Categories Uncategorized

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম

কুন্তল আচার্য

পয়লা বৈশাখ ব্যাপারটা ঠিক কী?‌ যখনই এই তারিখটা আসে, নানারকম জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হাজির হয়ে যায়। ভারতের কোন কোন রাজ্যে কী নামে তা পরিচিত। কোন রাজার হাত ধরে কীভাবে এর বিস্তার ইত্যাদি ইত্যাদি। আর কেউ একটা যদি ফেসবুকে ছাড়ল, তাহলে তো কথাই নেই। একদল সেটাকে শেয়ার করতে ব্যস্ত রইল। আরেকদল বলা নেই, কওয়া নেই, কপি পেস্ট করে নিজের নামে ঝেঁপে দিল। তারপর সারাদিন লাইক গুনতে লাগল।

যাক গে সেসব কথা। আমাদের ছোটবেলাটা ছিল বড় অদ্ভুত। আমাদের সময় টিভিও সেভাবে মফস্বলে ঢোকেনি। আর সেলফোন, গুগল, ফেসবুক তো অনেক পরের ব্যাপার। এসব শব্দ তখন কালের গর্ভে। সে ছিল এক নিখাদ আনন্দের দিন। এমনিতে তখন শীত অনেকটাই লম্বা ছিল। এই সময়টায় পরীক্ষার ভ্রুকুটি ছিল না। এই সময়টায় গাজন, মেলার ধুম। কবে কোথায় মেলা হবে, তার একটা মোটামুটি ক্যালেন্ডার ছিল। সেই অনুযায়ী আশেপাশের কোনও মেলা বাদ দিতাম না।

কিন্তু পয়লা বৈশাখ ছিল অন্য কারণে আনন্দের। দোকানগুলো দারুণভাবে সেজে উঠত। অনেক দোকানের বাইরে ফুল টাঙানো হত। ঝাড়পোছ চলত। অনেক দোকানের বাইরে চেয়ার পেতে, ছোটখাটো প্যান্ডেল সাজানো হত। যেসব দোকানে সারা বছরের টুকটাক কেনাকাটা, সেইসব দোকানে একবার করে হাজিরা দেওয়া। কোনওটা বড়দের সঙ্গে। কোনওটা আবার বন্ধুদের সঙ্গে। কোনও দোকানে মিষ্টির প্যাকেট। কেউ আবার বসিয়েই মিষ্টি খাওয়াতেন। দোকানিদের প্রণাম করতাম। অন্যান্য বড়দেরও প্রণাম করতাম।

তবে মিষ্টি বা লাড্ডুকে ঘিরে অবশ্য আমাদের সেই আবেগ ছিল না। তাই আমরা খোঁজ নিতাম, কোন দোকানে লস্যি খাওয়াচ্ছে। কোন দোকানে কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়াচ্ছে, কোন দোকানে আইসক্রিম দিচ্ছে। ছোটদের জন্য এইসব আয়োজনও থাকত। আমাদের সময়ে গোল্ড স্পট বলে এক ধরনের কোল্ড ড্রিঙ্কস ছিল। এমন সুন্দর একটা পানীয় কোথায় যে হারিয়ে গেল!‌ এভাবেই কত দোকানে যে ঢুঁ মারতাম!‌ দোকানিরাও ছিলেন দিলখোলা। সেই দোকানে জিনিস না নিলেও তাঁদের মধ্যে নিমন্ত্রণের ছুৎমার্গ ছিল না। ডেকে ডেকে খাওয়াতেন। আমরাও সেই মতো আশপাশে ঘুরঘুর করতাম।

প্যাকেটগুলো নিয়ে বাড়িতে ফিরতাম। আর দেওয়া হত ক্যালেন্ডার। ওতে অবশ্য আমাদের তেমন আগ্রহ ছিল না। কারণ, বাংলা ক্যালেন্ডার মানেই বড্ড বোরিং। সেই ঠাকুর দেবতার ছবি। ওতে তেমন মতি ছিল না। ফলে, সেগুলো ঘরের লোকেদের হাতে তুলে দিয়ে তাঁদের ধন্য করতাম।

তখন পয়লা বৈশাখ মানেই ছিল হালখাতা। অনেক দোকানে নাকি ধার দেনা শোধ করতে হয়। অনেকে দেখতাম, দোকানির হাতে কয়েকশো টাকা ধরিয়ে দিচ্ছেন। দোকানিও সেগুলো খাতা দেখে মিলিয়ে নিচ্ছেন। কেউ আবার হিসেব–‌টিসেবে যাচ্ছেন না। কে কত জমা করল, জাস্ট লিখে রাখছেন। হিসেবে পরে হবে। আমরা অবশ্য এসব চক্করে ছিলাম না। আমাদের টাকা কোথায় যে ধার মেটাব!‌ ও বাবা–‌কাকাদের কাজ। আমরা বুঝি লস্যি, আমরা বুঝি কোল্ড ড্রিঙ্কস। কে কেমন খাওয়াল, এটাই ছিল আমাদের কাছে সেই দোকানের ইউএসপি। কার দোকানে মাল কেমন, কে সস্তায় দেয়, কার ব্যবহার কেমন, এগুলো বড়রা বুঝুক, আমাদের বুঝতে বয়েই গেছে।

সবমিলিয়ে আমাদের কাছে পয়লা বৈশাখ ছিল অন্য এক উন্মাদনা। যার অনেকটাই হারিয়ে গেছে। এখনকার পয়লা বৈশাখের সঙ্গে সেদিনের সেই নির্মল আনন্দের কোনও তুলনা হবে না। সত্যিই, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.