ধর্মোন্মাদদের হাত থেকে ধর্মস্থান রক্ষা পাক

ময়ূখ নস্কর
ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর কোনও এক নেতা নাকি ধুয়ো তুলেছিলেন, খাজুরাহোর মন্দিরগুলো অশ্লীল। তাই মন্দিরগুলোর গা চেঁছে সমান করে দেওয়া হোক। ধ্বংস করা হোক মন্দিরগাত্রের মিথুনমূর্তিগুলি।
আমরা যারা নাস্তিক, যারা মন্দিরে-মসজিদে যাই না, তারা কিন্তু কখনও কোনও ধর্মস্থান ধ্বংস করি না। বরং কোনও শিল্পগুণসমৃদ্ধ ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ মন্দির বা মসজিদ বা গির্জা ধ্বংস হলে আমাদের কান্না পায়। কারণ আমাদের মতোই অনেক সাধারণ, খেটে খাওয়া মানুষ, অনেক কষ্টে, অনেক সাধনায় এই স্থাপত্যগুলি তৈরি করেছেন।

buddha murti2
আমাদের পরম সৌভাগ্য যে স্বাধীন ভারতের শাসকরা খাজুরাহোর মন্দিরগুলিকে নিজেদের মর্জিমাফিক ‘শ্লীল’ বানিয়ে দেননি। মানুষের যা যা ভয়ংকর মানসিক ব্যধি আছে, তার মধ্যে প্রধান হল, আমি যা জানি না, যা আমার পছন্দ নয়- তাকেই খারাপ বলে গণ্য করা। আমি বাঙালি তাই বিহারিরা খারাপ, আমি হিন্দু, অতএব মুসলমানরা খারাপ, আমি তৃণমূল, তাই  সি পি এম খারাপ। এবং আমরা সুযোগ পেলেই সেই খারাপগুলোকে ধ্বংস করতে উদ্যত হই।
তাই আমরা হনুমান সেজে অনার্য রাক্ষসদের সোনার শহর পুড়িয়ে দিই, ইন্দ্র সেজে অনার্যদের নগর ধ্বংস করি (ইন্দ্রের অপর নাম পুরন্দর বা নগর ধ্বংসকারী), সুলতান মামুদ সেজে সোমনাথের মন্দির ভাঙি, বখতিয়ার খিলজি সেজে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগুন লাগাই, রাজা শশাঙ্ক সেজে বোধিবৃক্ষ নির্মূল করি, আমরা ইংরেজ সেজে লালকেল্লার মহলের পর মহল ভেঙে সেনা ব্যারাক বানাই,হিটলার সেজে ইহুদিদের গণহত্যা করি, তালিবান সেজে বুদ্ধমূর্তির ওপর কামান দাগি, সাদ্দামের মুণ্ডু চাই বলে ব্যবিলনের সভ্যতার ওপর বোমা ফেলি। আমাদের উন্মত্ততা এমনই যে, যে-স্থানকে রামের জন্মভুমি বলে দাবি করি, সেখানেই হাতুড়ি-শাবল চালাই। সর্বযুগে, সর্বধর্মে একই ইতিহাস। ইতিহাসের এই ধারাবাহিকতা মেনেই, ধর্ম এবং ধর্মোন্মাদদের এই ধারাবাহিকতা মেনেই ইরাক-সিরিয়া জুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে আই. এস. জঙ্গিরা। নিমরুদ, রামাদি,পালমাইরা- একের পর এক ঐতিহাসিক শহরে তারা পুরাকীর্তি
ধ্বংস করছে। ধ্বংস করছে লাইব্রেরি, মিউজিয়াম।
স্বাভাবিক। যাদের কোনও কিছু গড়ার ক্ষমতা নেই, তারাই সবকিছু ভাঙতে চায়। ধর্মোন্মাদরা জানে, তারা অক্ষম, অপদার্থ। প্রাচীন যুগের শিল্পীদের হাতুড়ির শক্তি, জঙ্গিদের হাতুড়ির থেকে অনেক বেশি ছিল। সেই হাতুড়ি ধ্বংস করত না, সৃষ্টি করত। এই সত্যটা জানে বলেই, জঙ্গিরা যা কিছু প্রাচীন তাঁকে ধ্বংস করতে চায়। কারণ এই স্থাপত্য-ভাস্কর্যগুলি টিকে থাকলে প্রমাণ হয়ে যাবে, ধর্মের আবির্ভাবের আগেও সভ্যতা ছিল। ধর্মকে বাদ দিয়েও মানুষ উন্নত জীবনযাপন করত।

babri2
মাঝে মাঝে ভাবি, ধর্ম কি এতটাই হীনবল যে অন্যকে আঘাত না করে জয়ী হতে পারে না? আরও ভাবি, যে পাশ্চাত্য শক্তি কথায় কথায় গণতন্ত্র- মানবাধিকারের বুলি আওড়ায় তারা এখনও অনড় কেন? অবশ্য এটাও স্বাভাবিক। তাঁদের গণতন্ত্র তো নির্ভর করে নিজেদের অর্থনীতি আর সামরিক স্বার্থের উপরে। তাদের কাছে পশ্চিম এশিয়ার সুমহান সভ্যতার কোনও মূল্য নেই। বামিয়ানে বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসের সময় তারা চুপ করে ছিল, নড়েচড়ে বসেছিল নিউ ইয়র্কে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর। কারণ, তারা স্থাপত্য বলতে বোঝে ওই সিড়িঙ্গে লম্বা বহুতল। আর সভ্যতা বলতে বোঝে নিজেদের সভ্যতাকে। যার বয়স বড়জোর ২৫০০ বছর। আজ যদি আইফেল টাওয়ার বা বিগ বেনে একটা পটকাও ফাটত,  তারা সভ্যতা বিপন্ন বলে রে রে করে
ঝাঁপিয়ে পড়ত।
কাজেই যতদিন না হোয়াইট হাউস, বিগ বেন, আইফেল টাওয়ারে হামলা হয়, ততদিন ধর্মের নামে মানবতার এই ধ্বংসসাধন চলতেই থাকবে। রাষ্ট্রসংঘ চোখে ঠুলি এঁটে বসে থাকবে। এক ধর্ম অন্য ধর্মের দোষত্রুটি খুঁজবে। চোখের জল পড়বে শুধু নাস্তিকদের। যারা ধর্ম মানে না। মানুষকে মানে, শিল্পকে মানে, সভ্যতাকে মানে।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.