ভোজনরসিক রবি ঠাকুর

মৌতান ঘোষাল

 

আজ “চির নূতনেরো দিলো ডাক” আজ “পচিশে বৈশাখ”। আর এই দিনটা বাঙালি’র কাছে তার সবথেকে বড় অহঙ্কার, তার সংস্কৃতির সবথেকে বড় বিজ্ঞাপন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্মরণ করার দিন। কবিগুরুর জন্মদিনে তাঁর সৃষ্টি, তাঁর ভাবনার মধ্যে দিয়ে নিজেদের অনুভূতিকে ভরিয়ে রাখতে চাই আমরা। গত একশ বছরে রবি ঠাকুরকে নিয়ে এত গবেষণা হয়েছে, এত লেখা হয়েছে,তাঁর জীবনের প্রতিটা বিষয় নিয়ে এত আলোচনা হয়েছে যে স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথও আমাদের বড় চেনা। তাঁর গান, কবিতা, নাটক, উপন্যাসের গন্ডি পেরিয়ে মানুষ রবি ঠাকুর আমাদের অনেক কাছে চলে এসেছেন দিনে দিনে।

 

তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের জটিল সম্পর্ক হোক বা তাঁর সরল কৌতূক বোধ, কিংবা তার মিষ্টান্নপ্রীতি! সবটা নিয়ে আমাদের কথা বলা চাই।

গুরুদেব বড় ভোজনরসিক ছিলেন, তাঁর ঘনিষ্টরা তা জানতেনও খুব ভালোভাবে। এই খাদ্যরসিক রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে দু-একটা কথা বরং মনে করা যাক আজ।

 

আমসত্ত দুধে ফেলি তাহাতে কদলি দলি

সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে,

হাপুস হুপুস শব্দ।চারিদিক নিস্তব্ধ।

পিপিড়া কাদিয়া যায় পাতে।

 

কতবড় ভোজনরসিক হলে তবে এমন লেখা যায়!আসলে আপামোর বাঙালির মতো গুরুদেবেরও মিষ্টির প্রতি টান ছিল দেখার মতো। সে ‘জলোযোগ’এর পয়োধি (এক ধরনের লাল দই) হোক বা ‘দ্বারিক’এর সন্দেশ, বারবার বিভিন্ন আলাপচারিতায় এসব মিষ্টির প্রশংসা শোনা গেছে গুরুদেবের মুখে।

সালটা ১৯১১। তারঁ জন্মদিনে এক বিষেশ মিষ্টি বানিয়ে তাকে উপহার দিয়েছিলেন তাঁর নিজের ভাইঝি। মিষ্টির নাম দিয়েছিলেন “কবি সম্বর্ধনা বরফি”। মিষ্টির উপকরণও ছিল বেশ অভিনব। হবে নাই বা কেন? কবিগুরুর জন্মদিন বলে কথা। মিষ্টিতে কাজু, কিসমিস, ঘি, চিনি, জাফরানের পাশাপাশি মূল উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল ‘ফুলকপি’। প্রথম সাক্ষাতেই এই বরফি স্থান পেয়ে যায় গুরুদেবের বিশেষ পছন্দের তালিকায়। পরেও এই বরফি বহুবার গুরুদেবকে বানিয়ে খয়াতে হয়েছে তাঁর প্রিয় ভাইঝিকে।

বলাইচাদ মুখোপাধ্যায় অর্থাৎ ”বনফুল’এর স্ত্রী যখন তাকে নিজে হাতে মিষ্টি তৈরি করে খাইয়েছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে মজার ছলে বলেন, “ বাংলায় প্রথম রসস্রষ্টা দ্বারিক, আর দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ, তুমি কি তবে তৃতীয় জন নাকি!”

rabi thakur

গুরুদেব শুধু খেতে ভালবাসতেন না, খাওয়াতেও ভালবাসতেন। তার সাক্ষী সেই সময় শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থীরা। তিনি প্রায়ই কোনও উপলক্ষ্য বার করে ছাত্রদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। ছোটদের খাওয়ায়া দেখে তৃপ্তি পেতেন গুরুদেব। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের খাওয়ার সময় যদি কোনও ছাত্র সেখানে উপস্থিত হত তবে একইরকমভাবে পাত সাজিয়ে খেতে দেওয়া হত তাকে। ছাত্ররা জানত এই রীতি, তাই প্রায় রোজই সেই সময়টায় হাজির থাকতো কেউ না কেউ। খুদে ছাত্ররা সেই খাবার গুছিয়ে খেতে না পারলেও পরিবেশনে কোন ত্রুটি থাকত না।

গুরুদেবের এও একটা রূপ। যেখানে বিশ্বকবি শুধুই আদ্যোপান্ত এক ভোজনরসিক বাঙালি।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.