হৃদয় মুচড়ে দেওয়া সেই ভাইফোঁটা

স্মৃতিটুকু থাক

আশির দশকের ক্লাস নাইন এর কথা। তখন দুর্গা পোজো শেষের পরেই একটা শীতের আমেজ পড়ে যেত। রবিবার এর সকাল, ভবানীপুরের তস্য এঁদো গলিতে জমিয়ে ক্রিকেট খেলা চলছে। ব্যাটটা ভালই করছিলাম, আচমকা পাড়ার মোড়ে একটা ম্যাটাডর এসে থামলো। পাড়ায় নতুন ভাড়াটে, ফার্নিচার নামানো চলছিল, সেই সঙ্গে চলছিল আমার ব্যাট, ৯৫ রানে নট আউট। এমন সময়ে ম্যাটাডরের সামনে লাল হলুদ ট্যাক্সির আগমন, অনুকে সেই প্রথম দেখলাম (নামটা অবশ্য পরে জেনেছিলাম), টুকটুকে ফর্সা গায়ের রঙ… শার্প নাক.. লম্বা বিনুনি.. সাদা চিকণের একটা চুড়িদার।

৯৬ রানে আমার মিডিল স্টাম্প উড়ে গেল, ক্যাপ্টেন ডাব্বু আমার দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকাল, ছোটবেলার বন্ধু তো সব, দুর্বলতাগুলো জানত। বাছা বাছা বিশেষণ বেরোচ্ছিল ওর মুখ দিয়ে, কিন্তু কেন জানি না সেগুলো আমার কান পর্যন্ত এসে পৌঁছাচ্ছিল না।


যাই হোক, বিকেল বেলা নতুন জামা কাপড় পরে কায়দা করা চুলে কলিং বেলে হাত দিলাম, একজন সুন্দর মা মা দেখতে মহিলা এসে দরজা খুললেন, কান অবধি দাঁত বার করে বললাম.. মাসিমা আমার নাম পল্টু .. আপনাদের দুটো বাড়ি পরেই থাকি .. কিছু দরকার হলে বলবেন।

কী সুন্দর লোক ওরা, কী সুন্দর ব্যবহার, সোফায় বসে লক্ষ্মী পুজার নাড়ু আর মোয়া খেতে খেতে মাসিমা আর মেসোমশায় এর সঙ্গে অনেক গল্প হল। মাসিমা অনুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন, ঘন্টাখানেক পরে ওদের সঙ্গে সমস্ত সুখ দুঃখ, বিপদ আপদে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যখন বেরলাম তখন মনে হচ্ছিল জামার কলারটা একটু তুলে হাঁটি। নিজেকেই মনে মনে বললাম.. পল্টু দেখে রাখ এই হল তোর হবু শ্বশুর বাড়ি।

নিয়ম করে প্রতিদিন যেতাম অনুদের বাড়ি, কখনও ইলেকট্রিক বিল জমা দিয়ে দেওয়া। কখনও জলের মিস্ত্রী জোগাড় করে দেওয়া, দিন দশেকের মধ্যেই যাকে বলে টোটাল ঘরের ছেলে। একদিন এর মধ্যে মাসিমা দুপুর বেলা নেমন্তন্ন করে খাইয়ে দিলেন। মনে মনে ভাবলাম অভ্যাসটা থাকা ভাল, ফি বছর জামাইষষ্ঠীতে তো আসতেই হবে।

পাড়ায় বন্ধুবান্ধবরা আমাকে হিরোর চোখে দেখছিল, ডাব্বু তো বলেই ফেলল … কি করছিস মামা, এতো পুরো রাজধানী এক্সপ্রেসের মতো এগোচ্ছিস। সবাইকে বলে দিলাম.. ওদিকে নজর দিবি না … তোদের বৌদি হয়।

দেখতে দেখতে কালীপুজা এসে গেল, অনুকে নিয়ে একসঙ্গে বাজি কিনতে গেলাম, কোচিংয়ের তিন মাসের টাকা ঝাড়া ছিল, ওখান থেকে অনুকে দুশো টাকার বাজি কিনে দিলাম। অনুর চাউনিটা এখনও মনে পড়লে মনটা ইয়ে ইয়ে হয়ে যায়।

কালীপুজার রাতে অনুদের ছাদে আমি আর অনু একসঙ্গে বাজি ফাটালাম, আধো আলোছায়ায় অনুকে দারুণ লাগছিল, সত্যি বলছি খুব চুমু খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল, মনে মনে নিজের পেছনেই একটা লাথি কষালাম …. বাড়াবাড়ি করিস না পল্টু.. এখনও একমাসও হয়নি। এসবের জন্য দিন তো পড়েই আছে।

পরদিন সন্ধেবেলা পাড়ার রকে বসে বন্ধুদের কাছে অনুর সঙ্গে বাজি পোড়ানোর গল্প বলছি, বন্ধুরা একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে শুনছে, এমন সময়ে হঠাৎ অনু হাজির, সোজা এসে হাত ধরে বলল…. অনেক আড্ডা মেরেছো … এখন চল তো… মা তোমাকে ডাকছে…বলছে জরুরি দরকার।

বন্ধুদের চোয়াল ঝোলা মুখগুলো ছিল দেখার মতো, আমার মনের ব্যাকগ্রাউন্ডে তখন গান বাজছে … শায়েদ মেরি শাদি কা খেয়াল/‌ দিম মে আয়া হ্যায়…ইসি লিয়ে মাম্মি নে মেরি তুঝে চায়ে পে বুলায়া হ্যায়।
অনুদের বাড়ি ঢুকে পুরো সিন না একটু কেমন কেমন লাগলো, মাসিমা মেসোমশায় একগাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে, হঠাৎ এতো আনন্দের কারণটা মাথায় ঢুকছিল না, মাসিমা একদম বুকে জড়িয়ে আমাকে ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরের মেঝেতে একটা আসন পাতা, এক থালা মিষ্টি … প্রদীপ জ্বলছে। মাথাটা বনবন করে ঘুরছিল … হাঁটুতে জোর পাচ্ছিলাম না, মনে হচ্ছিল এখুনি হার্ট অ্যাটাক করবে। মাসিমার কথাগুলো মনে হচ্ছিল অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে… আর বলো না বাবা… অনু আজ সকাল থেকে বায়না করছে… তোমাকে ভাইফোঁটা দেবে.. ওর নিজের তো ভাই নেই, খালি বলছে পল্টুদার মতো ছেলে হয় না।

প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে গুটি গুটি পায়ে ফাঁসিরমঞ্চে উঠলাম.. থুড়ি বসলাম। অনু কপালে ফোঁটা দিয়ে মুখে পেল্লাই সাইজের একটা সন্দেশ গুঁজে দিল। মুখে জোর করে একটু হাসি এনে দাঁত ক্যালানে বাঞ্ছারামের মতো মিন মিন করে বললাম… কিন্তু ভাইফোঁটা কাল না? অনু একগাল হেসে বলল … না গো পল্টুদা … আমাদের তো প্রতিপদে ভাইফোঁটা।

মাইরি বলছি, বিশ্বাস করুন তারপর থেকে প্রতি পদে সেই অভিশপ্ত দিনটার কথা মনে পড়ে। বিশেষ করে এই প্রতিপদের দিনটায়। ফিরে এসে বন্ধুদের কাছে কিরকম খোরাক হয়েছিলাম… সেই গল্প আরেক দিন না হয় বলবো।

(বেঙ্গল টাইমসের এক পাঠক পাঠিয়েছেন। সম্ভবত সোশ্যাল সাইট থেকে সংগৃহীত। লেখকের নাম অজানা। কিন্তু লেখাটি তাঁর ভাল লেগেছে বলেই বেঙ্গল টাইমসে পাঠিয়েছেন। লেখকের নাম দেওয়া গেল না বলে দুঃখিত। লেখকের নাম যদি কারও জানা থাকে, জানাবেন। তখন লেখকের নাম যুক্ত করে দেওয়া হবে।)

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.