‌ভূতের রাজার চতুর্থ বর

স্বরূপ গোস্বামী

চরিত্রের নাম কুট্টুস। না, সে মোটেই কোনও সারমেয় নয়। এই সময়ের জল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা এক কিশোর। নামটা দিদির দেওয়া। পোশাকি নাম সবার একটা থাকে, তারও আছে। স্কুলের খাতায় সেই পোশাকি নামটাই আছে। বন্ধুরা সেই পোশাকি নামটা ধরেই ডাকে। সৌম্যজিৎ থেকে কেউ কেউ শর্টে সৌম্য করে নিয়েছে। তবে কুট্টুসের নিজের কিন্তু দিদির দেওয়া ওই নামটাই বেশি প্রিয়। আমরাও বরং তাকে কুট্টুস বলেই সম্বোধন করব।
ফোনের ওপর তার খুব আসক্তি। লোকের স্মার্টফোন দেখলেই চেয়ে নিত। এটা সেটা গেম খেলত। কী কী অ্যাপ আছে, বোঝার চেষ্টা করত। কিন্তু বাড়ির লোক তাকে স্মার্ট ফোন কিনে দেয়নি। বাড়ির লোকের বক্তব্য, স্মার্টফোন নিলে ছেলে বখে যাবে। লেখাপড়া কিছু হবে না। সবসময় শুধু সোশাল সাইটেই মুখ গুঁজে থাকবে। কুট্টুসের খুব রাগ হয়, কিন্তু সে কিছু বলতে পারে না। দারুণ রেজাল্ট হলে তবু কিছুটা বলার মুখ থাকত। কিন্তু সেটাও হয় না। ফলে, বাড়ির লোক যা বলে, তাই শুনতে হয়। লোকের স্মার্টফোন ঘেঁটেই সান্ত্বনা পেতে হয়।
আঙুর ফল কখন টক হয়!‌ যখন সেটা পাওয়া যায় না। কুট্টুসেরও হয়েছে সেই দশা। সে লোকের ইয়াব্বড় স্মার্টফোন দেখলে ইদানীং রেগে যাচ্ছে। মনে মনে বলছে, আমার যখন নেই, তখন কারও থাকার দরকার নেই। সব স্মার্ট ফোন হ্যাং করে যাক। তোরা ফেসবুক করবি, মেয়েদের সঙ্গে গল্প করবি, আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব!‌ কভি নেহি।
এই কুট্টুসের স্বপ্নগুলো ভারি অদ্ভূত। আর দশজন যা দেখে, সে তা দেখে না। সে যা দেখে, আর দশজন তা দেখে না। মাঝে মাঝেই সে নাকি ম্যাগি খাওয়ার স্বপ্ন দেখত। তাও আবার সকালের দিকে। সেই সময় যদি দিদি ঘুম ভাঙাতে আসত, কুট্টুস ঘুমের ঘোরেই বলত, ‘‌প্লিজ, আর দশ মিনিট। ম্যাগিটা খেয়েনি। এই সময় জ্বালাবি না।’‌ দিনের পর দিন সে ম্যাগি খেয়েই থেকেছে। ভাত–‌রুটি এসব কিছুই দরকার হয়নি। আর চিকেন। চিকেন থাকলে তার সঙ্গে সবকিছুই খেয়ে নিতে পারে। আপেলের সঙ্গে বেদানার তফাত কী, কুট্টুস জানে না। লাওয়ের সঙ্গে কুমড়োর তফাত কী, তাও জানে না। জানার দরকারই হয়নি।
মনে হত, ভূতের রাজা যদি বর দিত, রোজ চিকেনের নানা আইটেম আর নানারকমের নুডলস চেয়ে নিত। কতবার ভূতের রাজাকে মনে মনে ডেকেছে, কিন্তু গুপি–‌বাঘাকে ছেড়ে সে ব্যাটা আসেইনি। ভেবেছে, সত্যজিৎ রায় সিনেমা বানিয়েছিল বলে আবার কেউ বোধ হয় সিনেমা বানাবে। যতই করো গুরু, গুপিও নেই, বাঘাও নেই, আর সত্যজিৎও নেই। সন্দীপ রায় যতই ফেলুদা করুক, সে এজন্মে আর গুপি–‌বাঘা করবে না। তোমার আর হিল্লে হল না। নিরেট বেকার হয়েই থাকতে হবে। আর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে যাবে, আমি রব নিষ্ফলের হতাশের দলে।
অবশেষে একদিন, স্বপ্নে সত্যি সত্যিই হাজির ভূতের রাজা। অনেক ভাঁট বকে গেল। সেও ‘‌মন কী বাত’‌ শুনিয়ে গেল। ওরে ব্যাটা, তোর কাছে এসব ভাষণ কে শুনতে চায়!‌ কাজের কথায় আয়। বর দিতে পারিস বলেই তো তোর এত কদর। পুজোর আগে ডিএ বা বোনাস দিতে হবে না। কী বর দিবি, চটপট বলে ফেল।

bhuter raja3

এতক্ষণে ভূত বাবাজীবন পথে এল। সে জানতে চাইল, কুট্টুস কী চায়। এক লহমায় কুট্টুস ভেবে নিল, গুপি–‌বাঘা কী কী চেয়েছিল?‌ ১)‌ যেথা খুশি যাইতে পারি। ২)‌ যা খুশি, খাইতে পারি। ৩)‌ মনের সুখে গাইতে পারি।
তিন নম্বরটায় কুট্টুসের কোনও আগ্রহ নেই। যাদের খেয়েদেয়ে কাজ নেই, তারা গান গায়। আর গাইলেই লোকে শুনবে কেন?‌ এখান–‌ওখান যাওয়াতেও তেমন আগ্রহ নেই। পাহাড়, সমুদ্র ঘোরা হয়ে গেছে। একা একা আর কোথায়ই বা যাবে!‌ বাবা–‌মা নিয়ে গেলেও মুশকিল। এটা করিস না, ওটা করিস না, এসব ফিরিস্তি চলবে। তাছাড়া, বরের প্যাকেজে বাবা–‌মা নাও থাকতে পারে। বন্ধু নিলেও মুশকিল। বাড়ির লোক ছাড়বে না, না বলে নিয়ে গেলে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেবে। কিডন্যাপিংয়ের কেস দিয়ে দেবে। এখন তো আবার টাওয়ার ধরে পুলিস ঠিক খুঁজে নিচ্ছে। যত্তসব উটকো ঝামেলা।
তার থেকে খাওয়ায় ফোকাস করলে ভাল হয়। সেখানেও একগুচ্ছ খাবার চেয়ে কী হবে?‌ আরও শর্টলিস্ট করা দরকার। আগে চিকেন নাকি ম্যাগি!‌ বেশ দ্বিধায় কুট্টুসবাবু।
ভূতের রাজা জানিয়ে দিল, যে কোনও একটি বর। গুপি–‌বাঘা যেগুলো চেয়েছিল, ওগুলো আর দেওয়া যাবে না। অন্য কিছু চাইতে হবে।
এ তো আচ্ছা কিপ্টে ভূত। এ ব্যাটাও নির্ঘাত ডি এ পায়নি। তাই মুখ কঞ্জুসিগিরি করছে। বেড়ানো আর গানটা নিজেই ছেঁটে ফেলেছিল। রেখেছিল শুধু খাওয়াটুকু, তাও মন্ডা–‌মিঠাই নয়, শুধু মোগলাই–‌চাইনিজ, তাতেও এত কিপ্টেমি!‌ মাঝে মাঝে হয়ত আরসালান থেকে বিরিয়ানি বা সিরাজ থেকে মটন চাঁপ চাইত। এতে ভূতের রাজা গরিব হয়ে যাবে!‌ শুধু খাওয়াটাই দেখল!‌ এর মধ্যে ছোট্ট একটা ছেলে কেমন সম্প্রীতির বার্তা দিতে চাইছে, সেটা বুঝল না!‌ এত বুঝলে কি আর ভূত হত!‌ বুঝলে তো বুদ্ধিজীবী হয়ে চ্যানেলে বসত।
কুট্টুস ভাবল, এই সুযোগে একটা অ্যান্ড্রয়েড ফোন চেয়ে নিলে কেমন হয়!‌ বাড়ির লোক দিতে চাইছে না। ভূতের রাজার সৌজন্যে যদি পাওয়া যায়!‌ সঙ্গে একটা জিও সিম বা আনলিমিটেড নেট প্যাক।
ভূতের রাজা অন্তর্যামী। সে মনের ইচ্ছে মুখে আসার আগেই বুঝে ফেলে। সে বলে উঠল, ওসব অ্যান্ড্রয়েড–‌ফ্যান্ড্রয়েড দেওয়া যাবে না। ওগুলো আজকাল সবার হাতে হাতে ঘুরছে। ওগুলো দিয়ে আজকাল কোনও স্টেটাস বোঝানো যায় না। ওগুলো নিয়ে বোকা লোকেরা ঘোরাফেরা করে ।
এ তো মহা ফ্যাসাদে পড়া গেল। এ ব্যাটা তো একের পর এক শর্ত দিয়ে যাছে। ১)‌ গুপি–‌বাঘাদের বর চাওয়া চলবে না। ২)‌ স্মার্টফোন চাওয়া চলবে না।
এবার তাহলে কী চাওয়া যায়?‌ ওদিকে, ভূতের রাজার হাতে সময় নেই। কখন ফুড়ুৎ করে ভ্যানিস হয়ে যাবে, তখন আর কিছুই পাওয়া যাবে না।
আরও এক মোক্ষম শর্ত দিয়ে বসল ভূতের রাজা। নিজের জন্য কিছুই চাওয়া যাবে না। সবাই তো নিজের জন্য চায়। তাই নিজের জন্য দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। তুমি এমন কিছু চাও, যা তোমার নিজের কাজে লাগবে না। অথচ, তুমি চাইলে অন্যদের বেকায়দায় ফেলে একটু আনন্দ পেতে পারো।
অবশেষে এসে গেল সেই মোক্ষম আইডিয়াটা। এতদিন যেটা সে মনে মনে পুষে রেখেছিল। ভূতের রাজার কাছে বলেই ফেলল, এমন একটা বর দাও, আমি যখন চাইব, আমার সামনে থাকা লোকটার স্মার্ট ফোনটা হ্যাং হয়ে যাবে। আবার আমি যখন চাইব, তখন চালুও হয়ে যাবে।
ভূতের রাজা বলল, সাবাস। এতদিনে কেউ একটা বরের মতো বর চাইল। তথাস্তু। বৎস, তুমি জানো না, তুমি সমাজের কী উপকার করতে চলেছ। এমনিতে তোমার কোটা ছিল একটা বরের। আমি খুশি হয়ে লিমিটটা একটু বাড়িয়ে দিচ্ছি। শুধু তোমার সামনে থাকা লোকটার নয়, যে তোমার সামনে নেই, তুমি মনে মনে তার মুখ ভেবে স্মার্টফোনের কথা ভাবলে তার ফোনটাও হ্যাং হয়ে যাবে। আজ সকাল থেকেই ভ্যালিডিটি শুরু হয়ে যাচ্ছে। তোমার কেরামতি শুরু করে দাও।
*******

bhuter raja2

সকালে একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙল। স্বপ্নের কথাটা ঠিক মনেও ছিল না। আজ সাতটা থেকে পার্থ স্যারের কাছে টিউশন। অঙ্ক পড়ায়। কিন্তু ওই এক রোগ। অঙ্ক দিয়ে নিজে চ্যাট করতে বসে যায়। শেখানোর দিকে মনই থাকে না। সেলফি তোলে, কাকে যে পাঠায়, কে জানে!‌
হঠাৎ কুট্টুসের মনে পড়ে গেল ভূতের রাজার দেওয়া বরটা। তাহলে, পার্থ স্যারের ওপরেই আগে প্রয়োগ করা যাক। একবার পার্থ স্যারের দিকে, একবার হাতে থাকা স্মার্টফোনটার দিকে তাকাল।
কিন্তু কাজ হল কী?‌
স্যারের অঙ্কে মন নেই। কুট্টুসেরও।
স্যারের মুখের জ্যামিতিটা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। সেলফি তুলছে, উঠছে না। নেট কাজ করছে না। ছটপটানি বাড়ছে। এদিকে, মনে মনে কুট্টুস তখন ধন্যবাদ দিয়ে চলেছে ভূতের রাজাকে।
বাকিরা ঠিক বুঝতে পারছে না। দু একজনকে বলাই যায়। থাক, এখন পাঁচকান করে লাভ নেই। সব ঘেঁটে যাবে।
পার্থ স্যারের মেজাজ বিগড়ে গেছে। সেই রাগটা ছাত্রদের ওপর ঝাড়ছে। বলছে, এই সহজ অঙ্কটা করতে পারছিস না?‌ তোদের তাহলে কী শেখালাম?‌ এবার কুট্টুসের খাতা দেখার পালা। সেও অঙ্কটা ঠিকঠাক করতে পারেনি। নির্ঘাত বকুনি। হঠাৎ মনে হল, এখন যদি কিছুক্ষণের জন্য নেট ফিরিয়ে দিই, কেমন হয়!‌ মনে মনে নেট ফেরিয়ে দিল। স্যারের মোবাইল জানান দিল, মেসেজ ঢুকছে। স্যার যেন হাতে চাঁদ পেল। মন চলে গেল ফোনের দিকে। তার ছবিতে কে লাইক দিয়েছে, দেখতে চাইল। হোয়াটস অ্যাপ খুলল। কে কে গুডমর্নিং বলেছে। মেজাজটা আবার ফুরফুরে। তাই কুট্টুসকে বকা খেতে হল না।
টিউশনি থেকে বেরোনোর সময় মনে হল, আবার নেট উড়িয়ে দেওয়া যাক। তাই হল। বাকি দিনটা পার্থ স্যারের কেমন গেল, কে জানে‌!‌
****
বাড়ি ফেরে স্নান টান সেরে স্কুলে গেল। আজ একটু আগেই পৌঁছে গেল। নইলে কেরামতি বুঝবে কী করে?‌ অর্ণব রোজ স্মার্ট ফোন আনে। এই বয়সেই অনেক বান্ধবী জুটিয়ে ফেলেছে। দামী ফোন, মেয়েরা তো আগ্রহ দেখাবেই। দাঁড়া, ব্যাটা। আজ তোর হচ্ছে।
অর্ণব যথারীতি ফোন ঘাঁটতে শুরু করেছে। ক্লাস চলাকালীন সে মিউট করে ভিডিও দেখে। তাই পেছনের দিকে বসে। দাঁড়া, আজ তোর ভিডিও দেখা বের করছি। কুট্টুসের কেরামতি শুরু। অর্ণবের ফোন কাজ করছে না। বারবার খুলছে। কোনও সিগনাল পাচ্ছে না। অগত্যা, থার্ড পিরিয়ডের পর বাড়ি চলে গেল। নিশ্চয় বাড়ি যাওয়ার আগে মোবাইলের দোকানে যাবে। যেখানেই যাও বাপু, কোনও দোকানদার ঠিক করতে পারবে না। বেশি পাকামি করলে ওর দোকানের ফোনগুলোকেও ভ্যানিস করে দেব।
টিফিনের সময় একবার টিচার্স কমনরুমের দিকে গেল কুট্টুস। মাস্টারদেরও এই এক বদগুণ। সারাক্ষণ শুধু ফেসবুক আর ফেসবুক। দাঁড়ান স্যারেরা, এবার আপনাদের টাইট দেব। পড়ানোর বদলে ফেসবুক। বের করছি। কমনরুমে থাকা সবার মুখের একবার তাকিয়ে নিল। তারপরেই চলে এল। দশ মিনিট পর মনে হল, সরেজমিনে একবার দেখে আসা দরকার।
যা ভেবেছিল, ঠিক তাই। সবার চোখে মুখেই হতাশা। এ ওকে ফোন দেখাচ্ছে, ও বলছে, আমারটা দেখ। যে যাকেই দেখাও বাপু, আজ আর কারও ফোনই চলবে না। মনে মনে ভূতের রাজাকে বলল, বাড়ি ফেরার আগে যেন কারও ফোন না চালু হয়।
******
ফেরার পথে দেখা হল পল্টুদার সঙ্গে। একটাই কাজ। সারাদিন নানা কায়দায় ছবি তোলা। আর পোস্ট করা। কটা লাইক পড়ল, মিনিটে মিনিটে দেখা। ভারী আমার উত্তম কুমার। এসব না করে নিজের কাজে মন দে। দাঁড়া, তোর মজাও দেখাচ্ছি। কুট্টুসের নিদান। সপ্তাহে একদিন এর ফোন কাজ করবে। সেদিন যা পারিস, করে নে। বাকি ছদিন ফোন কাজ করবে না।
পাড়ার মিষ্টির দোকান। ছোকরার ব্যবসায় মন নেই। সারাক্ষণ খুটখাট। কানে ফোন নিয়ে কার সঙ্গে যে এত কথা বলে!‌ ওসব না করে যদি পড়ায় মন দিতিস, তাহলে আজ মিষ্টির দোকান চালাতে হত না। কলেজে পড়াতিস বা আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতিস। এ ব্যাটাকেও একটু টাইট দিতে হবে। কুট্টুস দোকানে গিয়ে একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস কিনল। তারপরই মনে মনে বলল, এর ফোনে পুরুষদের ফোন আসুক, খদ্দেরের ফোন আসুক, কিন্তু কোনও আউটগোয়িং যেন না হয়। বিশেষ করে কোনও মহিলাকে যেন ফোন না করতে পারে। তিনদিন পর কুট্টুস ফের গিয়ে দেখল, ছেলেটা ফোনের চক্কর ছেড়ে দোকানে মন দিয়েছে।
এদিকে, পরেরদিন পার্থ স্যার ফোন চেঞ্জ করেছে। কিন্তু বিশেষ লাভ হয়নি। যথারীতি নতুন ফোনটিও কুট্টুসের ‘‌কৃপাদৃষ্টি’‌ থেকে বঞ্চিত হয়নি। অর্ণব বা পল্টুদা ফোনের দোকানে নিয়ে গিয়েছিল। তারাও বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। তাদের ফোনগুলোও সেভাবেই চলেছে, যেভাবে কুট্টুস চেয়েছে।
স্কুলের স্যারদের অনেকে ফোন আনাই বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ কেউ সেই প্রাচীন ফোনে ফিরে এসেছে। হেড স্যার খুব খুশি। এতদিন কেউ তাঁকে পাত্তা দিতেন না। টিচাররা সময়মতো ক্লাসে যেতেন না। কমনরুমে সবসময় ফোন ঘাঁটতেন। হেড স্যারের সঙ্গে সামান্য মনোমালিন্য হলে ফেসবুকে দিয়ে দিতেন বা ডিআই অফিসে মেল করে দিতেন। তাঁকেও টেনশনে থাকতে হত। এখন তিনিও নিশ্চিন্ত। স্কুলের পরিবেশ আবার ফিরে আসছে।
*****
কিন্তু ভূতের রাজা তো একটা বাড়তি বরও দিয়েছিল। মনে পড়ে গেল কুট্টুসের। সে মনে মনে যার কথা ভাববে, তাদের ফোনও তো চাইলে হ্যাং করে দিতে পারে। বা নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। তার মানে, সে যখন স্কুলে, তখন তো সরকারি অফিসের কোনও কর্মী ফেবুতে মগ্ন। রাতের বেলায় অনেকেই না তো না পড়াশোনা করে, না ঘুমিয়ে এসব করে চলেছে। সেগুলোকে কীভাবে আটকানো যায়!‌
আবার সবাইকে কড়া শাস্তি দেওয়াও ঠিক নয়। অনেকের সত্যিই জরুরি ফোন আসে। তাহলে কীভাবে বুঝবে কারটা জরুরি, কারটা নয়। মনে হল, একটু গ্রেস দেওয়া দরকার। নিজেই সংবিধান তৈরি করে নিল। তার পরিচিত লোকেরা ফোন করতে পারবেন। কিন্তু পাঁচ মিনিট পর লাইনটা কেটে যাবে। এক নম্বরে সর্বোচ্চ দুবার করা যাবে। রাত দশটার পর কারও ফেসবুক খুলবে না। যদি পড়াশোনার কাজে নেট ব্যবহার করতে চায়, খোলা যাবে। কিন্তু নো ফেসবুক, নো হোয়াটস অ্যাপ, নো সেলফি। যে বাইক চালাতে চালাতে ফোন ধরবে, আগামী পনেরো দিন সে আর ফোনে কথা বলতে পারবে না। কোনও ডাক্তার যগি রোগী দেখতে দেখতে নেটে চোখ রাখে, আগামী পনেরো দিন তারও নেট খুলবে না। কোনও সরকারি বা বেসরকারি অফিসে কেউ যখন কাজ করছে, তার সোশাল সাইট খুলবে না। এসব নিয়ম চালু করল আর মনে মনে ভাবতে লাগল, এবার কাদের ঠান্ডা করা যায়।
এভাবেই কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন। এক রাতে হঠাৎ হাজির ভূতের রাজা। সে হাজির আরসালানের বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে। বলল, তুমি গুপি–‌বাঘার থেকে ঢের ভাল। ওরা শুধু নিজেরা পেট পুরে খেয়েছে, আর ঘুরে বেড়িয়েছে। সুন্দরী রাজকন্যেদের বিয়ে করেছে। কিন্তু মাত্র কদিনে তুমি সমাজটাকেই বদলে দিয়েছো। সব অফিসে কর্ম সংস্কৃতি বেড়ে গেছে। শিক্ষকরা স্কুলে যাচ্ছে, মন দিয়ে পড়াচ্ছে, ডিএ নিয়ে ফেসবুকে হতাশা দেখাচ্ছে না। সরকারি অফিসে কাজ হচ্ছে। ছেলেরাও মন দিয়ে পড়ছে। তাই তোমার জন্য এই বিরিয়ানির প্যাকেট এনেছি।
মাঝরাতেই সেই বিরিয়ানি শেষ করে ফেলল কুট্টুস।
তারপর ভূতের রাজা পকেট থেকে বের করল একটা অ্যান্ড্রয়েড ফোন। বলল, এটা তোমার উপহার। সঙ্গে একটা আনলিমিটেজ নেট প্যাক।
কুট্টুস বলল, কিন্তু তুমি যে বলেছিলে, নিজের জন্য কিছু চাওয়া যাবে না।
ভূত বলল, তুমি তো চাওনি। আমি খুশি হয়ে তোমাকে দিচ্ছি। ফোন কোম্পানি দুটো অ্যান্ড্রয়েড দিয়েছে। একটা আমার, একটা তোমার।
ও, তার মানে এ ব্যাটাও কাটমানি খেয়ে বসে আছে!‌ কুট্টুস ফিরিয়ে দিল সেই ফোন। বলল, আমার ফোন দরকার নেই। লোকের ফোন হ্যাং করেই আমি দিব্যি আনন্দ পাচ্ছি। দাঁড়াও, এবার তোমার ফোনটা হ্যাং করছি। তোমার দালালি করা বের করছি।
ভূতের রাজার ফোন হ্যাং।
রবি ঠাকুরের সুরে কিশোর কুট্টুস গেয়ে উঠল, আমার এই হ্যাং করাতেই আনন্দ।।
‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.