পুলিশ বাজেটে ফের বাজিমাত ভিক্টরের

স্বরূপ গোস্বামী

বিধানসভা আবার জমিয়ে দিলেন আলি ইমরান (ভিক্টর)। শুক্রবার ছিল পুলিশ দপ্তরের বাজেট। হাজির ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও। তাঁর সামনেই পুলিশের ব্যর্থতার নানা দিক তুলে ধরলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের এই তরুণ বিধায়ক। পুলিশের সেই ব্যর্থতার জন্য দায়ী করলেন পুলিশমন্ত্রী, তথা মুখ্যমন্ত্রীকেই।

তিনি যখনই সমালোচনা করছিলেন, তখনই প্রবল চিৎকার আসছিল শাসক দলের বেঞ্চ থেকে। সেই চিৎকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি স্পিকার। মাঝে ভিক্টর বলেই ফেলেন, রাজ্যে সরকার কেমন চলছে, তা এই বিধানসভা থেকেই স্পষ্ট। এখানে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে, স্পিকারের উপস্থিতিতেই চিৎকার করা হচ্ছে। আমাদের কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না। রাজ্যের অবস্থাও ঠিক তেমনি। সেখানেও যা যা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রীর চোখের সামনেই হচ্ছে।

প্রবল চিৎকারে তাঁর সব কথা শোনা যায়নি। তাই কিছু কথা ভেতরে, কিছু কথা বাইরে। বাইরে বেরিয়ে সেই বক্তব্য আরও স্পষ্ট করে সাংবাদিকদের বলেন এই তরুণ বিধায়ক। সবমিলিয়ে পুলিশ বাজেটে ভিক্টরের ভাষণের নির্যাস।।

 

১)  আমাদের অনেক বন্ধু ছিল। যারা গর্ব করে বলত, আমার বাবা পুলিশ। যেখানে দরকার নেই,  সেখানেও বলত। ভাবত, পুলিশ বললে হয়ত বাড়তি সম্মান পাওয়া যাবে। হয়ত তার বাবাকে লোকে সাহসী ভাববে। কিন্তু এখন যারা পুলিশের সন্তান, তারা যখন স্কুলে যায়, তারা বোধ হয় নিজেদের বাবার পরিচয় আর দেয় না। জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যায়। কারণ, সে জানে, এখন পুলিস বললে, বন্ধুরা তার বাবাকে ঘৃণার চোখে দেখবে। মেরুদন্ডহীন ভাববে। একজন পুলিশের স্ত্রীও আর নিজের পরিচয় দিতে পারেন না। হ্যাঁ, পুলিশকে আপনি এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছেন।

২) দোষটা যত না পুলিশের, তার থেকে বেশি আপনার। কনস্টেবল দেখছে, তৃণমূলের পাড়ার নেতারা এসে ওসিকে চমকে যাচ্ছে। ওসি দেখছে, জেলার নেতারা এস পি-কে চমকাচ্ছে। এস পি দেখছে, ডিজি, আইজি কে মুখ্যমন্ত্রী চমকে যাচ্ছে। একটা ভয়ের আবহ আপনি তৈরি করেছেন। কেউ মাথা উঁচু করে কাজ করতে পারছে না।

bidhansabha2

৩) আমাদের সময় অনেক সময় পুলিস নিষ্ক্রিয় থেকেছে। হয়ত অনেক সময় অন্যায় সুবিধা নিয়ে মামলা হালকা করে দিয়েছে। কিন্তু নির্দোষ লোকেদের জেলে ভরেনি। আপনারা নির্লজ্জতার সব সীমা ছাড়িয়ে গেছেন। আরামবাগ, খানাকুল, গোঘাট, গড়বেতা, কেশপুর, সারেঙ্গা, জয়পুর, পাত্রসায়র, কোতুলপুর—এসব এলাকায় মানুষ আতঙ্কে ঘরছাড়া। ঘরে ফিরলেই হামলা করবে। পুলিশ মিথ্যে মামলায় ফাসিয়ে দেবে। আপনারা ঝগড়া করছেন। ধরা হচ্ছে আমাদের লোককে। এটাই মোটামুটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

৪) কোথাও কিছু ঘটলে মুখ্যমন্ত্রীর প্রথম কাজ হল সেটাকে অস্বীকার করা। প্রথমেই তিনি বলে দিচ্ছেন সাজানো ঘটনা। এরপর পুলিশ কী করে নিরপেক্ষ তদন্ত করবে ? মুখ্যমন্ত্রীর কথার বিরুদ্ধে গেলে কী হয়, তা ভাল করেই বুঝেছেন দময়ন্তী সেন। পার্ক স্ট্রীটে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, সাজানো ঘটনা। দময়ন্তী সেন প্রমাণ করলেন, ওটা সাজানো ছিল না। ফল কী হল ? তাঁকে জোর ধমক দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বদলি করে দেওয়া হল। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার জয়রামন। এস জে ডি এ দুর্নীতির তদন্ত করতে গেলেন। একজন আমলাকে অ্যারেস্ট করলেন। আরও বড় মাথা জড়িয়ে পড়তে পারে। যেই বুঝলেন, অমনি কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে পাঠিয়ে দিলেন সৎ অফিসার জয়রামনকে।

৫) মুখ্যমন্ত্রী যেখানেই যাচ্ছেন, ডিজি, আইজিকে জিজ্ঞেস করছেন, বলুন আমি ঠিক বলছি কিনা ? কার ঘাড়ে কটা মাথা ? আপনি ডাঁহা অসত্য বলে চলেছেন। আর পুলিশ-কে ‘হ্যাঁ ঠিক’ বলতে হচ্ছে। নিজে যত খুশি মিথ্যে বলুন। পুলিশকে দিয়ে কেন এভাবে মিথ্যে বলাচ্ছেন ?

৬) সেদিন আপনি বললেন, আপনি যখন কলেজে পড়তেন, সিপিএম নাকি স্টেনগান নিয়ে আপনাকে তাড়া করত। এমন সত্যি কথা সাম্প্রতিক অতীতে এই রাজ্যে আর কেউ বলেছেন ? একজন বাচ্চা আমাকে জিজ্ঞেস করল, সত্যিই সিপিএম এরকম করত ? তখন স্টেনগান ছিল ? আমি কী উত্তর দেব, ভেবে পেলাম না। বললাম, আমি তো তখন হইনি। তাই বলতে পারব না ? তারপর সে বলল, মনে হয় জোকস বলল, তাই না ? আপনি এমন সত্যি কথা বলেন, একজন বাচ্চা ছেলেও সেটা ধরে ফেলে।

৭) নজরুল সাহেব। এই আই পি এসের সততা নিয়ে কোনও প্রশ্ন কেউ কখনও তোলেনি। রাজ্যের মানুষকে জিজ্ঞেস করুন, কয়েকজন সৎ ও দক্ষ আই পি এসের নাম করতে। তাঁদের অনেকেই নজরুল সাহেবের নাম করবেন। কোনও মিডিয়ার প্রচার নয়। কোনও মুখ্যমন্ত্রীর সার্টিফিকেট তাঁর দরকার হয়নি। সততার প্রতীর হোর্ডিং দিতেও হয়নি। রাজ্যের মানুষ তাদের অভিজ্ঞতা থেকেই জানেন। রেলমন্ত্রী হওয়ার পর আপনি প্রথমে তাঁকে দিল্লি নিয়ে গেলেন। তারপর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এই রাজ্যে নিয়ে এলেন। তারপর তাঁর কী পরিণতি হল, আমরা সবাই জানি। তিনিও বুঝেছেন, তাঁকে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। যতদিন তাঁর সংখ্যালঘু পরিচয়টা আপনার দরকার ছিল, ততদিন তাঁকে ব্যবহার করেছেন। যেদিন বুঝেছেন, এই লোকটা আর দশজনের মতো স্তাবক নয়, দূরে সরিয়ে দিয়েছেন।

তিনি যেদিন রিটায়ার করেন, চোখের জল ফেলে তাঁকে ভবানীভবন ছাড়তে হয়েছে। একজন পুলিশ কর্তাও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাননি। একজন জুনিয়র পুলিশ কর্মীও তাঁর হাতে ফুল তুলে দিতে পারেননি। কড়া নির্দেশ ছিল, ওই ঘরে কারও যাওয়া চলবে না। একজন অফিসারও এতদিনের সতীর্থকে বিদায় জানাতে গেলেন না। তাঁর জীবনের সবথেকে দুঃখের দিন বোধ হয় সেটাই। যাঁকে গোটা রাজ্যের মানুষ সম্মানের আসনে বসিয়েছে, তাঁর সঙ্গে তাঁর সহকর্মীরা দেখা করতে পারলেন না। পাছে, আপনার কানে খবর চলে যায়। পাছে, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নম্বর কমে যায়। হ্যাঁ, এমনই এক ভয়ের বাতাবরণ আপনি তৈরি করেছেন।

৮) আপনারা পুলিশের সমালোচনা করতে হলে বেছে বেছে দু তিনটি উদাহরণ তুলে ধরেন। প্রথমে বলেন বানতলা। তারপর বলেন একুশে জুলাই। তারপর গড়বেতা, কেশপুর, এসব বলতে বলতে উদাহরণ থেমে যাবে। আপনাদের একটা সুবিধা আছে। এই চার পাঁচটা নাম সহজেই মনে রাখা যায়। আমাদের মুশকিলটা হল, প্রতিদিন একেক প্রান্তে একেকটা ঘটনা ঘটছে। সকালের লজ্জাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে বিকেলের লজ্জা। কাগজেও এত লেখার জায়গা নেই। চার বছরে এত জায়গায় এত কান্ড করলেন, একটা মানুষের পক্ষে মনে রাখাও সম্ভব নয়। মানুষ বুঝেই গেছে, পুলিশের কাছে গিয়ে কোনও ফল হবে না। পুলিশ অভিযুক্তকে নয়, অভিযোগকারীকেই আগে জেলে ঢুকিয়ে দেবে।

৯) গতকালকের দুটো উদাহরণ তুলে ধরা যাক। সাত্তোরে কী হচ্ছে, সবাই জানেন। ভয়াবহ এক অবস্থা। কী করে শান্তি ফেরানো যায়, সেই চেষ্টা নেই। অথচ, তিনি বলে দিলেন ‘সাজানো ঘটনা।’ এটা কোনও মুখ্যমন্ত্রীর কথা হল ? এত এত মানুষ বোমার আঘাতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন । আর আপনি বলে দিলেন সাজানো ঘটনা ? একবারও মনে পড়ল না ওই অসহায় মানুষগুলোর কথা ?

আপনি সবকিছু আগাম জানতে পেরে যান। আপনি যখন বলে দিলেন, সাজানো ঘটনা, এরপর এস পি-কে তো আপনার মনের মতো রিপোর্টই পাঠাতে হবে।

 

১০ ) গতকালের আরেকটা ঘটনা বলি। পুরসভা ভোটে কী করেছেন, সবাই জানে। বোর্ড গঠনকে ঘিরেও এক সন্ত্রাস চলছে। আর তাতে মদত দিয়ে চলেছেন আপনি। কাটোয়ায় কংগ্রেসের কুড়ি বছরের  চেয়ারম্যান কংগ্রেসের রবি চ্যাটার্জি। এবার সেখানে ভোটের নামে যা হয়েছে, তা প্রহসন। এতকিছু করেও ২০ টি আসনের মধ্যে আপনারা পেলেন ১০ টি। কাল কী করলেন ? কংগ্রেসের তিন জনকে ভাঙিয়ে বোর্ড গড়লেন। মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানে কী করলেন ? ২৩ আসনের মধ্যে আপনারা পেলেন মাত্র ৬ টি। সেখানেও আপনারাই বোর্ড গড়বেন। অন্য দল ভাঙিয়ে লোক এনেছেন। আপনার নির্দেশ ছাড়া এটা হয়েছে, এটা আমাদের বিশ্বাস করতে হবে ?  কাউন্সিলরদের ভয় দেখানো হয়েছে, লোভ দেখানো হয়েছে। তারা জানে, পুলিশে গিয়েও কিছু হবে না। কারণ, সবকিছু হচ্ছে আপনার নির্দেশে। এমনকি কোথাও কোথাও হুমকি দেখানোর কাজে পুলিশকেও ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। বামেদের টিকিটে জেতা কাউন্সিলর, বিজেপি-র টিকিটে জেতা কাউন্সিলরকে এভাবে দলে নিতে লজ্জা হয় না ? একবারও মনে হল না, এরা এক মাস আগে আপনার বিরুদ্ধে রায় দিয়ে এই মানুষগুলোকে তাদের এলাকার লোক জিতিয়েছেন ? যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁরা কেউ ভয়ে যাচ্ছেন, কেউ লোভে যাচ্ছেন। লোভে গেলে, সেটাও অনৈতিক। কিন্তু যার নির্দেশে লোভ দেখানো হচ্ছে, তার দায় কি কোনও অংশে কম ? ভোটে হেরেও আপনি সবাইকে কিনে নিতে চান ? এরপরেও সততার হোর্ডিং লাগান ? আর যদি বলেন, এই কেনাকাটায় আপনি যুক্ত নন, তাহলে সৎসাহস থাকলে আপনার সেই জেলা নেতাদের বহিষ্কার করুন।

 

?????????

 

১১) আপনার দাবি, জঙ্গলমহলে নাকি শান্তি ফিরে এসেছে। তাহলে সেখানে যৌথ বাহিনী কী করছে ? এত যৌথ বাহিনী মোতায়েন রাখতে হচ্ছে কেন ? পুরসভার নির্বাচনে কেন্দ্রের তরফ থেকে বলা হল, রাজ্যে থাকা  কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করতে পারেন। তাহলে, দুদিনের জন্য সেই বাহিনী তুলতে পারলেন না কেন ? এতই যদি শান্তি ফিরেছে, তাহলে যৌথ বাহিনী তুলে দিন। যৌথ বাহিনীও রাখব, আর জঙ্গলমহল হাসছে বলে দাবিও করব, দুটো একসঙ্গে স্ববিরোধী হয়ে গেল না ?

১২) কিছু ঘটলে আপনার প্রথম কাজ হল সেটাকে অস্বীকার করা। তারপর সেই ঘটনার দায় বিরোধীদের ঘাড়ে বা মিডিয়ার ঘাড়ে চাপানো। আর আপনার অফিসারদের কাজ হয় সেই প্রমাণ লোপাট করা। যেই শুনল, ইডি পরের দিন ব্যাঙ্কের লকার খুলবে, অমনি রাত দশটার সময় বিধাননগর পুলিশ হাজির। রাতের বেলায় ম্যাজিস্ট্রেটকে সই করিয়ে, রাত দশটায় ম্যানেজারকে গিয়ে ব্যাঙ্কের লকার খোলাতে গেল আপনার পুলিশ। এক বছর ধরে যারা ঘুমিয়ে ছিল, ইডি আসছে জেনেই তারা এত তৎপর হয়ে উঠল কেন ? যে পুলিশ এমন আচরণ করে, তাকে সন্দেহ করলে কি খুব ভুল হবে ? সারদা কান্ডে একের পর এক প্রমাণ লোপাট করে গেছে আপনার পুলিশ। দুদিন আগে এত লোককে বঙ্গভূষণ দিলেন, সেই অফিসার অর্ণব ঘোষকে একটা বঙ্গবিভূষণ দিতে পারলেন না ! অবশ্য, আপনি বুঝতে পেরেছেন অর্ণব ঘোষের অভিমান হতে পারে। তাই তার আগের দিন তাঁকে নদীয়ার এস পি থেকে তুলে এনেছেন সিআইডি তে। প্রমাণ লোপাট করা যার একমাত্র কাজ, তিনি করবেন তদন্ত। এই অফিসারের উপর মানুষের ভরসা থাকবে ?

১৩) আপনার এই এস পি নদীয়ায় থাকাকালীন তাঁর বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ। সবগুলোর প্রমাণ নেই। তবে উনি নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন, যাই শুনি, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। পুরভোটের আগের দিন দু হাজার জামাত ইসলামির জঙ্গি ঢুকেছিল বাংলাদেশ থেকে। বিভিন্ন থানায় এই এস পি নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই জঙ্গিদের যেন কিছু না করা হয়। তাদের যেন কোনওভাবে বিরক্ত না করা হয়। দেশি গুন্ডাদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন, তবু না হয় মেনে নেওয়া গেল। তাই বলে বিদেশি গুন্ডাদেরও জামাই আদর করে রাখতে হবে ? ভোটের আগের দিন আমাদের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নিয়ে গিয়েছিলেন রাজ্যপালের কাছে। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতিও গিয়েছিলেন। সূর্যকান্ত মিশ্র যখন দায়িত্ব নিয়ে কোনও অভিযোগ করেন, তখন তাকে বিশ্বাস করতেই হয়। কারণ, ভিত্তিহীন অভিযোগ নিয়ে তিনি রাজ্যপালের কাছে যেতেন না। এ ব্যাপারে তাঁর সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা আপনার থেকে অনেক বেশি।

 

১৪ ) সেই এস পি-র আমলেই ঘটল রানাঘাটের সেই ধর্ষণকান্ড। না, এর জন্য পুলিশকে দায়ী করছি না। আপনি সেখানে গেছেন। ভালই করেছেন। কিন্তু গিয়ে কী করলেন ? কিছু লোক বিক্ষোভ দেখাল । আপনি মেজাজ হারিয়ে ফেললেন। সিপিএম, মাওবাদি, আপনাকে খুন করতে চেয়েছিল, কত কথা বলে ফেললেন । এগুলো একজন মুখ্যমন্ত্রীর কথা ? কিছু হলেই আপনি বলে বসেন, আপনাকে খুন করতে চেয়েছিল। এগুলো শুনলে এখন আপনার দলের লোকেরাই হাসে। আপনি ফিরে এসে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিলেন। ঠিক কাজই করেছিলেন। কিন্তু শেষমেষ সিবিআই এল না কেন ? কারণ, সিবিআই তদন্তের সুপারিশ করতে গেলে যেসব নিয়ম কানুন মানতে হয়, তা আপনি বা আপনার অফিসাররা মানেননি। আপনার অফিসাররাও নিয়ম জানেন না ? এটা বিশ্বাসযোগ্য ? সিবিআই তদন্তের ঘোষণা করলেন, কিন্তু যেখানে চিঠি পাঠানোর, পাঠালেন না। আপনি না বললে আপনার অফিসাররা কী করে পাঠায় ! আপনার অফিসাররা আপনার সঙ্গে সাবোতাজ করছেন না তো ? তাঁদের ভেতরে সিপিএম বা মাওবাদী লুকিয়ে নেই তো ?

১৫) রানাঘাট কান্ডে সেই সন্ন্যাসীকে রাজ্য ছেড়ে পালাতে হল। রাতের অন্ধকারে তাঁকে রাজ্য থেকে বের করে দিলেন। সেই সন্ন্যাসিনীও রাজ্যের উপর আস্থা হারিয়েছিলেন। শুধু তিনি চলে যাননি, সারা বিশ্বের কাছে আমাদের মাথাটাও আরও হেঁট করে দিয়ে গেলেন।

১৬) বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-বর্ধমানের বিভিন্ন অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বেআইনি খাদান চলছিল। এখনও সেখান থেকে কয়লা তোলা হচ্ছে। সবাই জানেন। কিন্তু কে ব্যবস্থা নেবেন ? শোনা যায়, অনেক উপর পর্যন্ত নাকি সেই ভাগ যায়। মেজিয়ায় একটি দুর্ঘটনা হল। স্থানীয় লোকেদের দাবি, একশো জনের বেশি শ্রমিক মাটির তলায় চাপা পড়ে আছেন। পুলিশের প্রথম কাজ হল, সেই এলাকায় মাটি দিয়ে ভরাট করে লাশ গায়েব করা। সেখানে আমাদের সাংসদ, বিধায়করা গেলেন। তাঁদের তাড়া করা হল। এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হল না। যদি আপনার সৎ সাহস থাকে, এখনও ওই জায়গায় মাটি খোড়ার নির্দেশ দিন। অন্তত শতাধিক মৃতদেহ বেরিয়ে আসবে। হ্যাঁ, সেদিন আপনার পুলিশ ওই মৃতদেহ লোপাট করেছিল।

mamata6

১৭) ফরজানা আলম। এক মাস আগেও তিনি আমাদের এই শহরের ডেপুটি মেয়র ছিলেন। তিনি আপনার দলেরই নেত্রী ছিলেন। কয়েকদিন আগে তাঁর দুঃখজনক মৃত্যু হল। তার কয়েকদিন আগে তার উপর আপনার দলের লোকেরাই হামলা চালিয়েছিল। ফরজানা এফ আই আর করলেন। কাউকে ধরা হল না। তিনি মারা গেলেন। তার পরেও কাউকে ধরা হল না। আজ আপনি তাঁর পরিবারের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আপনি নিজেও জানেন, আপনি আপনার দল, আপনার পুলিশ কতটা অপরাধী। এই বিধানসভায় দাবি জানাচ্ছি, তাঁর সেই এফ আই আর-কে তাঁর মৃত্যুকালীন জবানবন্দী হিসেবে ধরা হোক। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী, এর পরেও সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকবেন ?

১৮) স্বয়ং আপনি থানায় গিয়ে আসামী ছাড়িয়ে আনছেন। আপনার নেতারাও তাঁদের নেত্রীর পথ অনুসরণ করছেন। এমনিতেই পুলিশ তৃণমূল জানলে তার বিরুদ্ধে এফ আই আর নেয় না। যদিও বা কাউকে ধরা হল, ব্যাস, নেতা এসে থানায় হাজির হয়ে গেলেন। বাঁকুড়া জেলার দুটি ঘটনা। ভোটের পর দিন সোনামুখীর বিধায়ক দীপালি সাহা থানায় গিয়ে পুলিশকে শাসিয়ে এলেন। কয়েকদিন আগে একদল থানায় এসে ভাঙচুর করল। তাকে ছাড়াতে থানায় হাজির হয়ে গেলেন স্বয়ং জেলা পরিষদের সভাধিপতি।

১৯) আপনার দলের নেতারা যে যখন পারছে, পুলিশের গায়ে হাত তুলছে। আপনার এক শ্রমিক নেত্রী পুলিশকে চড় মারলেন। আপনার দলের সাংসদ প্রসূন ব্যানার্জি। তিনিও তাই করলেন। তিনিও প্রকাশ্য রাস্তায় পুলিশকে চড় মারলেন। আপনার দলের আবু আয়েশ মণ্ডল তিনিও টোল প্লাজায় পুলিশকে চড় মারলেন। আর নিচুতলার নেতাদের কথা তো বাদই দিলাম। একটি ক্ষেত্রেও কোনও ব্যবস্থা নিতে পেরেছেন ? পারেননি বলেই এই চড় মারার প্রবনতা দিন দিন বাড়ছে।

২০) সাহস বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় চলে গেছে, থানায় গিয়েও পুলিশের উপর হামলা করছে। পুলিশকে ফাইল দিয়ে টেবিলের তলায় লুকোতে হচ্ছে। আরও একটি ঘটনার কথা বলি। পূর্ব মেদিনীপুরে। এই রাজ্যের এক তরুণ সাংসদ ভাষণ দিচ্ছিলেন। হঠাৎ এক যুবক এসে তাঁকে থাপ্পড় মারলেন। কোনওভাবেই এই ঘটনাকে সমর্থন করছি না। তীব্র ভাষায় নিন্দা করছি। আমরা আপনাদের মতো নই। খারাপটাকে খারাপ বলতে জানি।

কিন্তু তারপর কী হল ? সেই ছেলেটিকে সবাই মিলে মারতে লাগল। না, জনতা নয়। মঞ্চে থাকা নেতারা। কেউ জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ, কেউ বিধায়ক। মঞ্চের উপর একজনকে নির্মম ভাবে সবাই মারছে। পুলিশ নির্বিকার। কিন্তু নির্বিকার থাকলেই কি উপায় আছে ? থানায় চড়াও হয়ে হামলা চালালো আপনার দলের লোকেরা। কেন যুবনেতার গায়ে হাত পড়ল, মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হল ডিএসপি-র। এত কিছু যখন‌ ঘটছে, তখন সেই তরুণ সাংসদ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন। এত কিছুর পর আপনার পুলিশ সেই ছেলেটির বিরুদ্ধে নানা রকম মামলা দিল। কিন্তু সেই ছেলেটিকে নির্মমভাবে মারার জন্য, থানা ভাঙচুর করার জন্য, আপনার দলের কোনও নেতার বিরুদ্ধে কোনও মামলা হয়েছে ? সেই সাংসদ সেদিন প্রমাণ করে দিয়েছেন, সাংসদ তো দূরের কথা, পঞ্চায়েতের নেতা হওয়ার যোগ্যতাও তাঁর নেই। পিসি আছেন বলেই তিনি সাংসদ।

২১) আপনার বাজেট বইটা পড়ছিলাম। দু নম্বর পাতায় আসুন। সেখানে কী কী করেছেন, তার লিস্ট দিয়েছেন। সেখানে মুরগি পালন থেকে কন্যাশ্রী, সাইকেল বিলি থেকে দু টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া, মিনিকিট দেওয়া থেকে সেলাই মেশিন দেওয়া, ইন্দিরা আবাস থেকে একশো দিনের কাজ – এসব কাজের ফিরিস্তি দিয়েছেন। মোট সতেরোটি কাজের লিস্ট। তার মধ্যে ষোলটির সঙ্গে পুলিশের কোনও সম্পর্কই নেই। এটা পুলিশ বাজেট ? আগের পুলিশ বাজেটগুলো একটু পড়ে নেবেন। একটা বাচ্চা ছেলেকে লিখতে দিলে সেও এমন অবান্তর কথা লিখত না। যদি অফিসাররা ও লিখে থাকেন, তাহেল তাঁদের শিক্ষাদীক্ষার এই হাল দেখে করুণা হচ্ছে। এই হচ্ছেন আপনি, আর এই হল আপনার বাজেট। এমন বাজেট যারা লিখতে পারে, আর এমন বাজেটকে যারা সমর্থন করে, তারা সুস্থ মস্তিস্কের মানুষ নয়। মাননীয় স্পিকার স্যার, এই বিধানসভা তাদের জায়গা নয়। তাদের উপযুক্ত জায়গায় পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.