নন্দ ঘোষের কড়চা:‌ থিম তো নয়, ঘোড়ার ডিম

নন্দ ঘোষের কড়চা

নন্দ ঘোষ আবার বইমেলায় হাজির। ব্রিটেনের থিম প্যাভিলিয়নেও পৌঁছে গেলেন। তাঁর ইচ্ছে হল গিল্ডের মহাপণ্ডিত মাতব্বর ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়কে একটু প্রেম নিবেদন করবেন। সেই প্রেমপত্র কেমন হতে পারে?‌ পড়ে নিন। জেনে নিন।

সেই যে রেজ্জাক মোল্লা বলেছিলেন, ‘‌হেলে ধরতে পারে না কেউটে ধরতে গেছে,’‌ কথাটা খাপে খাপে মিলে যায় ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে। ত্রিদিব চাটুজ্যে, মানে বইমেলার আয়োজক গিল্ড-এর ত্রিদিববাবু। লোকে বলে তাঁর চরিত্রের সঙ্গে গিরগিটি নামক একটি প্রাণীর মিল আছে। তের–‌চোদ্দ বছর আগেও তিনি ছিলেন টকটকে লাল। আবার এখন কটকটে সবুজ। থুড়ি নীল সাদা।

কিন্তু আমরা ওই সব জটিল রাজনৈতিক বিতর্কে ঢুকতে চাই না। আমাদের আজকের বিষয় হল বইমেলার থিম। আচ্ছা, কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে কি চীনের সিনেমা, ইরানের সিনেমা ইত্যাদি থিম থাকে? খাদ্য মেলায় কি মোগলাই খাবার, ইতালিয়ান খাবার ইত্যাদি থিম থাকে? থাকে না। মেলা মানে হরেক জিনিস ছড়িয়ে থাকবে। যার যেটা খুশি কিনবে। মেলার আবার থিম কী হে?

কিন্তু বইমেলায় থিম থাকে। এবং থিমের লিস্টি দেখে মনে হবে, বাংলা ভাষার, ভারতের সব ভাষার সাহিত্য গুলে খাওয়া হয়ে গেছে। তাই বিদেশ নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে। আচ্ছা বুকে হাত রেখে বলুন তো, আমরা কজন, সতীনাথ ভাদুড়ির লেখা পড়েছি? অদ্বৈত মল্লবর্ধনের লেখা পড়েছি? জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর লেখা পড়েছি? প্রমথনাথ বিশির লেখা পড়েছি? পড়া দূরের কথা, ৯০ শতাংশ বাঙালি এঁদের নাম শোনেনি। সদিচ্ছা থাকলে এঁদের বইমেলার থিম করা যেত। একেক মেলায় একেকজন। যেমন, গত কয়েকবছর ধরে প্রয়াত সাহিত্যিকদের নামে প্যাভিলিয়ন হয়েছে। ভাল উদ্যোগ। কিন্তু সেখানে ঢুকলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। এঁদের কোনও চিহ্নই নেই। এমনকী বাংলা ভাষার বইও খুঁজে মেলা ভার।

বাংলার বাইরে বেরতে চাইলে ভারতের কোনও রাজ্যকে থিম করা যেত। মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, অসম, ওড়িশা এই সব রাজ্য থিম হলে আমরা অমৃতা প্রীতম সিং, ইন্দিরা গোস্বামী, ফকিরমোহন সেনাপতি, আর কে নারায়ণন, গিরিশ কারনাড প্রভৃতি সাহিত্যিকদের সম্বন্ধে জানতে পারতাম। ভিনরাজ্যের সাহিত্য সম্পর্কে, সাহিত্যিকদের সম্পর্কে আমরা কতটুকুই বা জানি!‌ বইমেলার হাত ধরে যদি ভিনরাজ্যের সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যেত, মন্দ হত না।

কিন্তু ত্রিদিববাবুরা তো আন্তর্জাতিক বইমেলা করেন। রাজ্য বা দেশ নিয়ে থিম করলে তাঁদের মান–‌ইজ্জত চলে যাবে। তাছাড়া বিদেশ নিয়ে থিম করলে গিল্ড-এর খরচে সেই দেশটা ঘুরে আসা যায়। আমেরিকা, ফ্রান্স, স্পেন ঘোরা হয়ে গেছে। লাতিন আমেরিকাও বাকি নেই। পুরুলিয়ার খবর রাখে না, পেরুর গপ্পো ঝাড়ছে। কখনও থিম হয়েছে কোস্টারিকা, কখনও আবার গুয়াতেমালা। এঁদের গলায় যে কোন মালা পরাই!‌ কতসব বোদ্ধা। কোস্টারিকা গুয়াতেমালার থিম বুঝে একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছে। কোনদিন হয়তো থিম হবে আন্টার্কটিকা। আগেরবারের থিম ছিল স্পেন। কী আশ্চর্য, কয়েক মাস আগে মুখ্যমন্ত্রী শিল্প আনবেন বলে স্পেনে ছুটলেন। কলকাতার ক্লাবের কর্তাদের ধরে নিয়ে গেলেন। বইমেলার কর্তাদেরও নিয়ে গেলেন। না এল শিল্প, না গেল সাহিত্য।

এবার বোধ হয় সম্বিত ফিরেছে। স্প্যানিশ সাহিত্য থেকে এবার তাঁরা ইংরাজি সাহিত্যে ফিরেছেন। মানে, থিম হয়েছে ব্রিটেন। থিম না ঘোড়ার ডিম। ব্রিটিশ প্যাভিলিয়নের বাইরে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলার মজাই আলাদা। সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গাও রাখা আছে। আচ্ছা, ওখান থেকে কজন বই কিনলেন!‌ খুব জানতে ইচ্ছে করে। তবে, কোস্টারিকা, গুয়াতেমালার থেকে অন্তত থিম হিসেবে ব্রিটেন মন্দ নয়।

বিদেশ ঘোরা তো অনেক হল। এবার না হয় দেশের দিকে একটু তাকানো যাক। বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে থিম হোক। না হয় হিন্দি দিয়েই শুরু হোক।

(‌নন্দ ঘোষের কড়চা। বেঙ্গল টাইমসের জনপ্রিয় একটি বিভাগ। নানা সময় তিনি নানা জায়গায় হাজির হয়ে যান। বাঁকা চোখে, স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় তাঁর পাঁচালি লেখেন। এটিকে মজা হিসেবেই দেখতে পারেন। )‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.