‌ভ্রমণ দেজা ভু

মধুজা মুখোপাধ্যায়

মহামারীর পর জীবনের হিসেব নিকেষ নিয়ে বসেননি এমন মানুষ এখনও খুঁজে পাইনি। অনিচ্ছাকৃত হলেও মহামারীর আগের জীবনের সঙ্গে পরের জীবনের কেমন যেন তুলনা চলে আসছে বার বার।

২০২০–‌২১ এর রোষানলে বাঙালির বেড়ানোর প্রিয় জায়গা গুলোর মধ্যে অন্যতম গন্তব্যগুলো অক্ষত আছে তো? আশঙ্কা হল। এবারে দেশে গিয়ে সুযোগ করে পুরীতে পা রাখলাম। দেড়দিনের ঝটিকা সফরে কিছু পরিচিত দৃশ্য কোলাজের মতো নিজে থেকেই কেমন যেন মনের ক্যানভাসে আবার নতুন করে জায়গা করে নিল।

দৃশ্য ১
মনোহারি মদনমোহন
মদনমোহন মিষ্টির নামটা প্রথম শুনি ২০০৯ সালে, পুরীর সমুদ্রের ধারে, সমুদ্র স্নান সারার ঠিক পর। পাড়ের দিকে চোখ পড়তেই চির পরিচিত দৃশ্য, বাঁক কাঁধে হাঁড়ি হাঁড়ি মিষ্টি নিয়ে মিষ্টিওয়ালার হাঁক। হাঁড়িতে উঁকি মারতেই জীবনে প্রথম দেখা পেলাম মদনমোহনের। নামের তাৎপৰ্য ঠিক জানা নেই। তবে আন্দাজ করছি মিষ্টির আকার অনেকটা শ্রীকৃষ্ণের ছোটোখাটো একটা বাঁশির মতো। আর সেখান থেকেই হয়ত নাম হয়েছে মদনমোহন। এবছর পুরীতে গিয়ে প্রাতঃভ্রমণে সূর্যোদয়ের পর আবার সেই মদনমোহনের উদয়, সমুদ্রের ধারে। মাঝে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, বদল হয়েছে পৃথিবীর। কিন্তু মদনমোহনের প্রতি আকর্ষণের কোনও পরিবর্তন অনুভব করলাম না। পরিবর্তন নেই মদনমোহনের হাঁড়ির মালিকের হাঁক ডাকের, পরিবর্তন নেই সেই পুরনো স্বাদের।

দৃশ্য ২
কৌতূহলী রানি গুন্ডিচা

ছোটবেলায় ট্রেনে চেপে একবার কোথায় যেন বেড়াতে যাচ্ছি। প্ল্যাটফর্মে ছাড়তে আসা এক আত্মীয়ের কাছ থেকে একটা বই উপহার পেয়েছিলাম। যার মলাটে একটা রহস্যময় ছবি ছিল। রানি গুন্ডিচা। কৌতূহল সামলাতে না পেরে বন্ধ কক্ষের আগল ঠেলে দেখে ফেলেছেন বিশ্বকর্মার কীর্তি। বড়বেলায় আরেকটি বই উপহার পেলাম, প্লেনে ওঠার আগে। এবার আর মলাটে না, সেই একই রহস্যময় ছবিখানি বইয়ের ভেতরে স্থান করে নিয়েছে। বার বার বইয়ের পাতা উল্টে চোখ যাচ্ছে সেই ছবির দিকে, মন পড়ে রইল রানির গোল গোল চোখের দিকে, অবাক হয়ে কক্ষে উঁকি মেরে কী দেখছে সে? ট্রেন জার্নি থেকে প্লেন জার্নি করতে মাঝে অনেক বছর। তবুও বিশ্বকর্মার অন্ধকার কক্ষের ভেতরের আকর্ষণ যেন একইরকম। পুরীতে পা রাখা মাত্র এই অন্ধকার কক্ষের প্রতি কেমন একটা টান এসে গেল। প্যান্ডেমিক চোখ রাঙিয়েছে অনেক, প্রতীক্ষা করিয়েছে অনেক। কিন্তু এই টান অনুভবের মুহূর্ত কেড়ে নিতে পারেনি।

দৃশ্য ৩
অনুসন্ধিৎসু মহামানব

মহামারীর পর এবছর মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢোকার সুযোগ হয়নি। মন্দিরের গর্ভগৃহে বেশ কয়েক বছর ধরে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ। সমুদ্রের গর্জন কোনও অজানা কারণে মন্দিরের ভেতরে ঢোকে না, বা বলা যেতে পারে ঢুকতে দেওয়া হয় না। তেমনই আরও অনেক কিছুই হতে দেওয়া যেত, কিন্তু হতে দেওয়া হয়নি, যার বিচার করার আমি কেউ নই। এসব কথা মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম। পান্ডার উপদেশে ভিড় বাঁচিয়ে সামান্য দূরে গরুর স্তম্ভের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেওয়ালে মহাপ্রভুর আঙুলের ছাপে হাত রাখলাম। আজ থেকে বহুবছর আগে এক সৌম্যদর্শন মহাপুরুষ যার প্রেমমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ভক্তির প্লাবনে গোটা মানবজাতি ভেসে গিয়েছিল, তাঁর হাতের ছাপে হাত রাখতেই ইতিহাস জীবন্ত হয়ে উঠল। চোখ পড়ল সামনে। মন্দিরের গর্ভগৃহের দরজার এক পাশ থেকে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আছেন জগন্নাথ দেব, বিশাল বড় বড় তাঁর চোখ। সমস্ত জগৎ সংসারকে দেখছেন তার ওই দু চোখ দিয়ে, মহাশূন্যের মত তাঁর ঘোর কালো গায়ের রং ভেদ করে ঠিকরে বেরোচ্ছে এক অপূর্ব জ্যোতি। ঠিক এমনভাবেই বড় বড় চোখ করে তিনি গরুর স্তম্ভের দিকে মুখ রেখে মহাপ্রভুকেও দেখতেন একদিন। সাগর সমান কী অসীম রহস্য আর এই রহস্যে গা ভাসিয়েছি আমরা সবাই, যুগ যুগ ধরে, অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছি সেই রহস্যের। আজও মন্দির চাতালে দাঁড়িয়ে সেই অনুসন্ধিৎসু মন অবিচল।

শেষ দৃশ্য
পুরীর প্ল্যাটফর্ম

মহামারী কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু। বদলে দিয়েছে ভাবনা চিন্তা। গোটা পৃথিবীকে ঘরের মধ্যে বা বলা ভাল, মুঠো ফোনের মধ্যে ধরে এনে বন্দি করেছে। অনেকের জন্য চিরতরে বন্ধ হয়েছে বহির্জগৎ। কিন্তু যা কিছু চিরন্তন তার কি কোনও পরিবর্তন হয়েছে? হয়? মাথার ভেতর কেমন যেন কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন চলছে। প্যানডেমিকের আগে পুরী এলে যা কিছু অনুভূতি জাগত, তার তো কোনও পরিবর্তন হয়নি! ট্রেন ছাড়বে কলকাতার উদ্যেশ্যে কিছুক্ষণের মধ্যেই। জগন্নাথ দেবের সঙ্গে চোখাচুখি হওয়ার সময় একটা প্রশ্নই মাথায় এসেছিল, ‘‌তবে কেন’‌ ? সেই প্রশ্নের উত্তর এই কোলাজে হয়তো খুঁজতে থাকব। পরেরবার বন্ধ কক্ষের উন্মুক্ত দরজার ওপারে দাঁড়ানো বৃহৎ চক্ষুদ্বয়ের সামনে দাঁড়িয়ে না হয় আবার এই অপরিবর্তিত বোঝাপড়া হবে।

ট্রেন ছাড়ল। জয় জগন্নাথ!
‌‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.