আগেএকটি কালীপূজোর থিম হয়েছিল শ্মশান। হয়তো একদিন ষষ্ঠীপূজোর থিম হবে আঁতুড়ঘর।

 

ধনতেরাস পার্বণঃ বছর দশেক হল, উত্তর ভারতের এই পার্বণটিকে বাঙালি আপন করে নিয়েছে। স্বামী নামক পাঁঠাটিকে বলি দিয়ে এই পার্বণ  উদযাপন করা হয়। দেওয়ালির দিন মা লক্ষ্মীকে তুষ্ট করার প্রাচীন রীতি থেকেই নাকি এই পার্বণের সূচনা। নিন্দুকেরা বলেন, মা লক্ষ্মী যখন নারায়নের পদসেবা করেন, তখন আসলে তিনি নতুন গয়না বাগানোর ধান্দা করেন। তবে বাঙালি নারী দেওয়ালির দিন শুধু লক্ষ্মীপূজা করে না, কালীপূজাও করে। তাই পদসেবা করার বদলে তারা স্বামীকে চিত করে শুইয়ে তার বুকের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ে। মুখপোড়া মিনসে গয়না দিবি না মানে! যদি কোনও স্বামীর মনে এ নিয়ে গ্লানি দেখা দেয় তাহলে তিনি চ্যাপলিনের কথা ভেবে সান্ত্বনা পেতে পারেন। গোল্ড রাশ সিনেমায় সোনা খুজতে গিয়ে তাঁকে জুতো চিবিয়ে খেতে হয়েছিল। আমাদের তো শুধু বউয়ের _____ খেতে হয়।

 

পার্ক স্ট্রিট পার্বণঃ ধনতেরাস পার্বণ শেষ হতে না হতে শীত এসে হাজির। আর শীত মানেই পার্ক স্ট্রিট পার্বন। এটা এমন একটা পার্বণ যা পালন করতে হয়, কিন্তু কেন করতে হয় তা কেউ জানে না । পার্ক স্ট্রিটে কোনও বড় গির্জা নেই, যীশুর জন্মদিন উপলক্ষে সেখানে কোনও মোচ্ছব হয় না, ইংরাজি বছরের প্রথম দিনে সেখান থেকে সূর্যোদয় দেখা যায় না — তবু বছরের শেষ সপ্তাহটা বাঙালি সেখানে যাবেই। কারণ সবাই যায়। বাঙালি লেপমুড়ি দিয়ে ঘরে শুয়ে থাকলে যদি যীশু না জন্মায়, যদি নতুন বছর না আসে!

এখন তো আবার ফ্রি ওয়াই ফাই। বাঙালি ফ্রি-তে যাহাই পায়, তাহাই গ্রহণ করে। ‘জনসমুদ্রে আমি’ জাতির উদ্দেশ্যে এই ছবি এবার ফ্রিতেই ছাড়া যাবে। সে যা ভিড় হয় না, পৌষের শীতেও কুলকুল করে ঘাম ছুটতে থাকে। যত মানুষের ভিড় তার থেকে বেশি গাড়ির ভিড় । সেই ভিড় সামলাতে পুলিশ এ বছর ট্র্যাফিক বন্ধ রাখে তো ও বছর খুলে দেয়।  পুলিশ যেমন থতমত, মানুষ তেমন টলমল। থতমত খেতে খেতে টলমল করতে করতে ঘড়ির কাঁটা যেই ১২ টার ঘরে পৌঁছাল অমনি সবাই মিলে গলা তুলে শিয়ালের মতো  হো-ও–ও-ও। পুরনো বছরটা পালিয়ে বাঁচে। নতুনটার যে কী দশা হয়!

 

ফিলিম ফিলিম পার্বণঃ শুনেছ গুরু, এবার হৃত্বিক আসবে?

বাঙ্গালির সৌভাগ্য দেখলে দেবরাজ ইন্দ্রেরও হিংসে হবে। কী কারনে জানি না, বোধহয় টেকনিসিয়ানদের মজুরি কম বলে, কলকাতায় হিন্দি সিনেমার শুটিং হওয়ার একটা ট্রেন্ড চালু হয়েছে। আর সেই সিনেমায় অভিনয় করার জন্য যেই না কলকাতায় আসা, অমনি নায়কের মনে পড়ে নবান্নের ১৫ তলার কথা। আর যেই না নবান্নের ১৫ তলায় যাওয়া অমনি দিদি তাঁকে চলচ্চিত্র উৎসবে নেমন্তন্ন করে। আর যেই না নেমন্তন্ন করা অমনি নায়ক এক গাল হেসে রাজি। ক্যামেরায় খচাখচ ছবি।

কলকাতা ফিলিম ফেস্টিভ্যাল তাই দিনে দিনে তারায় তারায় তারাপীঠ হয়ে উঠছে। কত তারা! এবছর বচ্চন, ও বছর কমল হাসান। এবছর ক্যাটরিনা ও বছর হৃত্বিক। শারুখ তো প্রতিবছরই মাছভাজা খেতে আসে। দুষ্টু লোকে বলে ওই মাছ নাকি মাছের তেলে মানে সাধারন মানুষের তেলে ভাজা হয়।

সে হোক বাঙালির আমোদ হলেই হল। আগে তারকভস্কি না চুলের খুস্কি,  কাদের না কাদের সিনেমা আসত। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একগাদা পাকা ছুল লোক ভিটির ভিটির করে কী সব বলত।আর এখন! হুইল চেয়ারে সুপ্রিয়া থেকে থালি হাতে কোয়েল, সবাই হাজির। নন্দনের সামনে দাঁড়ালে ডিসেম্বর মাসেও জুন, বাঙালি আনন্দে খুন।  সপ্তাখানেক পরে মনে পড়ে, কী কী সিনেমা এসেছিল তা তো জানা হয়নি? জানব কী করে? খবরের কাগজের  তো শুধু উদ্বোধনের কথাই দেওয়া ছিল, সিনেমার লিস্টি তো দেওয়া ছিল না।

 

একুশে পার্বণঃ  বাঙালি মনে প্রাণে জানে বাংলার মতো অখ্যাদ্দ ভাষা দুটো নেই। তিনটে ‘স’, দুটো ‘ন’, দুটো করে ‘ই’, ‘উ’ তারপরে ড-য়ে শূন্য, ঢ-য়ে  শূন্য, রেফ, র-ফলা ঐকার, ঔকার মিলে নরকযন্ত্রণা। বাংলা একটি  মৃতভাষা, আর বাংলা নিয়ে পড়ে যত রাজ্যের অগা ছাত্ররা। তাই বাংলায় কথা বলা প্রতিবেশী দেশটিকে নিয়ে আমাদের বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না। বরং অবজ্ঞাই ছিল। কিন্তু যেই না রাষ্ট্রসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করল, অমনি আমরা “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো” বলে নেপোর মত দই মারতে ঝাপিয়ে পড়লাম।

তবে হ্যাঁ, টিভিতে মুখ দেখানো আঁতেলগুলো এই দিনটাকে নিয়ে যতটা নাচানাচি করে, আম-বাঙালি ততটা করে না। তাদের কাছে আসল একুশে পার্বণ হল জুলাই মাসে। সে এক পার্বণের মত পার্বণ বটে। জুন, কোয়েল পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, সুবুদ্ধি সরকার চেয়ার মোছে, বৃন্দনীল সেন গান গায়, আর দেবের ‘পাগলু পাগলু’ তো আছেই। বাঙালির বড় আশা, এবছর মুনমুন সেনের সঙ্গে রিয়া রাইমাও থাকবে। ও হ্যাঁ মনে পড়ল এই পার্বণে শহীদ না কি একটা ব্যাপার আছে না?

 

এস এস সি পার্বণঃ বাঙালির প্রধান ত্রুটি হল এই যে, ভাল লোকের ভাল কথায় সে কান দেয় না। কত করে বলা হল, তেলেভাজার দোকান দে, দশতলা বাড়ি বানাতে পারবি। বাঙালি তাতে কান দিল না। সে হাপিত্যেশ করে বসে আছে কবে আবার এস এস সি পার্বণ অনুষ্ঠিত হবে। মুশকিল হল, এই পার্বণটি নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয় না। হ্যালির ধুমকেতুর মত মাঝে মাঝে এসে হাজির হয়। কিন্তু যখন হাজির হয়, সান্দাকফু থেকে সাগরদ্বীপ অন্য সব খবর ফুসসসস করে উড়ে যায়। এস এস সি পার্বণের দিন কোনও জংশন স্টেশনে বসে থাকলে চৌমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকলে, দেশভাগের স্মৃতি জেগে উঠবে। বাপ-মার হাত ধরে বাঙালির শিশুরা চলেছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে, ট্রেনে বাসে বাদুড়ঝোলা  ভিড়, স্কুলগুলির সামনে বুভুক্ষু জনতার ভিড়…

মাঝখানে বি এড কম্পালসারি করে দেওয়ায় পার্বণে জৌলুসে একটু ভাঁটা পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্র আবার সেই কড়াকড়ি শিথিল করে দিয়েছে। এখন একবার খালি বিজ্ঞাপনটা দিক।

 tero parbon5

‌সিরিয়াল পার্বণঃ  তালিকার একদম শেষে নাম থাকলেও এটাই হল বাঙালির আসলি পার্বণ। নেহাত একেবারে হাল আমলের আমদানি তাই সৌজন্য মেনে লাস্টে নাম দিতে হল। অন্য সব পার্বণের তিথি-নক্ষত্র বলে একটা ব্যাপার থাকে। কিন্তু সিরিয়াল পার্বণ একেবারে অতিথি, মানে কোনও তিথি নেই। প্রতি সন্ধ্যায় মন্দিরে মন্দিরে যেমন আরতি হয়, মসজিদে মসজিদে আজান দেওয়া হয়, তেমনি বাঙালির প্রতি বাড়িতে, প্রতি দিন, প্রতি চ্যানেলে, প্রতি ভাষায়, প্রতিশোধে, প্রতিহিংসায়…। শেষের শব্দ দুটি অকারনে লেখা হয়নি, প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসা হল সিরিয়াল পার্বণের মূল কথা। পিতৃশ্রাদ্ধের মন্ত্র পড়ার সময়ও বাঙালি ধৈর্য হারিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। কিন্তু উত্তমের নাতির অতি-অধম অভিনয় দেখার জন্য আমাশার বেগ চেপে বসে থাকে। সিরিয়াল অনেক সিরিয়াস ব্যাপার বুঝলেন মশায়। দিদি বলেছে, নিউজ চ্যানেল না দেখে এসব ‘কুটুন্তি টুটুন্তি’ দেখলে মন ভাল হয়।

এই পার্বণকে আরও জনপ্রিয় করার জন্য বেঙ্গল টাইমসের একটা প্রস্তাব আছে। দিদি তো এমনিতেই সেরা সিরিয়ালের জন্য টেলি আকাদেমি অ্যাওয়ার্ড চালু করেছেন, এবার সেরা দর্শককেও এই অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হোক। রীতিমত পরীক্ষা নিয়ে দেখা হবে এই বছরে সেরা‘কুটুন্তি’ কে? তবে হ্যাঁ, কালীঘাটের আদিগঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চলকে এই প্রতিযোগিতার বাইরে রাখতে হবে। কারণ ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, এই অঞ্চলের একটি টালির বাড়ির বাসিন্দা সংশয়াতীতভাবে বাংলা সিরিয়ালের সেরা দর্শক। তিনি প্রতিযোগিতায় নাম দিলে বাকিদের নো চান্স।

tero parbon6

ত্রয়োদশ পার্বণঃ  নব্য বাঙালির ত্রয়োদশ পার্বণের দাবিদার অনেক। লিটল ম্যাগাজিন মেলা, রুপম ইসলামের গান, টি ভিতে রান্নার অনুষ্ঠান, হাঁদি নাম্বার ওয়ান, চৈত্র সেল ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বেঙ্গল টাইমসের তরফে আমরা বেছে নিয়েছি এমন একটি পার্বণ, যার মধ্যে বাঙালির যাবতীয় এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজের পূর্ণ প্রকাশ এবং প্রচার হয়। হ্যাঁ প্রচার। শুধু প্রতিভা থাকলেই তো হল না, তার প্রচার চাই। ঠিকমত প্রচার থাকলে, প্রতিভা না হলেও চলে। তাই বাঙালির প্রেম করা, সাংবাদিকতা করা, রাজনীতি করা, রান্না করা, ফটোগ্রাফি করা, সব কিছু প্রচারের জন্য, হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন ফেসবুককেই সেরা পার্বণ বলে বেছে নেওয়া হল। সিরিয়াল তবু সন্ধেবেলা হয় কিন্তু ফেসবুক ২৪*৭। জাগরণে, ঘুমে, বাথরুমে, ক্লাসরুমে ফেসবুক চলছে চলবে। বুড়ো হাবড়ারা প্রথম প্রথম এর বিরোধী ছিলেন, কিন্তু ইদানিং তারাও রসের সাগরে হাবু ডুবু খাচ্ছেন। অনেকে নিন্দুক প্রশ্ন তুলতে পারেন, ফেসবুক তো বাঙালিরনিজস্ব জিনিস নয়। তাহলে  ১৩ পার্বণের অন্তর্ভুক্ত হবে কেন? তাঁদের মনে করিয়ে দিতে চাই,  বাঙালি সকল ভেদাভেদের উপরে। তাই  ফেসবুককে করেছে নিকট বন্ধু, টুইটারকে করেছে ভাই। তাছাড়া ভাবুন, বাঙালির একান্ত আপন দুটি জিনিস, অর্থাৎ আড্ডা এবং বিনামূল্যে জ্ঞান দেওয়ার এর থেকে ভালো মাধ্যম আর কী হতে পারে? রাজনৈতিক দলগুলিও আজকাল দেওয়ালে স্লোগান না লিখে ওয়ালে লিখছে।

এদিকে এক কাণ্ড হয়েছে, আন্দোলন ছেড়ে দিনরাত ফেসবুক করার জন্য এক ছাত্রনেতাকে প্রায়ই সমালোচনার মুখে পড়তে হত। তাই তিনি রাগ করে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন। ওরে খোকা তুই একি করলি রে? তোকে ছাড়া আমরা যে চোখে আধার দেখি। শূন্য এ ফেসবুকে পাখি মোর আয়, ফিরে আয় ফিরে আয়…

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.