সবুজ সরখেল
বয়স হলে মানুষের শরীরের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিও দুর্বল হতে শুরু করে। আমাদের আশপাশের অনেক বৃদ্ধকেই দেখা যায়, রামকে শ্যাম বলে ডাকছেন, বাগবাজার যেতে গিয়ে বাগমারি চলে যাচ্ছেন, সন্ধ্যে বেলায় কাঁধে গামছা ফেলে চান করতে যাচ্ছেন। আমরা অবাক হই না, ভাবি বুড়ো বয়সে এমন হয়।
খেলোয়াড়রা সারাজীবন শরীরচর্চা করেন বলে, বৃদ্ধ বয়সে তাঁদের স্বাস্থ্য অন্য বৃদ্ধদের থেকে মজবুত থাকে। কিন্তু স্মৃতিশক্তির দিক থেকে তাঁদের সঙ্গে অন্যদের বিশেষ তফাত থেকে না। স্মৃতি বিদ্রোহ করে, কথার যুক্তি থাকে না।
চুনী গোস্বামী খেলোয়াড় হিসাবে এবং মানুষ হিসাবে আমাদের মাথার মুকুট শুধু নন, মুকুটের অমূল্য রত্ন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বয়সের প্রভাব তার উপরেও পড়ছে। শারীরিক দিক থেকে তিনি এখনও মজবুত, তিনি দীর্ঘজীবী হোন, কিন্তু ইস্টবেঙ্গল দিবসে গিয়ে তিনি এমন একখান কথা বললেন যে……
এর আগে তিনি একটি পত্রিকায় বলেছিলেন, ১৯১১ সালে ঐতিহাসিক শিল্ড জেতার পর মোহনবাগানের পরবর্তী সাফল্য ১৯৩৯ সালে। মাঝের ২৮ বছর ক্লাব ট্রফিহীন ছিল। এই নিয়ে ফেসবুকে প্রচুর ‘খিল্লি’ শুরু হয়েছিল, কিন্তু নথি ঘেঁটে দেখা যায়, এই ২৮ বছরে মোহনবাগান ১০-১২ টা ট্রফি জিতেছিল, দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশ ক্লাবগুলোর সঙ্গে টক্কর দিয়ে।
এবার চুনীবাবু বলেছেন, ক্লাব হিসাবে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের থেকে এগিয়ে। আচ্ছা ঠিক কোন মাপ কাঠিতে ইস্টবেঙ্গল এগিয়ে কেউ একটু বলে দেবেন।
মুখোমুখি খেলার হিসাবে ইস্টবেঙ্গল অবশ্যই মোহনবাগানকে বেশিবার হারিয়েছে। কিন্তু ট্রফিরুমের হিসাবে, একমাত্র কলকাতা লিগ (যাকে ইস্টবেঙ্গলের সচিব নিজেই ঘুগনি আলুরদম লিগ বলেন) এবং আই এফ এ শিল্ড ছাড়া সবেতেই মোহনবাগান এগিয়ে। জাতীয় লিগ (ডেম্প ৫, মোহনবাগান ৪ ) ছাড়া সব প্রতিযোগিতায় ভারতের মধ্যে প্রথম।
যদি ইতিহাসের কথা ধরেন, ইরানের পাস ক্লাবকে হারানো, ইরাকের আল-জাওরাকে হারানো এবং অবশ্যই আসিয়ান ক্লাব জয় (এটা অবশ্যই বিশাল কীর্তি) ছাড়া ইস্টবেঙ্গল কোন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে? অপর দিকে মোহনবাগানের ঝুলিতে শিল্ড জয় ছাড়াও, প্রথম অসামরিক ভারতীয় দল হিসাবে ডুরাণ্ডে খেলার ডাক পাওয়া, পেলের কসমস এবং আরারাত ক্লাবকে রুখে দেওয়ার মতো কৃতিত্ব আছে। বিখ্যাত ইংরেজ ফুটবলার ডেনিস কম্পটন মোহনবাগানের খ্যাতিতে মুগ্ধ হয়ে এই ক্লাবে খেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মোহনবাগান তখন বিদেশি খেলোয়াড় নিত না। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশদের সঙ্গে টক্কর দেওয়ায় মহামেডানও ইস্টবেঙ্গলের থেকে এগিয়ে আছে।
যদি পরিকাঠামোর কথা ভাবেন তাহলে ভারতীয় ফুটবলের শ্রেষ্ঠ অবশ্যই বেঙ্গালুরু এফ সি। মাত্র দুবছরে তারা চোখে পড়ার মতো কাজ করেছে। কলকাতার ক্লাবগুলো তাঁদের থেকে অনেক পিছিয়ে। তবু তারই মধ্যেও মোহনবাগানের অ্যাকাডেমি আছে, কংক্রিটের সদস্য গ্যালারি আছে, এখন কাজ না করলেও ফ্লাডলাইট আছে, মাঠের অবস্থা কলকাতার মধ্যে সবথেকে ভালো, জল দাঁড়ায় না। সেখানে আধুনিক জিম (এটা খুবই প্রশংসনীয় কাজ) আর ক্লাব তাঁবু ছাড়া ইস্টবেঙ্গল কোথায়? মাঠের হাল এমন যে টালিগঞ্জও খেলতে চায় না।
ক্লাবের প্রতি আবেগ দুটো ক্লাবেরই আছে। কিন্তু মোহনবাগানি আবেগ কি সেটা ন্যাশনাল লিগ, ফেড কাপ, আই-লিগ জয়ের পর বোঝা যায়। শুধু কলকাতায় নয়, বোঝা যায় পুনে বেঙ্গালুরুর মাঠে। বোঝা যায় যখন ক্লাব অবনমনের আওতায় থাকে তখনও। প্রতি বছরই মোহনবাগানের খেলায় উপস্থিতির হার থাকে সবার উপরে। ভালবাসা শুধু সাধারণের নয়, নজরুল ইসলাম, সত্যজিৎ রায়, সৌরভ গাঙ্গুলি, অমিতাভ বচ্চন, উত্তমকুমার, জ্যোতি বসু, মান্না দে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বাবুল সুপ্রিয়, রাহুল দেববর্মনের মতো বিশিষ্টদেরও। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, লীলা মজুমদার প্রমুখের সাহিত্যে, একাধিক বাংলা এমনকি হিন্দি সিনেমায় মোহনবাগানের উজ্জ্বল উপস্থিতি।
এই ভালবাসার জন্যই উমাপতি কুমার, গোষ্ঠ পাল থেকে শুরু করে শিলটন, অসংখ্য ঘরের ছেলে এই ক্লাবের। এমনকি বিদেশি ব্যারেটো। কিন্তু শান্ত মিত্র, তুষার রক্ষিত আর আলভিটো ছাড়া ইস্টবেঙ্গলের এমন কোনও ছেলে নেই, যিনি দীর্ঘদিন খেলেছেন, অথচ সবুজ মেরুন জার্সি গায়ে তোলেননি। খেলোয়াড়দের মর্যাদারক্ষার ব্যাপারেও মোহনবাগান কয়েক যোজন এগিয়ে থাকবে। মোহনবাগান বরাবরই খেলোয়াড়দের সস্মমানে প্রশাসনে নিয়ে এসেছে। চুনী স্বয়ং ছিলেন সহসভাপতি, ছিলেন শৈলেন মান্না। মাঝে কয়েকবছর ব্যতিক্রম হবার পর চাপে পড়ে আবার সত্যজিৎ, কম্পটন, শিবাজিদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেখানে ইস্টবেঙ্গলে বাইচুঙের ছবি ক্লাব তাঁবু থেকে নামিয়ে ফেলা হয়েছিল। ইস্টবেঙ্গলে ক্লাবে তুলসীদাস বলরামের থেকে আলভিটোর সম্মান বেশি।
মোহনবাগান কর্তাদের অনেক দোষ থাকলেও মোহনবাগান দিবস এবং মোহনবাগান রত্নের মতো ধারনা অন্য কোনও ক্লাবের মাথায় আগে আসেনি। মোহনবাগানের ৭৫ বছর পূর্তিতে যে অনুষ্ঠান হয়েছিল তাকে ছোটখাটো অলিম্পিক বলা যেতে পারে। শুধু পেলের কসমস নয়, হকি অ্যাথলেটিকেও বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়রা এসেছিলেন। সেখানে ইস্টবেঙ্গল তাঁদের প্রি-সেন্টিনারিতে নিয়ে এসেছিল অক্ষয়কুমার, সোনাক্ষি সিনহাকে। হাস্যকর।
আশিয়ান কাপ জয়ের মতো বিরাট কীর্তিকে নিয়েও একটা জমকালো অনুষ্ঠান করতে পারল না ইস্টবেঙ্গল। যাও বা মোহনবাগানের দেখাদেখি ইস্টবেঙ্গল দিবস বলে একটা অনুষ্ঠান চালু করেছে, সে এবার এক ক্লাবকর্তার জন্মদিনে। সেখানেও চুনী গোস্বামীর মতো খেলোয়াড়কে অপমানিত হতে হল। অনুষ্ঠান শুরুর পরেও তাঁকে মঞ্চে ডাকা হল না।
এই অপমানের পরেও চুনীবাবু বলে এলেন, ইস্টবেঙ্গল ভারতীয় ফুটবলের পীঠস্থান। হয়তো ভদ্রতার খাতিরে বলেছেন, কারণ কোনও বিয়েবাড়িতে রান্না যতই খারাপ হোক, মুখে বলতে হয়, খুব ভালো খেলাম। আর যদি মন থেকে এই কথা বলে থাকেন তাহলে মোহনবাগান সমর্থকদের বলব, রাগ কোরো না ভাই, বয়স হলে মানুষের অমন হয়।