তিন বছর ধরে চলছে বেতন কমিশন। ফের মেয়াদ বাড়ানো হল। এই কমিশন বা তার রিপোর্টের আদৌ কোনও গুরুত্ব আছে? যে রিপোর্ট দেওয়া হবে, সেটা মুখ্যমন্ত্রীর পড়ার ধৈর্য থাকবে তো? সেই রিপোর্টই দেওয়া হবে, যেটা তিনি চাইবেন। সেটাই ঘোষণা হবে, যেটা তাঁর ইচ্ছে হবে। তাহলে তিন বছর ধরে বেতন কমিশন নামক শিখণ্ডিকে খাড়া করা হচ্ছে কেন? মেয়াদ বাড়ানোর এই আবেদন, তার পেছনেও ‘অনুপ্রেরণা’ নেই তো? লিখেছেন স্বরূপ গোস্বামী।।
পর্বতের মূষিক প্রসবের কথা শুনেছি। কিন্তু এবার বেতন কমিশনের অশ্বডিম্ব প্রসবের অপেক্ষায় আছি। অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েই চলেছে।
তিন বছর আগে তৈরি হয়েছিল বেতন কমিশন। মাথায় বসানো হয়েছিল বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে তৃণমূলের হয়ে গলা ফাটানো অভিরূপ সরকারকে। নামী অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক। এসব পরিচিতিগুলোকে তিনি নিজেই অনেক পেছনের সারিতে ঠেলে দিয়েছেন। তাঁকে তৃণমূল–পন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবেই চেনেন সাধারণ মানুষ।
তিন বছর পেরিয়ে গেল। কমিশনের মেয়াদ বেড়েই চলেছে। তিনি নাকি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কথা বলেই চলেছেন। তাঁদের দাবিদাওয়ার কথা শুনেই চলেছেন। তিন বছর ধরে এতকিছু শোনার পরেও রাজ্যের বেতন কাঠামো নিয়ে পরামর্শ দেওয়ার আর সময় পাচ্ছেন না। আরও ছমাসের সময় চাওয়া হয়েছিল। সরকারের অপরিসীম উদারতা। সেই সময় মঞ্জুরও হয়েছে। অর্থাৎ, আরও ছ মাস বাড়িয়ে দেওয়া হল কমিশনের মেয়াদ।
ধরা যাক, ছ মাস পরে রিপোর্ট জমা পড়ল। তাতে কী হবে? সেই রিপোর্টের মূল্য কতটুকু? অভিরূপবাবুকে প্রমাণ করতে হবে, তিনি খুঁটিয়ে সমীক্ষার কাজ করেছেন। তাঁকে দেখাতে হবে, তিনি অর্থনীতিতে বিশাল পণ্ডিত। দেশ বিদেশের নানা বেতন কাঠামোর উপমা টেনে আনবেন। বিভিন্ন রাজ্যের নানা পরিসংখ্যান কপি পেস্ট করবেন। তারপর দেখাতে চাইবেন, বামফ্রন্ট সরকার প্রচুর ঋণ নিয়েছি। কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না। তাই ইচ্ছে থাকলেও আপাতত বেশি বেতন দেওয়া যাবে না।
মোদ্দা কথা তো এটাই থাকবে, যেটা মুখ্যমন্ত্রী সব জায়গায় বলে আসছেন। একটা সহজ প্রশ্ন, অভিরূপবাবুর ওই দীর্ঘ রিপোর্ট মুখ্যমন্ত্রী আদৌ পড়বেন? সেই ধৈর্য তাঁর আছে? পড়লেও কতটা বুঝবেন, তা নিয়েও ঘোরতর সন্দেহ। মোদ্দা কথা, সেটাই হবে, যেটা মুখ্যমন্ত্রী চাইবেন। তারপর হয়ত নেতাজি ইনডোর বা ব্রিগেডের দলীয় সভা থেকে দুম করে ঘোষণাও করে দেবেন। কোন কথাটা কোন মঞ্চে বলতে হয় বা কোথায় কোনটা বলতে নেই, এই ন্যূনতম জ্ঞানটুকু যে তাঁর নেই, এই প্রমাণ তিনি প্রায় প্রতিদিনই দিয়ে চলেছেন।
মুখ্যমন্ত্রী যদি রিপোর্ট পড়বেনই না, তাহলে এই বেতন কমিশনের বারবার মেয়াদ বাড়ানোর কী মানে হয়? এত এত অর্থহীন শুনানিরি বা কী প্রয়োজন। অভিরূপবাবু সেই রিপোর্টই দেবেন, যেটা তাঁকে দিতে বলা হবে। মুখ্যমন্ত্রী সেটাই ঘোষণা করবেন, যেটা তাঁর ইচ্ছে হবে। তাহলে কমিশন নামক শিখণ্ডি খাড়া করার দরকার কী? আসলে, এই কমিশন সত্যিই একটা শিখণ্ডির ঢালের মতোই। ডিএ চাইলেই বলা হবে, বেতন কমিশন বিষয়টা দেখছে। এভাবে যতদিন ঝুলিয়ে রাখা যায়!
আরও একটা বেয়াড়া প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এতবার মেয়াদ বাড়ানোর পরেও আবার মেয়াদ বাড়ানোর এই আবেদনটা আদৌ কমিশন করেছিল তো? সত্যিই আবার আবেদন করার মতো সাহসও কি এই কমিশনের আছে? নাকি সেই আবেদনটাও করতে বলা হয়েছিল? নিচ থেকে ওপর, চারিদিকে এত সেটিংয়ের ফুলঝুরি। এত অনুপ্রেরণার ফুলঝুরি। মেয়াদ বাড়ানোর আবেদনের পেছনেও তাঁর ‘অণুপ্রেরণা’ নেই তো?