প্রাজ্ঞদীপা হালদার
এক পৃথিবী ছিল, যেখানে মেয়েদের নাম হতো পূর্ণিমা। আজকালকার অয়নাংকশী, দেওয়ান্বিতা এইসমস্ত নাম যা আমার কীবোর্ড অব্ধি টাইপ করতে চায় না, এই যুগে বোধহয় খুব কম মেয়ের নামই পূর্ণিমা হয়। চুমকিও বোধহয় নাম হয় না ।
আমাদের সেই পুরনো প্রাচীন পৃথিবীতেই এমন নায়িকা হতেন। ভাইটাল স্ট্যাট নেহাৎই বাংলার মাটি সঞ্জাত। কোমরে মেদ, গাল ফোলা। মাথায় পাতাকাটা চুল, ছাপার শাড়ি। একটা সময় পর্যন্ত বাঙালি মেয়েদের এমনটাই দেখতে ছিল। চুমকি চৌধুরির বাবা সিনেমা বানাতেন বলেই নাকি উনি সিনেমায় চান্স পেতেন এমন শোনা যায়। মধ্যবিত্ত শেষ প্রজন্মের প্রিয় ছিলেন চুমকি চৌধুরি। প্রতি শুক্রবার সরমা আর লালীতে রমরমিয়ে সিনেমা আসতো বড় বৌ, মেজো বউ। সেই সব একটানা লাল সিনেমাহলগুলো আর নেই, ফ্ল্যাট উঠে গেছে।
নায়িকার নায়িকাত্ব ঘুচে যায় দয়িতের ভুজবন্ধনে চক্ষুমুদে পড়ে থাকার বদলে সে যদি চৌচাপটে চড় হাঁকায় কাউকে। ভাবা যায় না বাঙালি সংস্কৃতির এপিটোম রবীন্দ্রনাথের নায়িকারা বা সত্যজিতের নায়িকারা কাউকে মারধোর করছে। অবশ্য চড় কষিয়ে নিজের ঘাড়ে নিজেই মুখ লুকিয়ে কেঁদে নেওয়া সে ভীষণ মেয়েলি, ঋতুপর্ণের ছবিতে আছে, আছে মারার পরেকার ক্লান্তি ও বিষাদ। সরোজ বন্দোপাধ্যায় বলেছেন আসলে আমরা নায়িকা হিসেবে খুঁজি শৈবলিনীর মতো সুন্দরী, কুন্দের মতো করুণ, সুচরিতার মতো রিজার্ভড, এবং কুমুর মতো ইমোশনাল একজনকে । সত্যিই তাই। এ কারণেই আমাদের সকল নায়িকা সম্ভাষণ ব্যর্থ । ‘এই বন্দীই আমার প্রাণেশ্বর’ বলতে গেলে যা প্যাশনের প্রয়োজন চুমকি চৌধুরির তা দিব্য ছিল। বাংলা সিনেমাতে তার আগে কিল খেয়ে কিল চুরি করা মেয়েদেরই প্রাদুর্ভাব।
অশ্রুসজল সামাজিক ছবিতে বাড়ির হককথা বলা কাজের মেয়ে, নির্যাতিত মেজো বউ বা কর্তব্যনিঠ নার্সের ‘রোল’ করতেন চুমকি। তার পর আস্তে আস্তে পৃথিবী বদলাল। সৌন্দর্যের একটি গ্লোবাল উদাহরণ সেট হল। ভেজা ঠোঁট, সরু কোমর, পীবরস্তনী নায়িকারা সমস্ত রঙিন পোস্টারের দখল নিলেন। চুমকি বহুদিন ছবি করেন না মনে হয়। করলেও আমি দেখিনি। চুমকি বাঙালির আশা পারেখ। সাদা সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে বাবাকে বলেন, আমি অমুকের সঙ্গে বাইরে যাচ্ছি। বলে প্রায়ান্ধকারে রাখা একটি সাদা অ্যাম্বাসাডারের দিকে হেঁটে চলে যান। ফিরে আসেন কি না জানা নেই। এই অ্যাম্বাস্যাডর, এই সিনেমাহল, এই নায়িকা, সিনেমায় নিম্নবিত্ত পরিবারের ভিজে কলতলা সবই একটা হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার চিহ্ন।
চুমকি চৌধুরি প্রিয় নায়িকা একথা কেউই আজকাল বলবেন না। বাংলা ছায়াছবির ইতিহাস লেখা হলে চুমকির মতো অনেক নায়িকা অকথিত থেকে যাবেন। কারণ, তাঁরা ক্লাস নন মাস। ইটস নট সো কুঊউউল। আমিও বলব না শিওর। কিন্তু পর্দায় নয়ের দশকের নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়েদের শ্রেণি প্রতিনিধিত্ব করতেন চুমকি। যা আদপেই ঝাঁ চকচকে নয়, অথচ বিনোদনের গুরুত্বকে স্বীকার করতে বাধ্য করায়।
মনে মনে চুমকিকে আয়েষার রোল দিয়ে দিই। বঙ্কিমী প্যাশনের এমন নায়িকা, আর কেউ ছিলেন না। এখনও নেই।