শ্রুতিনাটক বলতেই ভেসে ওঠে দুটো নাম— জগন্নাথ বসু, উর্মিমালা বসু। অনেকে বলেন, শ্রুতিনাটকের উত্তম–সুচিত্রা। বাংলায় অনেক জুটির মাঝে আরও একটা স্মরণীয় জুটি। এক অনুষ্ঠানে একসঙ্গে পাওয়া গেল সেই জুটিকে। একান্তে পাওয়া গেল উর্মিমালা বসুকেও। কিছুটা ইন্টারভিউ। কিছুটা আড্ডা। বেঙ্গল টাইমসের জন্য সেই অন্তরঙ্গ কথোপকথন তুলে আনলেন সংহিতা বারুই।
প্রশ্ন: এখন শ্রুতিনাটক বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু যখন শুরু করেছিলেন, তখন তো বেশ ঝুঁকির কাজ ছিল। এমন একটা বিষয়কে বেছে নিলেন কেন?
উর্মিমালা: আশির দশকের গোড়ায় নতুন কিছু করার ভাবনা থেকেই এই শ্রুতিনাটক। আস্তে আস্তে ব্যাপারটা পরিচিতি পেতে থাকে। আবৃত্তি তো ছিলই। পাশাপাশি এই শ্রুতি নাটক দর্শকদের ভালই লাগল।
প্রশ্ন: এত এত শ্রুতিনাটক করেছেন। প্রিয় বাছতে বললে কোনগুলো বাছবেন?
উর্মিমালা: ওরকমভাবে প্রিয় হয় না। হাজার হাজার কবিতা। অসংখ্য শ্রুতিনাটক। যেদিন যেটা ভাল লাগে, সেদিনের জন্য সেটা প্রিয়।
প্রশ্ন: রেডিও না মঞ্চ, কোনটা বেশি উপভোগ করেন?
উর্মিমালা: রেডিওর মাধ্যমে একসঙ্গে অনেক দর্শকের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়। শ্রোতাদের মনযোগও হয়ত বেশি থাকে। তবে কোনটা দর্শকদের কেমন লাগল, তা বুঝতে পারি না। কিন্তু মঞ্চে সঙ্গে সঙ্গেই রেজাল্ট। ভাল হলে দর্শক নেবে। খারাপ হলে সঙ্গে সঙ্গেই বুঝিয়ে দেবে।
প্রশ্ন: জগন্নাথ–উর্মিমালা মানেই আবৃত্তির জনপ্রিয় এক জুটি। অন্য কারও সঙ্গে কাজ করেছেন? সেই অনুভূতি কেমন?
উর্মিমালা: অন্যদের সঙ্গেও করেছি। তবে সেটা মূলত অর্থের তাগিদে। সেগুলো খুব একটা উপভোগ্য হয়নি। আমাদের জুটিটাকে শ্রোতারা গ্রহণ করেছেন। দুজনের আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা খুব জরুরি। ভবিষ্যতেও হয়তো অন্যদের সঙ্গে করতে হতে পারে। তবে সেটা নেহাতই প্রয়োজনের তাগিদে। সেই রোমাঞ্চটা থাকবে না।
প্রশ্ন: এত এত কবিতা, শ্রুতিনাটক। মনে রাখেন কী করে?
উর্মিমালা: এতবার করে করতে হয়, এমনিই মুখস্থ হয়ে যায়। তবু রেডিওতে বা মঞ্চে যখন করি, হাতে খাতা রাখতেই হয়। যদি কোথাও ভুলে যাই!
প্রশ্ন: দেশে–বিদেশে এত অনুষ্ঠান করেছেন। প্রিয় অনুষ্ঠান বাছতে বললে কোনটা বাছবেন? কোনও বিশেষ স্মৃতি আছে, যা এত বছর পরেও মনে দাগ কেটে যায়?
উর্মিমালা: অনেক অনুষ্ঠান। অনেক রকম স্মৃতিই রয়েছে। তবে একটি ঘটনা মনে দাগ কেটে যায়। জঙ্গলমহলে অনুষ্ঠান করতে গেছি। তার আগে নানা ভৌতিক গল্প শুনেছি। রাস্তা শুনশান। যেতে যেতে মনে হচ্ছিল, আদৌ লোকজন শুনতে আসবে তো? গিয়ে দেখলাম, মাঠ ভর্তি লোক। একটি মেয়ে বাড়িতে রান্না করে, মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে আমাদের অনুষ্ঠান দেখতে এসেছিল। আমরা যখন ‘তাহার নাম রঞ্জনা’ করলাম, মেয়েটি আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। ছেলেবেলায় বাড়িতে রেডিওতে যাদের নাটক শুনে বড় হয়েছে, তারা যে ওর সামনে, সেটা ওকে যেন নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল। এগুলোই তো বড় পাওনা। এখনও সেই মেয়েটার মুখটা মনে পড়ে।
প্রশ্ন: আপনাদের পর আর শ্রুতিনাটকের তেমন জুটি উঠে এল না।
উর্মিমালা: সেটা আমি বলতে পারব না। তোমরা বলতে পারবে। শ্রুতিনাটকও একরকম কায়িক অভিনয়। শরীরের বিভঙ্গগুলো যদি অভিনয়ের মাধ্যমে কণ্ঠে প্রকাশ না করা যায়, দর্শকরা নেবে কেন? বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীরা হয়ত সেটা সেভাবে করে উঠতে পারছে না। তাই জুটি উঠে আসছে না। অনুভূতি–আবেগ এগুলো হয়তো হারিয়ে যাচ্ছে। বোধ–বুদ্ধির প্রয়োগ হয়ত সেভাবে হচ্ছে না। পড়তে হয়, তাই পড়ে শুনিয়ে দিচ্ছে। তাই শ্রুতিনাটক পিছিয়ে পড়ছে।
প্রশ্ন: শ্রুতিনাটক শুনতে গেলে শ্রোতাকেও শিক্ষিত হতে হয়। ধৈর্য থাকতে হয়। এখনকার দর্শক–শ্রোতাদের সেই ধৈর্য কি কমে আসছে?
উর্মিমালা: একেকজনের রুচি তো একেক রকম। কেউ ব্যান্ড শুনতে ভালবাসে, কেউ কবিতা শুনতে ভালবাসে। তবে আমাদের নিজস্ব কিছু শ্রোতা আছে। তারা ঠিক শোনে। তাই কখনও মনে হয় না সবকিছু হারিয়ে গেছে।
প্রশ্ন: আপনারা অনুষ্ঠান করছেন। সামনে বসে কেউ সমানে মোবাইল ঘেঁটে যাচ্ছে। এতে রাগ হয় না?
উর্মিমালা: রাগ হয়। কিন্তু কিছু করার নেই। শিক্ষার অভাব। কোথায় কী করব, এই বোধটা অনেকেরই থাকে না। তবে যাঁরা শ্রুতিনাটকের শ্রোতা, তাঁদের নিয়ে সমস্যা নেই। তাঁরা জানেন, কখন কী করতে হয়। নানা টেকনোলজি আসছে। আমাদেরও পরিবর্তন দরকার। আমি ফেসবুক করি না, হোয়াটসঅ্যাপ করি না, গল্প করি না, গান শুনি না, এগুলোও কিন্তু অশিক্ষার লক্ষ্মণ। সব জিনিসের ভাল–খারাপ দুটো দিকই আছে। কোনটা কীভাবে গ্রহণ করব, সেটা নিজস্ব রুচির ব্যাপার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেটা নিয়ে মেতে থাকা যেমন ঠিক নয়, তেমনি মুখ ফিরিয়ে থাকাও ঠিক নয়।
প্রশ্ন: ফেসবুক–হোয়াটসঅ্যাপ এগুলোর ফলে নিজের আবৃত্তি বা অনুষ্ঠানের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন। এসব আসায় কতটা সুবিধা হয়েছে?
উর্মিমালা: একটা অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে অনেক খরচ। ছোট ছোট সংস্থা এত টাকা পাবে কোথায়? তারা যদি ফেসবুকে বিজ্ঞাপন করে, তাদের অনুষ্ঠানের ঘোষণা শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে, ভালই তো। তবে ‘একলা অচিন পাখি’ ‘রাত জাগা পাখি’ এই সব লোকের সঙ্গে গল্প করার কোনও ইচ্ছে নেই। এদের সঙ্গে বন্ধুত্বও করি না। যাদের নাম, ছবি দেওয়ার সাহস নেই, তাদের সঙ্গে কীসের বন্ধুত্ব? তবে এই সোশাল মিডিয়াতেই বেশ কিছু হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি। এগুলো না থাকলে হয়ত তাঁদের আর খুঁজেই পেতাম না। কে যে কোথায় আছে, জানতেও পারতাম না।