গুডবার্ন ওয়ার্ডের আত্মকথা

কোনও এক রাজ্যে, কোনও এক সরকারি হাসপাতালে, গুডবার্ন নামে একটি ওয়ার্ড আছে। সেখানে ভর্তি ছিলেন বদন নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি। সম্প্রতি তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। বদনকে হারিয়ে গুডবার্ন ওয়ার্ড কী ভাবছে ? তার বোবা কান্না সেই পথ দিয়ে যেতে যেতে শুনে ফেললেন রবি কর।।

বছর কুড়ি আগে, টেনিসের ডাবলস খেলায় অস্ট্রেলিয়ার দুই খেলোয়াড় খুব সাড়া ফেলেছিল। তারা একসঙ্গে জুটি বেঁধে খেলত। তাদের নাম ছিল উডফোর্ড ও উডব্রিজ।
বাছা বদন, তোর দৌলতে চিকিৎসা জগতেও ডাবলস জুটি তৈরি হল। তবে উডিজ নয়, গুডিজ। গুডবার্ন ওয়ার্ড আর গুডল্যান্ড নার্সিংহোম। আজ থেকে তোর নাম উচ্চারণ হলেই লোকে এক নিশ্বাসে আমাদের নাম উচ্চারণ করবে।
কিন্তু বাছা বদন, তোর কাছে আমার কি এটাই প্রাপ্য ছিল ? আমি আর গুডল্যান্ড এক হলাম ? মোট এগারো মাস তুই জেল খাটলি। তার মধ্যে প্রায় ৯ মাস আমার ভেতরে ছিলি। জননী যেমন সন্তানকে ন’মাস গর্ভে ধারণ করে, আমি তোকে গর্ভে ধারন করেছিলাম। আর কদিন থাকলেই ৯ মাস পূর্ণ হত। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, তার আগেই হড়াস করে প্রি-ম্যাচিওর্ড ডেলিভারি হয়ে গেল। প্রি-ম্যাচিওর্ড বাচ্চাদের স্বা্স্থ্য ভাল হয় না। প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে। তোরও তাই হচ্ছে। এখান থেকে বেরিয়েই তুই অসুস্থ হয়ে পড়েছিস। গুডল্যান্ডে ভর্তি হতে গেছিস।

woodbarn2

নিন্দুকেরা অবশ্য বলছে, সত্যি সত্যি অসুস্থ হোসনি। অভিনয় করছিস।
তা অভিনয় করবি তো কর, আমার কাছে এসেই কর। এখানে অভিনয় করতে কি তোর কোনও অসুবিধা হচ্ছিল ? এতদিন যে আমার গর্ভে ছিলি, আদর যত্নের কোনও ত্রুটি হয়েছে ? কোনও শখ অপূর্ণ রেখেছি ? যখন যা চেয়েছিস, তাই পেয়েছিস। জানি, ডাক্তাররা রোগ ধরতে পারেনি। তাই ওষুধের বোতল দেয়নি। কিন্তু অন্য বোতল তো পেয়েছিস। আমি কি বাধা দিয়েছি ?
দিইনি। তবুও তুই আমাকে ফেলে গুডল্যান্ডে ভর্তি হলি। কেন হলি ? তোর নামের শেষে শুনেছি গোপাল আছে। গোপাল মানে কৃষ্ণ। কৃষ্ণর আসল মা দেবকি। কিন্তু সব জায়গায় দেখবি, দেবকির থেকে বেশি গুরুত্ব পায় যশোদা। ও বদন, আমার জীবনেও এমন হবে নাকি? যদি তোর কাছে আমার থেকে গুডল্যান্ড বেশি গুরুত্ব পায়, আমি কাঁদতে কাঁদতে মরে যাব বাবা বদন।
তুই কি ভাবছিস, সরকারি হাসপাতাল বলে আমার এখানে বেশি কড়াকড়ি থাকবে ? না রে বাবা, না। আগেও যেমন কড়াকড়ি ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকবে না। অন্তত তোর জন্য থাকবে না। সিবিআই, এফ বি আই যেই আসুক, আমার সন্তানকে আমি মদে-ভাতে, থুড়ি দুধে-ভাতে রাখবই। ভাবছিস, আমার কাছে এলে লোকে তোকে প্রভাবশালী বলবে ? ওরে, অত ভাবলে চলে? সলিল চৌধুরির সেই গানটা শুনিসনি, ‘মন্ত্রী হবার পরে ওদের সবার দু’কান কাটা।’ তাহলে তোর লজ্জা কীসের ? বরং গুডল্যাডসে ভর্তি হলেই তোর লজ্জা। লোকে বলবে, প্রভাব কমে গেছে।
ও বুঝেছি, হাসপাতালে ভর্তি হতে লজ্জা লাগছে ? ভাবছিস, ভালোয় ভালোয় জামিন পেয়ে গেছি, আবার হাসাপাতালে কেন, এবার সোজা নার্সিংহোম। ভুলে যাস না বদন, এক মাঘে শীত যায় না। আবার যদি ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়, তখন তোকে আমার কাছেই আসতে হবে। তখন গুডল্যান্ডও দেখবে না, ওয়েলভিউও দেখবে না। দেখবে এই ন মাসের গর্ভধারিনী মা, থুড়ি ওয়ার্ড।
ভয় পাস না, তোকে অভিশাপ দিচ্ছি না। আমি চাই তুই বাইরেই থাক। সুস্থ থাক। শুধু আমাকে মনে রাখ। আর লোকে যাতে আমাকে মনে রাখে, তার ব্যবস্থা কর। এক কাজ কর। আমার সামনে একটা শ্বেতপাথরের ফলক লাগা। তাতে লিখে দে, ‘এই সেই ঐতিহাসিক ওয়ার্ড, যেখানে মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা রোগ খুঁজে না পেলেও রোগী নিজেই নিজেকে অসুস্থ ঘোষণা করে নিশ্চিন্তে হনুমান চালিশা পাঠ করতে পারে। এই সেই ওয়ার্ড যেখানে অজানা রোগে মাসের পর মাস ভুগতে থাকা রোগী মাত্র আঠারো ঘণ্টায় জামিনোপ্যাথি চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে বাড়ি যান’।

woodbarn3
ম্যালেরিয়ার জীবাণু আবিষ্কার করে রোনাল্ড রস নোবেল পেয়েছিলেন। এস এস কে এম হাসপাতালের যে ঘরে তিনি গবেষণা করতেন, তার বাইরে ফলক লাগানো আছে। জামিনোপ্যাথি আবিষ্কারের জন্য তুইও হয়ত নোবেল পাবি বদন। সেদিন আমাকে মনে রাখিস।
আমার একটা সাধ আছে। নোবেল জয়ী ম্যান্ডেলা যে জেলখানায় বন্দী ছিলেন, তাকে হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে। কত লোক সেটা দেখতে যায়। কত লোক আন্দামানে সেলুলার জেল দেখতে যায়। পুণের জেলখানায় গান্ধীজি বন্দী ছিলেন। আগ্রা দুর্গে শাজাহান বন্দী ছিলেন, এলগিন রোডের বাড়িতে নেতাজি গৃহবন্দী ছিলেন, সবগুলোকেই হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে। কত লোক সেগুলো দেখতে যায়। তাহলে আমাকে, মানে গুডবার্ন ওয়ার্ডকে হেরিটেজ ঘোষণা করা হবে না কেন ? লোকে টিকিট কেটে আমাকে দেখতে আসবে না কেন?
অবিলম্বে আমাকে হেরিটেজ ঘোষণা করা হোক। বল, এখানে বন্দী ছিলেন, জামিনোপ্যাথি চিকিৎসার আবিষ্কারক বদনবাবু। ও, হ্যাঁ, ওপরে ‘মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায়’ কথাটা লিখতে ভুলিস না। এই রাজ্যে সবকিছুই তো মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় হয়। তুই সুদীপ্তর কাছে গিয়েছিলি তাঁর অনুপ্রেরণায়। হাসপাতালে ভর্তি হলি তাঁর অনুপ্রেরণায়। আবার জামিনও পেলি তাঁর অনুপ্রেরণায়। তাঁর অনুপ্রেরণায় আমাকেও হেরিটেজ করে দে। না হয় গায়ে নীল-সাদা রঙ করে দিবি। কিন্তু হেরিটেজ আমাকে করে দে বাবা বদন।

(বেঙ্গল টাইমসের বিভিন্ন লেখা হোয়াটস আপে বা সোশাল সাইটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সেগুলি কোথা থেকে নেওয়া, তার কোনও উল্লেখ থাকছে না। প্রিয় পাঠকদের অনুরোধ, যদি শেয়ার করতে হয়, করুন। কিন্তু লেখকের নাম ও বেঙ্গল টাইমসের কথা উল্লেখ করুন। আশা করি, এই ন্যূনতম সৌজন্যটুকু দেখাবেন।)

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.