আগে দেখা। পরে পড়া। ফলে, পড়তে গিয়ে দেখা ছবিটাই ভিড় করে। যেমন জটায়ুর কথা পড়তে গিয়ে মনে পড়ে সন্তোষ দত্তর কথা, সমাপ্তি পড়তে গিয়ে ভেসে ওঠে অপর্ণা সেনের মুখ। তেমনই দুর্গা বললেই ভেসে ওঠে ওই ছোট্ট উমার মুখ। সেই অপু–দুর্গার জীবনের সঙ্গে কোথাও একটা মিলে যায় নিজেদের জীবন। সেই দুর্গা হারিয়ে গেলেন। সত্যজিৎ রায়কে লেখা পুরনো একটি চিঠি ফিরিয়ে আনা হল বেঙ্গল টাইমসের পাতায়। লিখেছিলেন অন্তরা চৌধুরি।
শ্রীচরণেষু সত্যজিৎবাবু
শুনেছিলাম আপনি রোজ সকালে উঠে চিঠি লেখেন। তাই মনে হল, আপনাকেও একটা চিঠি লিখি। চিঠির থেকে ভাল উপহার তো আর কিছু হয় না। বর্তমান ফেসবুক আর হোয়াটস অ্যাপের যুগে হাতে লেখা চিঠি তো প্রায় উঠেই গেছে।
আপনার সম্পর্কে অনেক ভারী ভারী কথা বলার মানুষ আছে। আপনাকে নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছে এমন লোকেরও অভাব নেই। আপনার শিল্প নৈপুণ্যের প্রশংসা করার অনেক গুণগ্রাহী আছেন। আমি তাঁদের সম্পর্কে প্রচণ্ড শ্রদ্ধাশীল। তাঁরা আপনার মতো মানুষ সম্পর্কে কত কিছু জানেন। অথচ আমি তেমন কিছুই জানি না। তবে আপনি আমায় স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন। কল্পনার জাল বুনে তার ভেতর হারিয়ে যেতে শিখিয়েছেন।
ছোটবেলায় রূপকথার গল্প পড়েছিলাম। মনে দাগ কাটেনি। কিন্তু যখন ‘গুপীগাইন বাঘাবাইন’ দেখলাম তখন আমার বয়স ছয় কি সাত। ওই বয়সেও বুঝতে এতটুকুও অসুবিধে হয়নি। আবার যখন ‘হীরক রাজার দেশে’ দেখলাম, তখন সে কি আনন্দ। ‘গুপী বাঘা ফিরে এল’ যে আপনার ছবি নয়, সেটা বোঝার মতো বয়স তখনও আমার হয়নি। তখন গুপী–বাঘা মানেই আপনি। একদিকে রোমাঞ্চ, আবার একদিকে ভয়ও। সন্ধ্যে বেলায় একা একা বাইরে বেরোতাম না। ভাবতাম, যদি বাঁশবনের ওই ভূতের রাজা বেরিয়ে আসে!
গ্রীষ্মকালের রাত্তিরে খোলা আকাশের নীচে ঠাকুমার পাশে শুয়ে শুয়ে ভাবতাম আচ্ছা, ভূতের রাজা যদি আমাকে বর দিতে চায়, তাহলে আমি কী কী চাইব? কত এলোমেলো ভাবনা আসত মাথায়। শিশুমন তখন সত্যি মিথ্যে বুঝত না। সে নিজেই কল্পনার জাল বুনত। কতবার যে মনে মনে গুপী বাঘার কাছে যেতে চেয়েছি। বড় হয়ে জানতে পারলাম, ওই ভূতের রাজাটা নাকি আপনি ছিলেন! এখনও বিশ্বাস হয় না জানেন।
তারপর সেই ছোট্ট মুকুলের ‘সোনার কেল্লা’। কত ছোট বয়সে দেখেছি। কিন্তু প্রথম দেখার সেই অনুভূতি, সেই শিহরণ এখনও মনে আছে। সেইসময় কোনও একটা ম্যাগাজিনে জাতিস্মর নিয়ে একটা আর্টিকেল বেরিয়েছিল। ‘সোনার কেল্লা’ দেখার পর একই সঙ্গে রোমাঞ্চ ও ভয় কাজ করত। ভয়টা কেন বলতে পারব না। মুকুল না হয় সামনে থেকে সোনার কেল্লা দেখেছে। কিন্তু আমরাও কোথায় যেন ছোট্ট মুকুলের চোখ দিয়েই সোনার কেল্লা দেখেছিলাম। ওই সিনেমাটা দেখার পর থেকে এখনও মনের মধ্যে রাজস্থান যাওয়ার স্বপ্ন লালন করি। বড় হতে হতে কতবার সিনেমাটা দেখেছি। কিন্তু আজও পুরনো হয়নি।
‘হীরক রাজার দেশে’র কথাগুলোতো আজও প্রবাদ হিসেবে ব্যবহার করি-
‘অনাহারে নাহি খেদ
বেশি খেলে বাড়ে মেদ’।
তখন আমাদের বাড়িতে সাদাকালো ছোট্ট একটা টিভি ছিল। সেখানেই দেখেছিলাম ‘পোস্টমাস্টার’ সিনেমাটা। খুব যে বুঝেছিলাম এমন দাবি করব না। কারণ তখনও পর্যন্ত গল্পটা পড়া হয়নি। আর গল্পটা না পড়লে বোধহয় রতনের ওই অব্যক্ত যন্ত্রণাকে বোঝা যাবে না। কিন্তু রতনের মুখ আর পোস্টমাস্টারের জায়গায় অনিল চ্যাটার্জির মুখটা মনে ছিল। পরে যখন পড়েছি, চরিত্রের মুখগুলো আর নতুন করে আঁকতে হয়নি। সেই ছেলেবেলায় সেই ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিল।
তবে একটা সিনেমা ভীষণভাবে দাগ কেটেছিল মনে। সেটা হল ‘পথের পাঁচালী’। যদিও সিনেমাটার তত্ত্বের দিক কিছুই সেই বয়সে বুঝিনি। কিন্তু দুর্গা আর অপু কোথায় যেন নিজের জীবনের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। সিনেমাটা টি ভি তে যখন প্রথম দেখি, তখন আমার ভাইও অপুর বয়সী। কেন জানি না, নিজেকে দুর্গার মতো মনে হত। তখনকার জীবন এখনকার মত এত স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা ছিল না। আমি আর ভাই প্রকৃতির কাছে কতবার যে ছুটে চলে গেছি নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কারের নেশায়। বাড়িতে তেমন কোনও বাধা ছিল না কোথাও যাওয়ার ব্যাপারে। আমি আর ভাই দুজনেই তখন দুজনের পরম বন্ধু। যদিও আমার ভাই আমার থেকে দশ বছরের ছোট। ও যখন স্কুলে যেত, তখন ঠিক দুর্গার মতো পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে ভাত খাইয়ে দিতাম। টিনের বাক্স, আসন নিয়ে লাস্ট আমি স্কুল গেছি, মাটিতে বসেছি।। কিন্তু ভাই যখন স্কুলে যায় তখন সেই প্যাঁটরা বাক্স হেরিটেজের আখ্যা পেয়েছে। বড় বেলায় ‘পথের পাঁচালী’ পড়েছি আর কেঁদেছি। ভারী ভারী চশমা পরে আলাদা দুটো শিল্প মাধ্যমের আলোচনা করেছি।
একইভাবে ‘সমাপ্তি’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘চারুলতা’ আগে দেখেছি। পরে বড়বেলায় পড়েছি। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল সিনেমাগুলো আগে দেখার ফলে বইয়ে যখন পড়ি তখন চরিত্রের মুখ হিসেবে সেই নায়ক বা নায়িকার মুখটাই ভেসে ওঠে। জটায়ু পড়তে গিয়ে যেমনভাবে ভেসে উঠত সন্তোষ দত্তর মুখ, ঠিক তেমনি ‘সমাপ্তি’ পড়তে গিয়ে মৃন্ময়ীর চরিত্রে বারবার অপর্ণা সেনের মুখটাই ভেসে ওঠে। আর অপূর্বর জায়গায় সৌমিত্র। ছোটবেলায় না বুঝেই সিনেমাগুলো দেখেছিলাম বলে মনে গেঁথে গিয়েছিল। পড়তে পড়তে মনের ভেতর দৃশ্যটা উপভোগ করতাম। দাদার কাছে শুনেছিলাম, সত্যজিৎ রায়ের গল্পে যে জায়গার প্লট থাকে সেই জায়গাটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য তিনি নাকি সেই স্পটে গিয়েই শুটিং করেন। অনেকটা সেই কারণেও আপনার সিনেমা দেখতাম।
সশরীরে না যেতে পারি, অন্তত আপনার হাত ধরে তো অনেক জায়গা ঘুরে আসা যাবে। ছোটদের কাছেই শুধু নয়, আপামর বাঙালির কাছেও ফেলুদা বড় প্রিয়। শুধু ছোটবেলায় নয়, কিশোরী বেলাতেও চারপাশে কোনও সমস্যা হলে ভাবতাম, এসব পুলিশের কম্ম নয়। এখানে একবার ফেলু মিত্তিরকে আনতে পারলেই কেল্লা ফতে। কিন্তু এই সুপ্ত ইচ্ছেটা কাউকে বলতেই পারতাম না। আর কেউ ফেলু মিত্তিরকে ডাকার কথা বলছে না দেখে খুব রাগ হত। পরে বুঝলাম ফেলু মিত্তির আছে আমাদের কল্পনায়, আমাদে ভালবাসায়।
এখন জীবনের জটিলতায় যখনই হাঁপিয়ে যাই তখনই ফেলুদার দ্বারস্থ হই। ‘আগন্তুক’ যতবারই টিভিতে দেয়, ততবারই দেখি। এক একটা বয়সে এক একরকম জীবন পাঠের দীক্ষা দেয় এই সিনেমাগুলো। জানেন, ইউটিউবে কতবার ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি। আরও অনেক কিছুই পাই না। কিছুদিন আগে দার্জিলিং গিয়েছিলাম। আমার কর্তা আমাকে আপনার এবং আরও অনেক গুণী মানুষের স্মৃতি বিজড়িত কেভেণ্টার্স এ নিয়ে গিয়েছিল। ওখানে বসে চিকেন সসেজ খেতে খেতে ভাবছিলাম এখানে ওই কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে আপনিও একসময় খেতেন। ওই ছাদ থেকেই নাকি শুটিং হয়েছিল। কত গল্পে রয়ে গেছে কেভেন্টার্স! কী অদ্ভুত শিহরণ যে হচ্ছিল! ছোটবেলা থেকে আপনার সিনেমা দেখে বড় হয়ে উঠেছি বলে নিজের রুচিকে এখনও বিকৃত হতে দিতে পারিনি। পারি না, হলে যা সিনেমা চলে তাই দেখতে। হতে পারে এটা আমার অক্ষমতা।
চিঠিটা যে দীর্ঘ হয়ে গেল এ নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার মতো আরও অনেকের জীবনের প্রতি পরতে যে আপনি জড়িয়ে আছেন একথা না বললেই নয়। লকডাউন না থাকলে হয়ত আপনার শতবর্ষকে ঘিরে কত উৎসব হত। এরকম নিঃশব্দে কি আপনার জন্মদিন পেরিয়ে যেত! আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে। এত উৎসব, এত আড়ম্বর হয়ত আপনারও ভাল লাগত না। এত হোর্ডিং দেখলে আপনিও হয়ত লজ্জায় মুখ লুকোতেন। যে স্মরণ করার, নিঃশব্দে, নিজের বাড়িতেই করুক। চাইলেই আপনার সিনেমা ইউটিউবে দেখা যায়। দেখুক, আগে দেখে থাকলে, আবার দেখুক। আপনার শততম জন্মদিনে এই চিঠিটুকুই আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।