স্মৃতিটুকু থাক
অন্তরা চৌধুরি
কথায় বলে চৈত্র মাস মধুমাস। অবশ্য এখন এই কথা কাউকে বললে একটা মারও আমার পিঠের বাইরে পড়বে না। কারণ গত কয়েক দিনের তীব্র দাবদাহে চৈত্র মাসকে আর অন্তত মধুমাস বলা যায় না। বরং যা লু বইছে, ধু ধু মাস বলা যেতে পারে। কিন্তু একটা সময় ছিল, যখন সারা বছর ধরে এই চৈত্র মাসের জন্যই অপেক্ষা করতাম। স্মৃতির সরণি বেয়ে আবার একটু ফিরে যাই ছোটোবেলায়।
চৈত্র মাস পড়তে না পড়তেই আমাদের বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন ছোট ছোট জনপদে শুরু হয়ে যেত শিবের গাজন। আমরা দিন গুনতাম, কবে সেই গাজন দেখতে যাব! মনে আছে, একবার অনেক ছোটবেলায় পিসিমণির শ্বশুরবাড়ি বর্ধমান জেলার মিঠানীতে গিয়েছিলাম। সেখানে খুব জাঁকজমক সহকারে চব্বিশ প্রহর হয়। আমার কাছে তখন ‘চব্বিশ প্রহর’ নামটা নতুন ছিল। মানেটাও বুঝতাম না। পরে জানলাম, সারা দিন-রাত ধরে নাম হরি নাম সংকীর্তনকেই চব্বিশ প্রহর বলে। সেই নাম গান এক মিনিটের জন্যও থামবে না। এক দল কীর্তন করে উঠে যেতে না যেতেই আরেকদল কীর্তন শুরু করে দেবে। সেই উপলক্ষ্যে গোটা গ্রাম জুড়ে বিশাল মেলা বসত। গ্রামে প্রত্যেকের বাড়িতে বাড়িতে অতিথি। খাওয়া দাওয়ার এলাহি আয়োজন। ওদিকে চৈত্র মাসের শুরুতেই আমাদের বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড়ে শুরু হয়ে যায় ধারার মেলা। সেই শুরু। তার পর এক এক করে এক এক জায়গায় গাজন শুরু হয়ে যায়।
আমি তখন বেশ ছোট। অর্থাৎ বাবা, কাকার সাইকেলে চেপে অনায়াসেই ইতি উতি ঘুরে বেড়াতে পারি। আমার তিন কাকাই আমাকে বড় বেশি ভালোবাসত। এক একজন কাকার একেক রকম বৈশিষ্ঠ্য ছিল। সেই ছোট্ট বয়সে আমি ছিলাম তাদের প্রাণের সঙ্গী। একদিন খবর পেলাম, আমাদের বাড়ির কাছে শালবনীতে গাজন হচ্ছে। বাবুকাকা বলল, ‘চল আজকে তুই আর আমি মেলা দেখতে যাব।’ সন্ধ্যে বেলায় আমি তো রেডি হয়ে বসে আছি। কিন্তু বাবুকাকার পাত্তা নেই। কারণ, তিনি ছিলেন অন্য কাকাদের তুলনায় একটু অতিরিক্ত শৌখিন। ঘন্টাখানেক ধরে স্নানটান সেরে বেশ ধোপদুরস্থ জামাকাপড় পরে তাঁর আবির্ভাব হল। এক ঝলক দেখলে মনে হবে বিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। চুলে শ্যাম্পুর গন্ধ আর বিল ক্রিমের গন্ধে চারিদিক ম ম করছে। গালটা বেশ চকচক করছে। চুল ফুরফুর করছে। কম বয়সে বাবুকাকাকে অনেকটা রাজেশ খান্নার মতোই দেখতে ছিল। অসম্ভব ফর্সা, তার সঙ্গে মিশেছে লালচে আভা। তার সাইকেল খানাও পক্ষীরাজ ঘোড়ার চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না। অর্থাৎ সেই সময় রাস্তা দিয়ে গেলে লোকজন বেশ তাকাত। তারপর সন্ধ্যেবেলায় বাবুকাকার সেই পক্ষীরাজে চেপে আমরা পৌঁছে গেলাম শালবনীর গাজনে। সেখানে আমাদের বাড়িতে যে মাছ দিত, সেই নিতাই কাকুর বাড়ি ছিল, সে আমাদের মেলায় দেখতে পেয়ে টানতে টানতে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। তারপর লুচি, ঘুগনি, পায়েস, মিষ্টি বেশ জম্পেশ করে খাইয়ে তবে ছাড়ল।
এদিকে, গাজন ততক্ষণে বেশ জমে উঠেছে। চারিদিকেই অজস্র লটারির দোকান। সে বিভিন্ন রকমের লটারি। সবচেয়ে বেশি ডিম লটারি। সাবান লটারি থেকে শুরু করে নারকেল তেল লটারিও রয়েছে। লটারি ব্যাপারটা কী অত ছোট বয়সে আমি ঠিক বুঝতাম না। কিন্তু দেখতে বড় ভালো লাগত। বাবুকাকা অনায়াসে ডিম লটারি খেলতে বসে গেল। তখন ডিম লটারি ছিল কুড়ি পয়সার। দেখি যেখানেই পয়সা দিচ্ছে সেখানেই ডিম পেয়ে যাচ্ছে। সে এক দারুণ মজার ব্যাপার। প্রথম পর্যায়ে প্রায় চল্লিশ খানা ডিম পাওয়া গেছে। আমার তো খুব আনন্দ। আমি বরাবরই ডিম খেতে বড্ড ভালোবাসি। ভাবছি কখন বাড়ি গিয়ে ডিমগুলো সাঁটাব। তার পর শুরু হল বাবুকাকার সাবান লটারি খেলা। তখন বেশ বড় বড় মোতি সাবান ছিল। সেবারে বাবুকাকা প্রায় কুড়িখানা মোতি সাবান আর পাঁচখানা নারকেল তেলের কৌটো জিতল।
কিন্তু লটারি ওরফে ডিম জেতার নেশা কঠিন নেশা। বাবুকাকা আবার ডিম লটারি খেলতে শুরু করল। তারপর বেশ রাত করেই বাড়ি ফিরলাম। গুণে দেখা গেল মোট সাতষট্টি খানা ডিম পাওয়া গেছে। তখন বাড়িতে অনেক লোক যদিও। সকলেরই বেশ দু তিনখানা করে ভাগে জুটবে। সেই নিয়ে বেশ মজা সকলেরই। এদিকে গোটা দুয়েক নিয়ে খেতে গিয়ে দেখি খোলা ছাড়ানোই যাচ্ছে না। কারণ ভালো করে সেদ্ধ হয়নি। তখন বাড়িতে গ্যাস ছিল না। কাজেই অত রাত্রিরে আবার অতগুলো ডিমকে মাটির খোলায় সেদ্ধ করে ঠাকুমা রান্না করল। সেদিন বাড়ির সকলে মিলে পরমানন্দে খাওয়া হল ভাত আর লটারি থেকে পাওয়া ডিমের ঝোল।
তার পর থেকে বাবুকাকার সঙ্গে গাজন দেখতে যাওয়াটা একটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া এই সমস্ত প্রত্যন্ত গ্রামীণ মেলা বা গাজনে একটা অদ্ভুত আনন্দ বা মাদকতা আছে; যা অধুনা কর্পোরেট মেলায় নেই। প্রাণ নেই। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল হাতে ঘোরানো নাগরদোলা। কাঠের তৈরি সেই ছোট্ট নাগরদোলায় চাপতে কী ভালোই না লাগত! যে লোকটা ঘোরাত সে মুখের মধ্যে একটা অদ্ভুত আওয়াজ করত। আর নাগরদোলায় ঘুরতে ঘুরতে আনন্দে মেশানো এক অদ্ভুত হাসি আমাদের কিছুতেই থামত না। এখন মনে হয় কত দিন সেই হাসি হাসিনি। তারপর যখন কাকাদের সঙ্গে সাইকেলে চাপার বয়স ফুরোল, তখন মা কাকিমাদের সঙ্গে মেলায় যেতাম। আমি, মা, কাকিমা, ভাই আর কুট্টুস। এই জুটিটা আমাদের দারুণ ছিল।
মেলাতে ঘুরতে ঘুরতে ধুলোর চোটে মাথার চুল লাল হয়ে যেত। কিন্তু রুমাল দিয়ে নাখ ঢাকার বালাই ছিল না। সেই ধুলো ছিল বড় মিষ্টি। কত বিচিত্র খাবার যে এই সমস্ত মেলায় পাওয়া যেত তার ঠিক নেই। বাবাই গাজনের সময় ভোরবেলায় এক্তেশ্বর যেত। আর সেখান থেকে নিয়ে আসত কুলগুঁড়ো। ওই কুলগুঁড়ো শুধুমাত্র এক্তেশ্বরের গাজনেই পাওয়া যেত। গ্রীষ্মকালের দিনে নুন, লঙ্কা, তেল দিয়ে ওই কুলগুঁড়ো মেখে ভাত খাওয়ার স্বাদই আলাদা। তবে শুধু কুলগুঁড়ো নয়। আসন্ন বৈশাখের কথা ভেবে তার সাজ সরঞ্জাম ওই চৈত্রের মেলাতেই কিনে নেওয়া হত। যেমন তালপাতার পাখা, মাটির কুঁজো, কলসী, মাদুর, লাটাই, শীতলপাটি ইত্যাদি। তখনকার দিনে বড় বেশি লোডশেডিং হতো। তাই সেই গ্রীষ্মের দুপুরে কুজোঁর জল খেয়ে মাটিতে শীতলপাটি বিছিয়ে ঠাকুমার কাছে শুয়ে পড়তাম। ঠাকুমা সারা দুপুর তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করত আর রামায়ণ মহাভারতের গল্প বলত। এখন মনে হয় সে এক রূপকথার জগৎ ছিল।
তারপর এই চৈত্র বৈশাখ মাসে আমাদের বাড়িতে সন্ধ্যে বেলায় হতো হরির লুঠ। তুলসী থানে পুজো করার পর চারিদিকে বাতাসা ছড়ানো হতো। আমাদের সব ভাইবোনদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত সেই বাতাসা কুড়োনোর। আর সেই বাতাসাগুলো খেতে কেন যে এত ভালো লাগত বুঝি না। ছোটবেলার সব কিছুই বড় মধুময়, বড় প্রাণময় তাই না!
এখন ফোনে খবর পাই অমুক জায়গায় গাজন হচ্ছে, মেলা বসেছে। ভেতরটা ছটফট করে। কলকাতার এই জনবহুল মহানগরীতে বসেও একাকীত্বের দীর্ঘশ্বাস আরও আরও প্রগাঢ় হয়। তবে সেই গাজনে যাওয়ার অভ্যেসটা বাবুকাকা আজও বজায় রেখেছে। তবে একা নয়, কুট্টুসকে নিয়ে যায়। সেই ঝাঁ চকচকে সাইকেলটা আর নেই। বাহন এখন মটর বাইক। বাবুকাকাও আগের মতো ঝাঁ চকচকে নেই। সময়ের পলেস্তারা শরীরে পড়লেও মনে অন্তত পড়েনি। তাই আজও বাবুকাকা ডিম লটারি খেলে। সাতষট্টিটা না হোক; অন্তত গোটা দশেক তো আনেই। আর টাইম মেশিনে চেপে আজও বাবুকাকার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটা। সে অবাক বিস্ময়ে দু চোখ ভরে দেখে, শুধু দেখে!
***