‘বঙ্গবিভূষণ’ কবীর সুমনকে খোলা চিঠি

রবি কর

“তোমার প্রতি চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই”- রবীন্দ্রনাথের সম্বর্ধনায় এমনই মানপত্র পাঠ করেছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র। মানপত্র রচনা করেছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র অথবা জগদীশচন্দ্রকে আমরা দেখিনি। দেখলে কতটা বিস্মিত হতাম তা বলতে পারব না। কিন্তু আমরা তোমাকে দেখেছিলাম। সেই যে মান্না দে’র নাগরিক সম্বর্ধনায়  তুমি জিন্স পরে, হাঁটু মুড়ে বসে চিৎকার করে গেয়েছিলে, “তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী। ” শুনে আমাদের সত্তামূলে কালবোশেখি বয়ে গেছিল। রবীন্দ্রনাথের গান এভাবেও গাওয়া যায়? ধুতি-পাঞ্জাবি-তবলা-হারমোনিয়াম-রজনীগন্ধা- নাকি নাকি সুর- ন্যাকা ন্যাকা ভাব, সবকিছুকে চুলোয় পাঠিয়ে এমন জয়ধ্বনির মতো করে? আমাদের বিস্ময়ের সীমা ছিল না।

kabir  suman 2

আমাদের বিস্ময়ের সীমা ছিল না, যখন দেখেছিলাম পিট সিগারের গিটারে কণ্ঠ মেলাচ্ছ তুমি। সেটা বোধহয় ১৯৯৬ সাল। কোন গানটা গেয়েছিলে বল তো? If I had a hammer? Which side are you on? নাকি ‘ঈশ্বর আল্লা তেরো নাম’? মনে নেই। জীবন গিয়াছে চলি কুড়ি কুড়ি বছরের পার। কিন্তু সেই দিনটার কথা মনে আছে, যেদিন প্রথম শুনেছিলাম, “তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা”। শুনে কোনও প্রিয়তমাকে নয়,  শুধু তোমাকেই তোমাকেই স্যালুট করেছিলাম সুমনদা।

তুমি বলছি বলে কিছু মনে করো না যেন। আপনি বললে কেমন পর পর মনে হয়। দাদা বলাটা অবশ্য অভ্যাসের দোষ। জানই তো, সাংবাদিকরা সবাইকে দাদা-দিদি বলে। সাংবাদিকদের হরেক ভড়ং। যেমন তারা নিজের রাজনৈতিক মত কাউকে জানায় না। কিন্তু তোমাকে মিথ্যে বলব না, যেদিন শুনলাম তুমি যাদবপুরে ভোটে দাঁড়াবে ভীষণ রাগ হয়েছিল। যাদবপুরে কেন? আমার কেন্দ্রে  দাঁড়াতে পারতে। তাহলে আমি সুযোগ পেতাম তোমাকে ভোট দেওয়ার। আমিও প্রতীক্ষা করতাম, কবে আমার কেন্দ্রের এম.পি. সংসদ ভবনে গাইবে ”আমি চাই মন্ত্রীরা প্রেম করুন সকলে নিয়ম করে, আমি চাই বক্তৃতা নয় কবিতা পড়ুন কণ্ঠ ভরে। ”

suman mamata cartoon

সংসদে গান গাওয়ার সুযোগ অবশ্য তুমি কোনও দিনই পাওনি। আরে সংসদে কজন আছে তোমার গানের মর্ম বোঝার মত ? সেই যে একটা গানে লাল নিশানের সঙ্গে প্রেমিকার রাঙা ঠোঁটের তুলনা করেছিলে, সত্যি বলছি, সুকান্তর “পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”র থেকে কোনও অংশে কম ছিল না। সেই যে লিখেছিলে, ”জানি না শ্রীরাধিকার প্রিয় ছিল কিনা রাধাচূড়া, জানি না শ্যামের বাঁশি সাঁওতালি সুরে বাজে কি না।” শুনলে বিদ্যাপতি তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন।

বয়স হয়েছে সুমনদা। মাঝে মাঝে একলা লাগে। চোখে চালশে, রাত বিরেতে কাশি, মুখের রেখায় আজব ত্রিকোণমিতি। হয়তো, অত পুরনো গানগুলো তোমার আর ভালভাবে মনে পড়ে না। হয়তো। কিন্তু ছত্রধরের গান, ছিতামণির চোখ, লালমোহনের লাশ এগুলো তো বেশি পুরনো নয়। এই তো সেদিন জাগরী বাস্কের আত্মসমর্পণের পর লিখলে, “জাগরী এলেন, ভরসা পেলেন, আত্মসমর্পণের দাম সরকার দেবে…।” তুমিও আত্মসমর্পণ করলে সুমনদা ? জাগরীর মতো ? ছত্রধর হতে পারলে না তুমি?

আত্মসমর্পণের কী দাম পেলে? সরকারি সম্মান? তাতে তোমার সম্মান বাড়ল? সুকান্ত, বিদ্যাপতির পাশে ছিলে, এসে বসলে শ্রীকান্ত মোহতার পাশে? জানো তো রোমান সম্রাট ক্যালিগুলা তার প্রিয় ঘোড়াকে আইনসভার সদস্য করে দিয়েছিল। সম্রাটকে পিঠে নিয়ে ঘুরত তাই দিয়েছিল। তুমি শেষে ঘোড়ার দলে নাম লেখালে?

তুমি কি ভাব, ওরা আসলে তোমাকে সম্মান দিচ্ছে? ওরা লালন বোঝে? রামপ্রসাদ বোঝে? তোমাকে বোঝে ? ওরা, যারা এক সঙ্গে ঝালমুড়ি খায়, তারা অর্চনাদের পাশে আয়েশাদের থাকতে দেবে ? সালমা খাতুনকে হিন্দু নেতার পুত্রবধূ হতে দেবে? ওরা কার দলে আছে? লালনের না তালিবানের?

জানি সুমনদা, জানলার কাঁচে বাতাস ধাক্কা দেয়। দেখতে দেখতে সবই পালটে যায়। তা বলে…? পাল্টাও তুমি, তোমায় দেখতে আসি।  ওরা তোমাকে কিনে নিল সুমনদা ?  তোমার কণ্ঠ কিনে নিল? সেই যে বলেছিলে, “আমাকে না,  আমার আপস কিনছ তুমি।” আপস করেছ বলেই কি পুরস্কারটা পাচ্ছ  ?  সম্রাট ক্যালিগুলা ঘোড়া ভালবাসত, ওরা আপস ভালবাসে। তুমিই বল। সংসদে একটা দিনও বলার  সুযোগ না দিয়ে, বাহামনি, সোহম, দেব, ইন্দ্রনীলদের নিয়ে নাচানাচি করার পর হঠাৎ ‘মহাসঙ্গীত সম্মান’, ’বঙ্গবিভূষণ’- সম্মানগুলো আসলে কে পাচ্ছে ? কবির সুমন না কবির সুমনের আপস ?

প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা।

 

Share

1 comment

মানুষটাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, এক সাথে কাজ করেছি একাধিক।
সব কিছুর বাইরে গিয়ে, একটা শ্রদ্ধা মিশ্রিত সম্ভ্রম জন্মেছিল আমার এই মানুষটার প্রতি।

আজও আমার আছে কিনা, বুঝতে পারি না নিজেই।

জানি সুমনদা, সময়ের সাথে সব কিছু বদলায়। কিন্তু বদলগুলো সত্যের স্বপক্ষে হওয়াটা খুবই জরুরী। কিন্তু আপনার এই বদলটা কি খুব জরুরী ছিল !!! কিসের প্রয়োজনে !!!!! আজও আপনার নামে এই বাংলার যে কোন অডিটোরিয়াম ‘হাউস ফুল’ হয়ে যায়, সুতরাং নিছক অর্থ এই অনর্থের কারণ হতেই পারে না। তবে কি সেই কারণ !!!!!!

‘যৌথ খামার’-এর স্বপ্ন দেখিয়ে ‘কণ্ঠ না ছেড়ে’ নিজেই ‘হাল’টা ছেড়ে দিলেন !!!! রবীন্দ্র নাথের পর আপনার মত এমন শক্তিশালী গীতিকার বাংলায় আর আসেনি। নিজেকে শুনুন, ফিল করুন, বিশ্বাস করুন !!!!!

‘এই কুলে আমি, আর ওই কুলে তুমি’ নিয়ে বাঙালী বেশ ছিল, আপনি এসে গানকে একটা অন্য মানে দিলেন। আপনি দায় এড়াতে পারেন না।

সু-মন নিয়ে, সুমন হয়েই থাকুন !!!!! ভালো থাকুন, ‘রাত বিরেতে’ সুস্থ থাকুন !!!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.