শুধু একটি বছর

আরও একটা নতুন বছর। অবশ্য নতুন বছর বললেই আমরা ইংরাজির ক্যালেন্ডার বদলের কথা ভেবে নিই। বাংলাতেও যে আলাদা একটা বছর আছে, সেটা আমরা ভুলেই যাই। বাংলার কোন মাস চলছে, অনেকেই বলতে পারি না। তারিখ তো দূর অস্ত। এমনকী এটা কোন বছর, সেই প্রশ্নেও অনেকক্ষণ ভাবতে হয়। বিস্তর ভাবার পর একটা ভুল উত্তর। আসলে, আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে এভাবেই বাংলা যেন একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে।

পয়লা বৈশাখ অবশ্য কতগুলো অনুষঙ্গ নিয়ে আসে। আমরা নতুন পাঞ্জাবি পরি। শাড়ি আর গয়নার দোকান বিজ্ঞাপনে ভরিয়ে দেয়। কোন বাঙালি রেস্তোরাঁয় কী বিশেষ বাঙালি মেনু আছে, তা নিয়ে কাগজে ফিচার বেরোয়। টিভি খুললেও অ্যাঙ্করদের পরণে একটু অন্যরকম পোশাক। একটু অন্যরকমের আড্ডা, অনুষ্ঠান। আর সকাল হলেই হোয়াটসঅ্যাপের সুবাদে নানা রকমের পয়লা বৈশাখের মেসেজ। আমাদের বাঙালিয়ানা এটুকুতেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে বাংলার চর্চা থেকে অনেকটা বিরতই থাকি। আমাদের বাড়ির ছোট ছেলে–‌মেয়েরা ইংলিশ মিডিয়ামে যাওয়া বহুকাল আগেই শুরু করেছে। ইদানীং যেটা দেখা যাচ্ছে, তা হল, দ্বিতীয় ভাষা হিসেবেও বাংলা থাকছে না। সেখানেও বাঙালি বাড়ির ছেলেরা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দিকে বেছে নিচ্ছে। ফলে, আগে যে একটা পেপার বাংলা পড়তে হত, সেটুকুও আর হচ্ছে না। অভিভাবকরাও পরম গর্বে বলে বেড়াচ্ছেন, ‘‌ওর সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ তো হিন্দি। ওদের স্কুলে বাংলা পড়ানোই হয় না।’‌ স্কুলগুলিরও গর্বের সীমা নেই। অন্য কোনও রাজ্যে মাতৃভাষার প্রতি এমন উপেক্ষা আছে কিনা জানা নেই।

বাংলা এফএম–‌এ একটা বকচ্ছপ বাংলা বলা হয়। কিঁউকি, কেনকী এসব শব্দ আমাদের দৈনন্দিন সংলাপে অহরহ ঢুকে পড়ছে। সিরিয়ালের হাত ধরেও অবাধে ঢুকে যাচ্ছে হিন্দি গান। বাঙালির বিয়ে বাড়ির মেনু কার্ডও বদলে গেছে। বিয়ের আসরে এখন মেহেন্দি আর সঙ্গীত। পোশাক–‌পরিচ্ছদ পাল্টে যাচ্ছে। গত এক বছরে একটা বই পড়েছেন, এমন বাঙালির সংখ্যা কত?‌ রাজ্যের মোট বাঙালির ১ শতাংশ এমন পাওয়া যাবে?‌ চারপাশ দেখে মনে তো হয় না। এক বছরে একটা ভাল বাংলা সিনেমা দেখেছেন, সেই সংখ্যাটাই বা কত?‌ এক্ষেত্রেও সংখ্যাটা ২ শতাংশের বেশি হবে বলে তো মনে হয় না। আচ্ছা, গত এক বছরে অন্তত একবার লাইব্রেরি গেছেন, এমন বাঙালি কত?‌ এক্ষেত্রেও সংখ্যাটা নিশ্চিতভাবেই এক শতাংশে পৌঁছবে না। এই নিয়ে কোনও সমীক্ষা হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে, চারপাশে তাকালেই ছবিটা বোঝা যায়।

নতুন বছরে আমরা তাহলে কী করব?‌ বাংলা ডেড ল্যাঙ্গুয়েজ, এটা বলে একটা বিকৃত আনন্দ পাব?‌ নাকি হাহুতাশ করে যাব?‌ এসব পন্থা ছেড়ে নিজেদের জীবন যাপনে যেন একটু হলেও বাংলাকে ফিরিয়ে আনতে পারি, সেই চেষ্টাই বোধ হয় করা উচিত। না, বাংলা ভাষার জন্য মিছিল করতে হবে না, প্রাণ দিতেও হবে না। মাসে অন্তত একটা ভাল বই পড়া, একটা ভাল বাংলা ছবি দেখা, অন্তত একটা চিঠি লেখা, কয়েকটা গান শোনা— এটুকু তো করতে পারি। তাহলেও পরের প্রজন্ম কিছুটা বাংলার ছোঁয়া পাবে। এটুকুও যদি না পারি, তাহলে পয়লা বৈশাখের পাঞ্জাবি বা শাড়ি পরে আদিখ্যেতা না করাই ভাল।

****************************

 

এটি বেঙ্গল টাইমস ই–‌ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয় প্রতিবেদন। ম্যাগাজিনটি পড়তে চাইলে নীচের লিঙ্কে ক্লিক করুন। ডাউনলোড না করেও এক ক্লিকে পড়তে পারবেন। চাইলে অন্যদের পাঠাতেও পারবেন।

https://bengaltimes.in/wp-content/uploads/2023/04/poyla-boishakh-issue.pdf

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.