একান্ত সাক্ষাৎকারে লিলি চক্রবর্তী
লিলি চক্রবর্তী। সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, ঋষীকেশ মুখোপাধ্যায়, গুলজার হয়ে
পরের প্রজন্মের ঋতুপর্ণ ঘোষ, শিবপ্রসাদ–নন্দিতা, সৃজিতদের সঙ্গে দীর্ঘ তেষট্টি বছর সমান তালে কাজ করে চলেছেন তিনি। এই স্বনামধন্যা অভিনেত্রীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার এক ঝলক কুমকুম বসু দাসের কলমে।
প্রশ্ন: আপনার অনলস কাজ কি প্রমাণ করছে এই মহামারীর আতঙ্ক আপনাকে ছুঁতে পারেনি?
উত্তর: দেখো ভাই, এত বছর এক নাগাড়ে কাজ করে জীবন-সাহাহ্নে এসে পৌঁছেছি। ভগবানের কাছে একান্ত প্রার্থনা, এই মহামারী থেকে পৃথিবী মুক্ত হোক। কিন্তু কাজ থামালে সমস্ত টেকনিসিয়ানরা কর্মহীন হয়ে পড়বেন। নিয়ম মেনে কাজ করছি। ভয়ে যেন মানসিক অপমৃত্যু না হয়।
প্রশ্ন: বাংলা ছবির সঙ্গে সঙ্গে হিন্দি ছবিতে ও আপনি সমান সাফল্য পেয়েছেন। হিন্দি ভাষার সঙ্গে একাত্ম হতে অসুবিধা হয়নি?
উত্তর: তাহলে আমাকে ফিরে যেতে হয় আজ থেকে প্রায় বাহাত্তর বছর পিছনে। আমার বয়স তখন পাচ কি ছয়। দেশ ভাগের আগে ঢাকা বিক্রমপুরের ভিটেবাড়ি ছেড়ে আমরা কলকাতায় চলে আসি। সেখান থেকে আমার বড় মামা আমাকে নিয়ে যান মধ্যপ্রদেশের ফরাশিয়ায়। ভর্তি হয়েছিলাম পেঞ্চভ্যালি স্কুলে। হিন্দি মাধ্যম স্কুল। বন্ধুরাও বেশির ভাগই ছিল হিন্দিভাষী। তাই হিন্দিতে বেশ সড়গড় হয়ে উঠেছিলাম।
প্রশ্ন: অভিনয় জীবনের আঙিনায় কেমনভাবে পদার্পণ করলেন?
উত্তর: পেঞ্চভ্যালি স্কুল থেকে পাশ করে কলকাতায় এলাম কলেজে পড়ব বলে। কিন্তু বাবার আর্থিক অবস্থা তখন খুবই খারাপ। বাবাকে সাহায্য করার জন্য অফিস ক্লাবে নাটক করতে গিয়েছিলাম। পরিচালক ছিলেন কুণাল মুখোপাধ্যায়। আমার অভিনয় দেখে তিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন চিত্রপরিচালক কনক মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি তাঁর ‘ভানু পেল লটারি’ ছবিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রোল দিয়েছিলেন। সহ অভিনেতা ছিলেন কমল মিত্র ও জহর রায়। এরপর পিনাকী মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘মধ্য রাতের তারা’। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
প্রশ্ন: বম্বেতে অনেকদিন কাজ করেছেন। সেখানে কাজ করার কোনও বিশেষ অভিজ্ঞতার কথা যদি বলেন।
উত্তর: একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। জুহুতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে রয়েছি। হিন্দি ছবির বিশিষ্ট গীতিকার ও পরিচালক গুলজারজি আমাকে ডাকলেন তাঁর ‘আচানক’ছবির জন্য। আমি নায়িকা, নায়ক বিনোদ খান্না। কথা বার্তা হয়ে যাওয়ার পর গুলজারজি অনুরোধ করলেন, প্রোডিউসার এন সি সিপ্পির সঙ্গে একটু কথা বলে নিতে। আমি সবিনয়ে জানিয়ে দিয়ে দিলাম, কোনও প্রোডিউসারকে ফোন করা বা নিজে থেকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পরে অবশ্য এন সি সিপ্পির সঙ্গে আমার একটি সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। তিনি আমাকে ‘বড়ি বেটি’ বলে সম্বোধন করতেন। বাঙালি রান্না ছিল তাঁর প্রিয়। তাকে ইলিশের পাতুরি, চিংড়ির মালাইকারি বেশ কয়েকবার রান্না করে খাইয়েছি।
প্রশ্ন: অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গেও তো অভিনয় করেছেন। মানুষ হিসেবে তাঁকে কেমন লেগেছে?
উত্তর: তখন হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘আলাপ’ছবিতে কাজ করছি। অমিতাভ বচ্চনের বৌদির রোল। ঋষিদা বলেছিলেন শর্টে যাওয়ার আগে উনি আমার লুকটা দেখে নেবেন। গেলাম। দেখি অমিতজি রেডি। ঋষিদার সঙ্গে কথা বলে মেক আপ রুমের দিকে এগিয়েছি। অমিতজি বলে উঠলেন, ‘কেয়া লিলিজি, এক সাথ কাম করনা, হ্যালো ভি বোলা নেহি’। এমনই উদার মানুষ তিনি। ‘আলাপ’ছবির আগে ‘চুপকে চুপকে’ ছবিতে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছিলাম। এত বছর বাদে আবার দেখা। পিকু ছবির সাফল্যের পর গ্র্যান্ড হোটেলে একটি অনুষ্ঠানে আবার দেখা চল্লিশ বছর পর। আমাকে তিনি ডাকলেন। এমনভাবে গল্প করলেন যেন মাঝের এই দীর্ঘ ব্যবধানটি কিছুই নয়।
প্রশ্নঃ পরিচালক সত্যজিৎরায়ের সঙ্গে কাজ করে কেমন লেগেছে ?
তখন আমার সতেরো বছর বয়স। পরিচালক অসিত সেনের ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবিতে কাজ করছি। এই সময় মানিকদা তাঁর ‘অপুর সঙসার’ ছবির নায়িকার জন্য নতুন মুখ খুঁজছেন। অসিতদা কথাটা আমাকে বললেন এবং একদিন মানিকদার লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বিজয়া বৌদি আমাকে সাজিয়ে দিলেন। মানিকদা নানা অ্যাঙ্গেলে আমার ছবি তুললেন। বললেন, রোলটা আর একটি মেয়ের করার কথা আছে। তোমাকে সেকেন্ড অপশন হিসেবে রাখলাম। কাজটি না পেলে মনখারাপ করবে না। পরে অবশ্যই তোমাকে ডাকব। তিনি কথা রেখে ছিলেন। ‘জন অরণ্য’ ছবিটির জন্য তিনি আমাকে ডেকেছিলেন। পরে তাঁর ‘শাখা প্রশাখা’ ছবিতেও কাজ করেছি। প্রায়সব খ্যাতনামা পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছি। তিনি একেবারে ব্যতিক্রমী ঘরানার। সব কিছু এঁকে রাখতেন। অভিনেতাকে শুধু শর্টটা কেমন চাইছেন বুঝিয়ে দিতেন। অভিনেতা নিজের মতো অভিনয় করতেন। মানিকদার সঙ্গে কাজ করার আনন্দ আমার দীর্ঘদিনের অভিনয় জীবনের সব অভিজ্ঞতার জৌলুসকে যেন অনেকটাই ম্লান করে দেয়।