বনি ঘোষ
ভোরে ওঠাটা নতুন কিছু নয়। কিছুটা অভ্যেসই হয়ে গেছে। নিজের স্কুলের জন্য্ রোজই উঠতে হয়। কিন্তু বেড়াতে যাওয়ার জন্য যদি ভোরে উঠতে হয়, তাহলে তার রোমাঞ্চই আলাদা। নাই বা হল বড়সড় সফর। একদিনের ছোটখাটো সফর, তাই বা মন্দ কী ?
তেমনই এক অনুভূতি হল ২৫ ডিসেম্বর। সেটাই নিজের মতো করে শেয়ার করছি বেঙ্গল টাইমসের পাঠকদের জন্য। খুব আগে থেকে পরিকল্পনা হয়েছিল, এমন নয়। কর্তার কয়েকজন বন্ধু ও তাদের পরিবার। ছোট একটা টিম। ঠিক হল, সকাল ৬ টা ২৫ নাগাদ উঠব দমদম স্টেশনে। গন্তব্য টাকি। সকাল থেকেই রাস্তায় অনেক গাড়ি। ট্রেনেও যাদের দেখলাম, তাদের অনেকেই ডেইলি প্যাসেঞ্জার নয়। অর্থাৎ, তাঁরাও বেরিয়ে পড়েছেন আমাদের মতোই, একটা দিনের ছুটিতে।
ট্রেনে তো উঠে পড়লাম। ভিড়ও ছিল ভালই। জানালার ধারে একটা সিটও পেয়ে গেলাম। বাইরের প্রকৃতি দেখা আর ভেতরের কথা শোনা, দুটোই হয়ে যাবে। চোখ রইল বাইরে, কান রইল ভেতরে। কেউ আক্ষেপ করছেন, ক্রিসমাসের দিন কাজে বেরোতে হল বলে। কেউ টেনে আনছেন সংসারের কথা। ব্রিগেডে কেমন লোক হবে, এমন প্রশ্নও তুললেন কেউ কেউ। নানা রকমের চরিত্র। নানা রকমের সংলাপ। এটাও ট্রেনের বাড়তি একটা আকর্ষণ।
কর্তা বা তার বন্ধুরা ফেসবুকে মগ্ন। কেউ ব্যস্ত হোয়াটস আপে। কী মেসেজ এসেছে, কাকে কী উত্তর দেওয়া যায়, এসব দিকেই ওদের মন। সঙ্গে বউ যাচ্ছে। তবু লুকিয়ে গোপন বান্ধবীদের সঙ্গেও কথা চালিয়ে যাচ্ছে। বউয়েরা মগ্ন মেকাপ নিয়ে। আমার এদুটোর কোনওটাতেই তেমন আগ্রহ নেই। ফেসবুক করি ঠিকই, কিন্তু বেড়াতে গিয়ে মোবাইলে মুখ গুঁজে থাকতে ঠিক ইচ্ছে করে না। কেউ মোবাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করলে বরং কিছুটা বিরক্তই লাগে। আমার চোখ তখন জানালার বাইরে, অনেকটা দুখুমিঞার সেই ট্রেনে চড়ার মতো। সবকিছু ছুটছে, আমরাও ছুটছি।
চারদিকে হলুদ সর্সের ক্ষেত। এই বুঝি উকি দিচ্ছে শাহরুখ-কাজল। এই বুঝি ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে ডিডিএলজে-র সেই সুরগুলো। ইটভাটা, নদী, গাছপালা সব দেখছি।
এর ফাঁকেই হয়ে গেল এক রাউন্ড ব্রেকফাস্ট। পাউরুটি, ডিম, কলা, কমলালেবু- এসব সঙ্গে নিয়েই উঠেছিল। ট্রেনেই প্রকৃতি দর্শনের মাঝে সেসব উদ্ধার হয়ে গেল। পিকনিকের সেই আমেজ যেন ট্রেন থেকেই শুরু হয়ে গেল। ঠিক সময়েই পৌঁছে গেলাম টাকিতে। আমাদের মতো আরও অনেকেই হাজির এই দিনটায়। ইছামতীর তীর যেন আমাদেরই দখলে।
ইছামতী বড় অদ্ভুত একটা নদী। বিভূতিভূষণের উপন্যাসে অনেকটাই ধরা আছে ইছামতী। কিন্তু এ তো নিছক নদী নয়, দুই দেশের সীমান্ত। এপারটা ভারত, ওপারটা বাংলাদেশ। আর সীমান্ত হলে যা হয়! দু পাশেই স্টেনগান হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে জওয়ানরা। একটু দূরে দূরেই সেই জওয়ানদের ক্যাম্প। ভরসা আর ভয় কোথায় যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
ওই দূরে মাছরাঙা দ্বীপ। যেন বড়ই নিঃসঙ্গ, একাকী সেই দ্বীপ। ইসস, যদি চলে যেতে পারতাম! কিন্তু ঢেকিকে স্বর্গে গেলেও ধান ভানতে হয়। গৃহিনীদের অবস্থাও কিছুটা সেইরকম। রাঁধুনি থাক বা না থাক, কোমরে আঁচল জড়িয়ে রান্নার কাজে লেগে পড়তেই হয়। ভাত, ডাল, আলুভাজার সঙ্গে দেশি মুরগির ঝোল। মেনুটা মন্দ নয়। কিন্তু বেড়াতে এসে হেঁসেল ঠেলতে কার আর ভাল লাগে ? ইছামতী বোধ হয় এই দীর্ঘশ্বাসটারও সাক্ষী রইল।
ওপারেই বাংলাদেশ। আমাদের কাছে ওপার বাংলা। যেন আরও একটা বাড়ি। যেন হৃদয়ের আরও একটা জানালা। যদি সাঁতার দিয়ে ওইপারে চলে যেতে পারতাম। যদি পূর্বপুরুষদের সেই ভিটে দেখে আসতে পারতাম! অদ্ভুত একটা নস্টালজিয়া যেন তাড়া করছিল। মনে পড়ে গেল একটা কবিতার লাইন- পাখির কোনও সীমান্ত নেই। যদি পাখি হতাম! পাসপোর্ট, ভিসা কিছুই লাগত না। নদীর উপর দিয়ে দিব্যি উড়ে যেতাম। আবার ইচ্ছে হলে ফিরে আসতাম।
ফিরে আসতে কার আর ইচ্ছে করে! কিন্তু আমরা বাঁধা ঘড়ির সেই শাসনে। বিকেলেই ফেরার ট্রেন। তার মধ্যে সব গুটিয়ে পাটিয়ে ফিরতে হবে। শীতের রোদ এসে লাগছে গায়ে। সঙ্গে হালকা হিমেল বাতাস। রোজকার জীবন থেকে একটু হলেও অন্যরকম একটা জীবন।
বিকেল হচ্ছে। সকালের সেই হই হুল্লোড় আসতে আসতে কমে আসছে। ফিরে আসছে নির্জনতা। একাকী বয়ে যাবে ইছামতী। সন্ধের ওই নির্জন ইছামতীও অনেক কথা বলতে চায়। সেই নদীর গান শুনতে আরও একদিন আসব। সেদিন শুধু ইছামতীর কাছেই। সেদিন কোনও ফেরার তাড়া থাকবে না।