কৌশিক কর্মকার
বছরের পর বছর। কত মানুষ অপেক্ষা করেছেন হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ির তলায়। এই বিষয়ে আমার একটা খুব মজার অভিজ্ঞতা আছে। তখন সদ্য গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি। মোবাইল ফোন সবেমাত্র মার্কেটে এসেছে। কিন্তু আমাদের মতন সাধারণ মানুষের কাছে তখনও এসে পৌঁছায়নি। সদ্য কলেজ থেকে পাস করা ছাত্রের হাতে তো একদমই নয়।
এমন একটা সময় কোনও একটা প্রয়োজনে আমি আর আমার আর এক ক্লাসমেট বন্ধু ঠিক করলাম খড়গপুর যাব। ট্রেন ধরবো হাওড়া স্টেশন থেকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আমি বারাসাতের বাসিন্দা। আমার সেই বন্ধুর বাড়ি গড়িয়ায়। কলেজ থেকে পাশ করে গেছি তাই আর তেমন দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। কিন্তু দুজনের বাড়িতেই ল্যান্ডলাইন থাকায় মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়। তো সেরকমই এক সময় ফোনে ঠিক হল যে আমরা যে যার বাড়ি থেকে সকালে বের হব এবং হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে বড় ঘড়ির তলায় অপেক্ষা করব যতক্ষণ না আর একজন এসে পৌঁছায়। তারপরে দুজন পৌঁছালে একসঙ্গে ট্রেনে করে খড়গপুর যাব।
পরিকল্পনা মতই আমি পরের দিন সকাল বেলা হাওড়া স্টেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। এদিকে আমরা শিয়ালদা বারাসাত লাইনের যাত্রী হওয়ায় বারাসাত মধ্যমগ্রাম বিরাটি এবং শিয়ালদা স্টেশন দিয়ে যতবার যাতায়াত করেছি বা যত ভালোভাবে এই স্টেশনগুলোকে চিনি, হাওড়া স্টেশন আমার কাছে তখনও পর্যন্ত ঠিক ততটাই অপরিচিত। বেশ কয়েকবার হাওড়া স্টেশনে গিয়েছি দূরপাল্লার ট্রেন ধরার জন্য এবং প্রায় প্রত্যেক বার গিয়েছি অভিভাবকের সঙ্গে। যার ফলে হাওড়া স্টেশন থেকে ভেতর থেকে তত ভালভাবে চেনা হয়ে ওঠেনি তখনও পর্যন্ত। তার ফলে যা হল, আমি সেইদিন হাওড়া স্টেশনে পৌঁছলাম এবং স্টেশনের বাইরের বড় ঘড়ি দেখে স্টেশন থেকে একটু দূরে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন আমার সেই বন্ধু এসে পৌঁছায়। ১ ঘন্টা কেটে গেল, তবু বন্ধু এল না। বেশ অধৈর্য হয়ে উঠলাম। আরও একঘন্টা কাটলো। তবু তার দেখা নাই। এবারে প্রচন্ড রাগ হল। আগেই বলেছি, আমাদের কারও কাছেই মোবাইল ফোন ছিল না। একটু সরে গিয়ে কোন একটা পাবলিক বুথ থেকে সেই বন্ধুর বাড়িতে ফোন করে জানলাম, সে নাকি অনেকক্ষণ আগেই বেরিয়েছে। এবারে প্রচন্ড রাগ হল। নিঃসন্দেহে সে হাওড়া যাচ্ছি বলে অন্য কোনও জায়গায় গেছে।
কোনওরকমে আর ৩০/৪০ মিনিট অপেক্ষা করে বিরক্ত হয়ে গজরাতে গজরাতে বাড়ি চলে এলাম। সন্ধ্যেবেলা দেখি সেই বন্ধু বাড়ির ফোনে ফোন করেছে। তো প্রথমেই তো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলাম। তারপরে কিছুক্ষণ পরে বুঝতে পারলাম, আমার সেই বন্ধু নাকি প্রায় আমার মতই তিন ঘন্টা আমার জন্য হাওড়া স্টেশনে অপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে গেছে। ধীরে সুস্থে যেটা বুঝলাম, ওখানে নাকি দুটো বড় ঘড়ি আছে। একটা আছে স্টেশনের বাইরে, যার তলায় আমি অপেক্ষা করছিলাম। আর একটা আছে স্টেশনের মধ্যে, যেখানে আমার বন্ধু অপেক্ষা করেছে। বড় ঘড়ি বলতে নাকি ওই ভিতরের ঘড়িটাকে বোঝায়। কিন্তু আমি ওই পথের যাত্রী না হওয়ায় সেটা বুঝতেই পারিনি।