ফাঁদে পা না দিয়েই বাজিমাত

সারা দেশের চোখ তখন ঝাড়খণ্ডের দিকে। চ্যানেলে চ্যানেলে চলছে বিশ্লেষণ। চ্যানেলওয়ালাদের অপেক্ষা, কখন তিনি বেরিয়ে আসবেন। কখন সাংবাদিক সম্মেলন করবেন। অবশেষে মঞ্চে তাঁর আবির্ভাব। হেঁটে নয়। সাইকেলে। সামনের সিটে ছেলে অংশ। সাইকেল চালিয়েই এলেন গুরুজির কাছে। পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। সাইকেলে আসার দৃশ্যটা এতটাই ভাইরাল হয়ে গেছে যে, চালক কে, তা আর বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না।

রাজনীতির সঙ্গে পাঞ্জাবির একটা যোগ আছে। কেউ পরেন ধুতির সঙ্গে, কেউ কুর্তার সঙ্গে, আবার কেউবা জিনসের সঙ্গে। বিশেষ করে জয়ের দিন তো পাঞ্জাবি মাস্ট। কিন্তু হেমন্ত সোরেনের তেমন দেখনদারি নেই। পাঞ্জাবিতে তেমন রুচিও নেই। তিনি এলেন কোর্ট প্যান্ট পরেই। বার্তাটা পরিষ্কার, আমি এরকমই। মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছি বলেই পাঞ্জাবি পরতে হবে, এমন রুটিন আমার জন্য নয়। তিনিই কি দেশের কনিষ্ঠতম মুখ্যমন্ত্রী?‌ কেউ কেউ সবজান্তা গুগলে এই মর্মে খোঁজও শুরু করে দিয়েছেন। জানা গেল, কনিষ্ঠতম নন ঠিকই, তবে সবথেকে কমবয়সীদের তালিকায় অবশ্যই তাঁকে রাখা যায়। অবশ্য, মুখ্যমন্ত্রীত্বের স্বাদ তাঁর আগেই (‌৩৮ বছরে)‌ পাওয়া হয়ে গিয়েছে। ২০১৩–‌র জুলাই থেকে ২০১৪–‌র ডিসেম্বর— এই চোদ্দ মাসের রাজ্যপাট সামলানোর অভিজ্ঞতা আগেই হয়ে গেছে। সেদিক থেকে, চুয়াল্লিসে এসে এটা তাঁর দ্বিতীয় ইনিংস।

অথচ, রাজনীতিতে তাঁর আসার তেমন সম্ভাবনাই নাকি ছিল না। তাঁর নামের সঙ্গে অনেকেই জুড়ে দিয়েছেন ‘‌অ্যাক্সিডেন্টাল পলিটিশিয়ান’‌ শব্দ দুটো। জন্ম ১৯৭৫–‌এর আগস্টে। দেশজুড়ে তখন জরুরি অবস্থা। স্কুল পর্যায়ের পড়াশোনা পাটনায়। তারপর মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়তে গেলেন রাঁচির কাছে মেসরার বিড়লা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে। যদিও শেষমেশ পড়া মাঝপথেই থামিয়ে দিতে হয়। অনেকে বলেন, লেখাপড়া থেকে ফোকাসটা হারিয়ে গিয়েছিল।

দিশম গুরু শিবু সোরেন ততদিনে বেশ কয়েক দফা এম পি হয়ে গেছেন, কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়েছেন, এমনকী স্বল্প মেয়াদের মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছেন। তখনও তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে ধরা হত বড় ছেলে দুর্গা সোরেকেই। ২০০৯ এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় দুর্গার। একেবারেই ভেঙে পড়েন শিবু সোরেন। নেতৃত্বের ব্যাটন তখন থেকেই একটু একটু করে হেমন্তের হাতে আসা শুরু।

২০০৫ এই অবশ্য হেমন্তকে বিধানসভায় টিকিট দেওয়া হয়েছিল। অল্পের জন্য হেরে গিয়েছিলেন বাবারই একসময়ের সঙ্গী স্টিফেন মারান্ডির কাছে। ২০০৯ নাগাদ ঠাঁই হল রাজ্যসভায়, তাও কয়েকমাসের জন্য। কারণ, পরের চিত্রনাট্যে তিনি জোট সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী। ঠিক হয়েছিল, প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী হবেন অর্জুন মুন্ডা, পরে ছাড়া হবে হেমন্তকে। কিন্তু অর্জুন বেঁকে বসলেন। জানিয়ে দিলেন, তিনি পদত্যাগ করবেন না। তখন সমর্থন তুলে নিল জেএমএম। কংগ্রেস ও আরজেডির সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রীই হয়ে গেলেন হেমন্ত। যদিও পরের বছর (‌২০১৪)‌ সরকার পড়ে গেল। অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রিত্ব ১৪ মাসের বেশ স্থায়ী হল না।
ঝাড়খণ্ড এমন এক রাজ্য যেখানে ১৯ বছরে দশবার মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার বদল হয়েছে। খোদ শিবু সোরেনই তিনবার মুখ্যমন্ত্রী হলেও কোনওবারেই ছমাসের বেশি সরকার টেকেনি। একবার তো দশদিনের মাথাতেই সরে যেতে হয়েছিল। এমন নড়বড়ে কুর্সিতে কাজ চালানো বেশ চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু হেমন্ত সোরেন একটু অন্য ঘরানায় বেড়ে ওঠা। আদিবাসী হলেও প্রযুক্তির ব্যবহারে বেশ আধুনিক। শখের ফটোগ্রাফি তো আছেই। ডিজিটাল দুনিয়ায় বেশ সড়গড়। কোথায় কী হচ্ছে, দ্রুত আপডেট পৌঁছে যায় তাঁর কাছে। প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ব্যাপারেও বেশ পরিণত। দুম করে কিছু বলে বসেন না। কোন কথার কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, সে ব্যাপারে বেশ সচেতন। কাকে কতটুকু আক্রমণ করতে হয়, কোথায় লাগাম টানতে হয়, এই পরিমিতি বোধটা এর মধ্যেই বেশ আয়ত্ব করেছেন। কাকে ভবিষ্যতে দরকার লাগতে পারে, সেই বুঝে মাপা প্রতিক্রিয়া দিতে হয়, এই অঙ্ক ও সমীকরণটাও বোঝেন। মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাসের সামনে সূরজ রাইকে এগিয়ে দেওয়াটা একটা মাস্টারস্ট্রোক হিসেবেই দেখছে রাজনৈতিক মহল। আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও বাঙালি অধ্যুসিত এলাকা যে হিসেব বদলে দেবে, এই অঙ্কটা বুঝতে ভুল হয়নি।

প্রচারপর্বে দেখা গেছে, বুলেটে চড়েই চষে বেড়িয়েছেন প্রত্যন্ত গ্রামে। বিজেপি যখন দিল্লি থেকে হিন্দিভাষী নেতাদের এনে হুঙ্কার ছেড়েছে, তখন তিনি হিন্দির পাশাপাশি বেছে নিয়েছেন সাঁওতালি, ভোজপুরি, বাংলাকে। যেখানে যেটা প্রয়োজন। বার্তাটা পরিষ্কার, আমি তোমাদেরই লোক। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কটা বেশ গাঢ়। তাই শুধু বাংলা বলেই ক্ষান্ত থাকেননি, হারিয়ে যাওয়া লোকসংস্কৃতি টুসু–‌ভাদুকেও ফিরিয়ে এনেছেন তাঁর প্রচারে। মোদি–‌অমিত শাহরা যখন পাকিস্তান, কাশ্মীর, হিন্দু–‌মুসলমান, রামমন্দির, বালাকোট, এনআরসি তুলে হাওয়া গরম করছেন, তখন তিনি সেই ফাঁদে পা দেননি। আঁকড়ে ধরলেন ‘‌জল–‌ জঙ্গল–‌ জমিন’‌। বুঝিয়ে দিলেন, ঝাড়খণ্ডের লড়াইটা ঝাড়খণ্ডের ইস্যু দিয়েই লড়তে চান। পাশাপাশি জোটকে আরও মজবুত করলেন। আসন রফা নিয়েও তাই তেমন বেগ পেতে হয়নি। ফল যে হাতে নাতে পেয়েছেন, সে তো দেখাই যাচ্ছে।

সরকারে থাকার অভিজ্ঞতা তো ছিলই। টানা পাঁচবছর বিরোধী রাজনীতিও তাঁকে অনেক বেশি পরিণত করেছে। ভাড়াটিয়া আইন, আদিবাসীদের জমি হস্তান্তর আইন তাঁর আন্দোলনের চাপেই খারিজ হয়েছে। বিহারে নীতীশ কুমার যখন মদ নিষিদ্ধ করলেন, হেমন্তও দাবি তুলেছিলেন, ঝাড়খণ্ডেও মদ নিষিদ্ধ হোক। এখন নিজে কুর্সিতে। পারবেন নিজের দাবিকে কার্যকর করতে?‌ এমন অনেক চ্যালেঞ্জ আপাতত তাঁর সামনে। দায়িত্ব নেওয়ার আগেই বলে রেখেছেন, হোর্ডিংয়ে নয়, উন্নতির ছাপ মানুষের চোখেমুখে খুঁজে পাবেন। হেমন্তের হাত ধরে পিছিয়ে পড়া রাজ্যে ‘‌বসন্ত’‌ আসে কিনা, সেটাই দেখার।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.