২৯ জুলাই, শিবদাস ভাদুড়ীর চোখে

(শিল্ড জয়ের রাত। চারিদিকে উৎসব। উড়ছে মোহনবাগানের পতাকা।মোহনবাগানের জয় আর স্বাধীনতা যেন মিলেমিশে একাকার। সেই রাতে ডায়েরিতে কী লিখেছিলেন শিবদাস ভাদুড়ি। না লেখা সেই ডায়েরির পাতা বেঙ্গল টাইমসে উঠে এল। লিখেছেন ময়ূখ নস্কর।)

কাল খেলার পর যখন বাড়ি ফিরছি, এক ইংরেজ সাংবাদিক সামনে এল। ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, টুমি তো বাঙ্গাল। টোমার অ্যানসেসটরদের বাড়ি ইস্টবেঙ্গলে। টাহা হইলে টুমি মোহনবাগানের হইয়া খেলিটেছ কেন? তখন চারদিকে খুব ভিড়, তাই ইংরেজটাকে ভালো করে দুকথা শুনিয়ে দিতে পারিনি। সময় পেলে ওকে একটা ঘটনার কথা শোনাতাম। ঘটনাটা কালই ঘটল, খেলা শেষ হওয়ার পরে। মাঠ থেকে বেরিয়ে আমরা তখন লাটসাহেবের প্রাসাদের সামনে এসেছি। আমাদের ঘিরে হাজার মানুষের ভিড়।

এক পূজারী ব্রাহ্মণ ভিড় ঠেলে আমার সামনে এগিয়ে এলেন। আমার কপালে তিলক পরিয়ে দিয়ে বললেন, “বাবা শিল্ড তো জিতলে, ওটাকে কবে নামাবে?” তাকিয়ে দেখি তাঁর আঙুল বড়লাটের প্রাসাদের মাথায় তোলা ইউনিয়ন জ্যাকের দিকে লক্ষ্য করা। আমি কোনও জবাব দেবার আগেই ভিড়ের ভেতর থেকে জবাব এল, “এরপর যখন শিল্ড জিতব, তখন ইংরেজদের ওই পতাকাটাকেও নামাব।”

ifa shield2

সঙ্গে সঙ্গে সহস্র কণ্ঠে বন্দেমাতরম বন্দেমাতরম আওয়াজ উঠল। আওয়াজ তো নয়, যেন রণহুংকার। যেন একটা যুদ্ধ জয়ের পর আরেকটা যুদ্ধের প্রস্তুতি। সবার মুখে আগুন। সবার হাত মুষ্টিবদ্ধ। এই উল্লাসের মধ্যে সেই লোকটাকে দেখতে পেলাম না যে বলল, পরের বার ব্রিটিশদের পতাকা নামাব। কে ওই লোকটা? কী করে জানল
আমার মনের কথা? কী করে জানল মোহনবাগানই পারবে ইউনিয়ন জ্যাককে টেনে নামাতে?

ওই লোকগুলোই বা কারা? যাদের গলায় “বন্দেমাতরম” আর “মোহনবাগান” মিলেমিশে এক অপূর্ব রণহুংকার সৃষ্টি করছে? ওরা কি খেলা দেখতে এসেছিল না ইংরেজদের সঙ্গে ১১ জন নেটিভের যুদ্ধ দেখতে এসেছিল? হ্যাঁ যুদ্ধ। বল নিয়ে মাঠে নামার পর যখনই সামনে গোরাদের দেখি তখনই মনে হয় এটা খেলা নয়, যুদ্ধ। শুনুন ইংরেজ সাংবাদিক, তখন কে পূর্ববাংলার লোক, কে পশ্চিমবাংলার তা আর মাথায় থাকে না। সেনাবাহিনিতে যেমন সহযোদ্ধার জাতধর্ম নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, মোহনবাগানেও তাই।

mohun bagan

তোমরা ইংরেজরা বাংলাকে পূর্বপশ্চিমে ভাগ করার চেষ্টা করছ, ধর্ম দিয়ে ভাগ করার চেষ্টা করছ। কিন্তু অত সহজ নয়। আমাদের দলে, আমি ব্রাহ্মণ, আবার রেভারেন্ড সুধীর চ্যাটার্জি খ্রিস্টান। আমি, অভিলাষ, আমার দাদা পূর্ববঙ্গের লোক, আবার ভুতি সুকুল বাঙালিই নয়। তাও আমরা একসঙ্গে মোহনবাগানের হয়ে খেলি। আগামিদিনেও খেলব। শুনছি গোষ্ঠ পাল বলে একটি বাঙ্গাল ছেলে খুব ভালো খেলছে। আগামী বছর অকেও দলে নেব। এই মোহনবাগানকে দেখেই দেশের লোক একতার শিক্ষা নেবে। আজ নেবে, ১০০ বছর পরেও নেবে। জাত, ধর্ম, পূর্ব-পশ্চিমের ভেদাভেদ অন্য ক্লাবে থাকতে পারে মোহনবাগানে নেই।

শোন ইংরেজ, তোমরা গায়ের জোরে বাংলাকে ভাগ করতে পারবে, কিন্তু বাঙালিকে ভাগ করতে পারবে না। যারা সাচ্চা বাঙালি তারা, পূর্বপশ্চিম যেখানকারই হোক, চিরকাল মোহনবাগানকেই সমর্থন করবে। পূর্ববঙ্গের মানুষ জানে, মোহনবাগান সারা বাঙলার প্রতিনিধি। অবিভক্ত বাঙলার প্রতিনিধি। তাই পূর্ববঙ্গ থেকে শয়ে শয়ে মানুষ মোহনবাগানের খেলা দেখতে আসে, আগামিদিনেও আসবে। তাদের সমর্থন নিয়েই আমরা জিতব।

জানি তোমরা সহজে জিততে দেবে না। কিন্তু ইতিহাস মিলিয়ে দেখে নিও, এরপর যে বছর শিল্ড জিতব, সেবছরই তোমাদের ভারত থেকে বিদায় নিতে হবে।

(মোহনবাগানের শিল্ড জয় নিয়ে বেঙ্গল টাইমসের এই সিরিজ চলবে। আরও নানা আঙ্গিক থেকে সেই ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা। আগামীকালের বিষয় ? বলেই ফেলা যাক। লর্ড কার্জনের গোপন ডায়েরি। শিল্ড জয়ের পর ঠিক কী লিখেছিলেন গভর্নর জেনারেল ? লিখেছেন ময়ূখ নস্কর। )

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.